শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:০৭ অপরাহ্ন
মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ইসলাম আসার পর সমস্ত ধর্ম ও বিশ্বাসকে রহিত করা হয়েছে। ঘোষণা দেওয়া হয়েছে ইসলামকে পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা হিসেবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের ওপর আমার নেয়ামত সম্পূর্ণ করলাম আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।’সুরা মায়েদা:৩
কাজেই ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো কিছু অনুসরণ করা ও করার নির্দেশ দেওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। মহান আল্লাহ মানবজাতির সামনে দুটো পথ রেখে, সেই পথের মধ্যে কোনটা সঠিক কোনটা মুক্তির, কোনটা কল্যাণের সেটা বুঝার জন্য সঠিক উপলব্ধি দান করেছেন। সহজে যেন পথ খুঁজে পায় তার ব্যবস্থাও করেছেন। সেই দুই পথের একটি হলোইসলাম। পবিত্র কোরআনে ইসলামকে ‘সরল-সোজা পথ’ উল্লেখ করে ইসলাম ছাড়া অন্যপথ অনুসরণকে ‘পথহারা’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ইসলামের বিধানকে করা হয়েছে সবার উপযোগী, যে কেউ চাইলে তা অনুসরণ করতে পারে। তবে মূলনীতির ক্ষেত্রে ইসলাম সুদৃঢ়, চাইলেই তা রদবদল করা যায় না। নতুন করে বিধান রচনা করে যুক্ত করা যায় না। তবে ব্যাখ্যা ও গবেষণা করা যায়। ব্যাখ্যা-গবেষণার ক্ষেত্রে সীমা অতিক্রম করে, ইসলামের সুমহান বিধানের বিপরীত বিধান রচনা করা সম্পূর্ণ নিষেধ।
ইসলামের বিধানের ক্ষেত্রে যেটা আবশ্যকীয় বিধান অর্থাৎ ফরজ বা ওয়াজিব সেটা নিয়ে কোনো মতপার্থক্য নেই। তবে বিধান পালনের পদ্ধতিগত বিষয়ে পার্থক্য রয়েছে। ব্যক্তির বুঝগত কারণে পার্থক্য সৃষ্টি হলেও মূলনীতি অভিন্ন। এরপরও পবিত্র কোরআনে কোনো বিষয়ে মতপার্থক্য সৃষ্টি হলে করণীয় বলে দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যদি কোনো বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয় তাহলে সে বিষয়টি (মীমাংসার জন্য) আল্লাহ ও তার রাসুলের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যাও, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতের ওপর ইমান এনে থাকো। এ পন্থা উত্তম এবং এর পরিণামও প্রকৃষ্টতর।’সুরা আন নিসা:৫৯
যেকোনো মতভেদের সঠিক সমাধান হলোআল্লাহর কিতাব ও রাসুল (সা.)-এর সুন্নাহর কাছে ফিরে আসা। ইসলামের বিধান খুবই স্পষ্ট, আমলের ক্ষেত্রেও রয়েছে সীমাহীন ফলপ্রসূ উপকার। ব্যক্তি যদি ইসলামকে যথাযথভাবে পালন করে, তাহলে দুনিয়ার এই কালপরিক্রমায় সে উপকৃত হবে। যদিও দুনিয়ায় লাভবান হওয়া মুখ্য বিষয় নয় বরং পরকালীন মুক্তির জন্য দুনিয়াকে যথাযথভাবে কাজে পরিণত করাই আসল বিষয়।
ইসলাম সম্পর্কে ভাবনার বিষয় হলো, ব্যক্তির বুঝগত জায়গা নিয়ে। যে যেমন বোঝেন বা কোনো ব্যক্তি অনুসরণের মাধ্যমে যা বুঝেছেন, সেটাকে যত বেশি গুরুত্ব দেনততবেশি ইসলামের মূলনীতির সহজ ও সাবলীলতাকে গুরুত্ব দেন না, এ কারণে সৃষ্টি হয় মতপার্থক্য এবং সেই মতপার্থক্য রূপ নেয় বিভেদে।
অথচ এখন খুব সহজে ইসলামকে জানা যায় এবং ইসলামের বিধানের কোনো বিষয়ে বোঝার জন্য শত শত মাইল পথ অতিক্রম কিংবা দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয় না। ইসলামের বিধানসমূহের স্পষ্ট ব্যাখ্যা মুসলিম উম্মাহর কাছে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার এবং জ্ঞানী শ্রেণির কাছে সমাদৃত। শুধু প্রয়োজন সঠিক উপলব্ধির মাধ্যমে মন-মগজে ধারণ ও গুরুত্ব দিয়ে পালন করা। কিন্তু উপলব্ধিগত জায়গা বিশ্বব্যাপী বিভেদ সৃষ্টি করছে। মতপার্থক্য আছে এবং থাকবে কিন্তু এ কারণে বিভেদ হতে পারে না বরং সম্মান ও মর্যাদার মাধ্যমে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে দৃঢ় করা মুসলিম উম্মাহর আবশ্যকীয় করণীয় কাজ। দৃশ্যপট ভিন্ন, কেউ শুধু কোরআনকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে, হাদিস অনেকটাই বাদ দিচ্ছেন, কোরআনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, এর মানে এমন নয় যে হাদিস বাদ দিতে হবে। সহিহ হাদিস কোনো সময় কোরআনের বিরোধী হতে পারে না।
প্রকৃত সমস্যা হলোদ্বীন পালনের উপলব্ধিগত দিক দিয়ে সাহাবিদের গুরুত্ব না দেওয়া, ক্ষেত্রবিশেষ তাদের মত, কর্মধারা, রীতিনীতি ও আমল-অভ্যাসকে অস্বীকার করা। এর ফলে ইসলামে অনেক বিদআতের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই বিদআত দ্বারা শিরক সাব্যস্ত হয় এবং ক্ষেত্রবিশেষ ইমান ভঙ্গের কারণ হয়ে যায়।
বিদআতের পরিণতি জাহান্নাম। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) পরিষ্কার ভাষায় পৃথিবীবাসীদের সাবধান করে দিয়েছেন, ‘নিশ্চয়ই সর্বোত্তম বাণী হলোআল্লাহর কিতাব এবং সর্বোত্তম আদর্শ হলো মুহাম্মদের আদর্শ। আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হলো (দ্বীনের মধ্যে) নব উদ্ভাবিত বিষয়। আর নব উদ্ভাবিত প্রত্যেকটি বিষয় বিদআত এবং প্রত্যেক বিদআত হলোভ্রষ্টতা এবং প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম।’সহিহ মুসলিম:১৫৩৫
ব্যক্তি অনেক সময় বিদআতকে প্রশ্রয় না দিলেও নিজের মতো প্রতিষ্ঠার জন্য, নিজের দলের সুবিধার জন্য, অনুসারীদের স্বার্থের জন্য সচেতনতার সঙ্গে কিংবা অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইসলামের অনেক বিষয়কে সামনে আনে না। ইসলামের নানা বিধান বা হুকুম সরাসরি অস্বীকার না করে, তথ্য গোপন না করেভিন্ন কায়দায় আল্লাহর সুস্পষ্ট নির্দেশ গোপন করার ঘোর চেষ্টা করা হয়। বিশেষ করে দ্বীন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আয়াতের ভিন্ন ভিন্ন কৌশলী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, নানা উদাহরণ দিয়ে কৌশল অবলম্বন, বিভিন্ন কিছুর দোহাই এবং কিছুটা বলে আর কিছুটা না বলে এসব কাজ করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে মূলত অস্বীকার করা হচ্ছে কোরআনের আয়াতকে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
বস্তুত দ্বীন প্রতিষ্ঠার বিষয় নিয়ে কোনো বিরোধ থাকা উচিত নয়। তদ্রুপ বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদও কাম্য নয়। ইসলাম বিচ্ছিন্ন থাকাকে অনুমোদন দেয় না। সুরা আশ-শুরার ১২ ও ১৩ নম্বর আয়াত পড়লে পরিষ্কার হয়। তারপরও ভিন্নমত থাকতে পারে, কিন্তু বিভেদ নয়; সত্য গোপন করে বিভেদ সৃষ্টি করা সমুচিত কাজ হতে পারে না। বিভেদ হলোসত্য উপলব্ধি না করে, ইসলামের মূলনীতি আড়াল করে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন নষ্ট করে ইসলামকে ধ্বংসের চেষ্টা।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক