শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৪৯ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

নৈতিক শিক্ষা ও আত্মোপলব্ধি

মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
জ্ঞানার্জন করা আল্লাহতায়ালার নির্দেশ। ইসলামে শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো আদম সন্তানকে মানুষরূপে গড়ে তোলা। যে শিক্ষা আত্মপরিচয় দান করে, মানুষকে সৎ ও সুনাগরিক হিসেবে গঠনের পাশাপাশি পরোপকারী, কল্যাণকামী ও আল্লাহর প্রতি অনুগত হতে সাহায্য করে; সেটাই প্রকৃত শিক্ষা। শিক্ষা মানুষের অন্তরকে আলোকিত করে, অন্তর্দৃষ্টি উন্মোচিত করে ও দূরদর্শিতা সৃষ্টি করে। মূলত শিক্ষা হলোআত্মোপলব্ধি। এ জন্য আল্লাহতায়ালা মানুষকে দুই শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। একদল চক্ষুষ্মান (জ্ঞানবান), অন্যদল অন্ধ (জ্ঞানহীন)। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারা কি পৃথিবীর বুকে বিচরণ করেনি, যাতে তারা উপলব্ধিসম্পন্ন হৃদয় ও শ্রবণকারী কানের অধিকারী হতে পারত! আসল ব্যাপার হচ্ছে, চোখ তো অন্ধ হয় না, বরং অন্ধ হয় তাদের হৃদয়, যা বুকের মধ্যে আছে।’সুরা হজ : ৪৬

মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার জন্য প্রকৃত শিক্ষা অর্জন আবশ্যক। কেউ কোনো নির্দিষ্ট একটি বিষয়ে দক্ষ হলে কিংবা উচ্চশিক্ষার পাঠ গ্রহণ করলেই কি তাকে শিক্ষিত বলা যায়? হ্যাঁ বলা যায়, যদি বস্তুগত শিক্ষার পাশাপাশি তার মধ্যে মানুষ হিসেবে মানবিক ও চারিত্রিক গুণ, বৈশিষ্ট্য উপস্থিত থাকে। জ্ঞান, দক্ষতা, বিশ্বাস, ব্যবহার, আচরণ, অভ্যাস, চারিত্রিক সৌন্দর্য অর্জনের বিকাশমূলক প্রক্রিয়া হলো শিক্ষা। এটি একটি জীবনব্যাপী ক্রমবিকাশ প্রক্রিয়া। ব্যক্তির জন্মগত সামর্থ্য, অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা ও স্বতঃস্ফূর্ত চিন্তাশক্তির ক্রমবিকাশ, মানবিক আচরণ ও মূল্যবোধের বিকাশ, উদারনৈতিক মনোভাব গঠনের মাধ্যমে নিজের ও সমাজের জন্য ইতিবাচক, কল্যাণকর ও প্রত্যাশিত পরিবর্তন আনতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে শিক্ষা।

আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা বহুধা বিভক্ত। সাধারণ শিক্ষা, আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা, কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, ইংরেজি মাধ্যম ইত্যাদি। শিক্ষার মাধ্যম নিয়েও রয়েছে ভিন্নতা। পরিতাপের বিষয় হলো, এসব শিক্ষা ব্যবস্থার কোনোটিই এখনো টেকসই ও পূর্ণাঙ্গভাবে দাঁড়াতে পারেনি, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষাকাল শেষ হয়নি। স্বাধীনতার ৫ দশক পূর্ণ হলেও পরিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে না ওঠা, ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত জাতি গঠনের অন্যতম অন্তরায়। এর ফলে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় লেখাপড়া করে আমাদের তরুণরা বর্তমানের প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। যদিও মাঝে মাঝে ব্যতিক্রম দেখা যায়।

শিক্ষাব্যবস্থার সর্বস্তরে টেকসই ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা দরকার। শক্তিশালী জাতি গঠনের স্বার্থে যেকোনো মূল্যে শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণ মুক্ত রাখা প্রয়োজন। রাজনৈতিক দৈন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে সর্বোতভাবে গ্রাস করতে উদ্যত। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসাসহ সবকিছুই রাজনৈতিক দস্যুতা ও অনৈতিকতার বলয়ে আবদ্ধ। শিক্ষাঙ্গনে নারী ও শিশুর নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন। কর্মমুখী শিক্ষার অভাবে শিক্ষার্থীরা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

নৈতিকতার অবক্ষয় তরুণ প্রজন্মকে তিলে তিলে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। নৈতিকতা বিবর্জিত শিক্ষা আর যাই হোক সত্যিকার মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ তৈরি করতে পারে না। অথচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা প্রায় বিসর্জিত বলা চলে। কোরআন-হাদিসের আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পথগুলো বন্ধ কিংবা অনেকটাই সঙ্কুচিত করে ফেলা হয়েছে। ফলে তরুণদের উল্লেখযোগ্য অংশ গড্ডলিকার স্রোতে হারিয়ে ফেলছে নিজেকে। ফলে দেশপ্রেম, নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ, মানবিকতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা ছাড়া আমাদের তরুণ প্রজন্ম আগামী নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। এর প্রভাব পরবর্তী সময়ে কর্মজীবনের নানা অনাচার হিসেবে প্রকাশ পাচ্ছে।

মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাও নানা জটিলতা ও ভেজালে আবদ্ধ। প্রয়োজনীয় সংস্কারের অভাবের পাশাপাশি যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে অনীহা, গতিশীল

নেতৃত্বহীনতা, পরিচালনাগত ত্রুটি ও শিক্ষক প্রশিক্ষণের অভাব মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাকেও প্রশ্নের সম্মুখীন করছে। এমন পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসা দরকার। দরকার শিক্ষার্জনের পাশাপাশি নৈতিক গুণসম্পন্ন হওয়া।

কোরআন মাজিদ অন্যান্য জীবের সঙ্গে মানুষের যে ব্যবধান নির্দেশ করে তা এই, ‘মানুষ নৈতিক জীব’ আর অন্যান্য জীব নৈতিকতার বন্ধন থেকে মুক্ত। ভালো ও মন্দ, সৎ ও অসৎ, সত্য ও মিথ্যার বিচার করার ক্ষমতা মানুষ ছাড়া আর কোনো জীবের মধ্যে দেখা যায় না। নৈতিকতার অবনতির ফলে যখন কেউ মিথ্যা বলে তখন সে পশুর চেয়েও অধম হয়ে পড়ে। কেননা পশু মিথ্যা বলতে পারে না। তাই বস্তুগত শক্তির সঠিক ব্যবহার নৈতিকতার ওপর নির্ভরশীল। একটি চাকু নৈতিকতাসম্পন্ন ব্যক্তির হাতে ব্যবহৃত হলে তা মানুষের উপকার করবে। কিন্তু নৈতিকতার অভাব হলে এ চাকুই তাকে ডাকাতে পরিণত করবে। নৈতিকতাবিহীন পরাশক্তিগুলো বিপুল বস্তুগত শক্তির অধিকারী হয়েছে বলেই মানবজাতি আজ এত বড় সংকটের সম্মুখীন। কেননা এসব শক্তি নৈতিকতায় ভূষিত মানুষের হাতে ব্যবহৃত হচ্ছে না। তাইতো কোরআন হাত, পা, চোখ-কান সর্বস্ব শরীরটিকে প্রকৃত মানুষ মনে করে না।

কোরআন মাজিদের পরিভাষায় মানুষের ভেতর ‘রুহ’ (আত্মা) হলোনৈতিকতার আধার। রুহকে উন্নত করার ব্যবস্থা না করলে এ শরীর পশুর মতো আচরণ করবে। নবী কারিম (সা.) নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষকে এমন এক ঘোড়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন, যা রশি দ্বারা এক খুঁটির সঙ্গে আবদ্ধ। এ ঘোড়াটি যেমন স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে পারে না, তেমনি মানুষ স্বাধীনতা ও নৈতিকতার রশি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাই কেবল রশির সীমা পর্যন্তই সে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে সক্ষম। দক্ষ মানব শক্তির সঙ্গে নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন একটি প্রজন্মই পারে বিকৃত মানবিকতা ও সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিষেধক ও প্রতিরোধ হতে।

পৃথিবীর উন্নত সভ্যতায় উত্তরণে মুসলিমদের অবদান অনস্বীকার্য। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সচেতন মুসলমানদের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে তরুণদের অগ্রণী ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসতে হবে। প্রচলিত

অপসংস্কৃতির বিভীষিকায় হতাশ কিংবা হারিয়ে যাওয়া নয় বরং উন্নত নৈতিকতার ওপর দৃঢ় থাকার মতো সাহস ও মনোবল নিজের মধ্যে সঞ্চয় করতে হবে। তরুণ সমাজকে প্রকৃত জ্ঞান সাধনায় নিবেদিতপ্রাণ হতে হবে। তবেই সমাজে আসবে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন।

লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION