শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:০৭ অপরাহ্ন
আবদুল হাই রঞ্জু :
মহামারীকালের বিরূপ অর্থনীতির ধাক্কা সামাল দিতে না দিতেই বিশ্বজুড়ে এলো আরেক অভিশাপ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, যা সাত মাস ধরে তাবৎ দুনিয়ার মানুষকে এক মহাসংকটে ফেলেছে। এ যুদ্ধের কারণে রাশিয়া, ইউক্রেনের আমদানি-রপ্তানি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়ে পড়ে। অথচ আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের গম-ভুট্টার খাদ্যচাহিদার প্রায় ৭০ ভাগ পূরণ হতো এই দুদেশের উৎপাদিত গমে। ফলে আমাদের দেশে দেখা দেয় গমের সংকট। যদিও বিভিন্ন দেশ থেকে সরকার গম আমদানি করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। শুধু গম-ভুট্টাই নয়, কৃষি চাষাবাদের অন্যতম উপাদান রাসায়নিক সারের চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণ হতো রাশিয়া, ইউক্রেন, বেলারুশের উৎপাদিত সার দিয়ে। সে সার আসাও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আমাদের দেশে সারের সংকট সৃষ্টি হয়। শুধু গম, সারই নয় এ যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহু দেশেই শুরু হয় তীব্র জ¦ালানি সংকট। পরিণতিতে তেলের ব্যবহার কমিয়ে আনতে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নেয়। জ্বালানির অভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পুরো দমে চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে না। কমে যায় বিদ্যুৎ উৎপাদন। রেশনিং করে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু রাখার কারণে শিল্প-কারখানার উৎপাদন কমে আসে। এমনকি বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের কর্মঘণ্টা কমিয়ে সমন্বয় করার চেষ্টাও করতে হচ্ছে সরকারকে। অন্যদিকে সারের সংকট সৃষ্টি না হলেও প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ফলে দেশের কোথাও কোথাও চাষিরা সারের জন্য বিক্ষোভ করছেন।
অথচ খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার অন্যতম অবলম্বন হলো আমাদের কৃষি চাষাবাদ। কৃষি চাষাবাদের ব্যাঘাত যদি কোনো কারণে তীব্র হয়, তাহলে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। ১৭ কোটি মানুষের মুখের আহার জোগান আসে দেশের কৃষি চাষাবাদকে ঘিরে। সেই কৃষি যদি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে, তাহলে আগামীতে দেশে খাদ্য সংকট হবে, মানুষের দুর্ভোগ এবং কষ্ট দুটোই বাড়বে। অতি সম্প্রতি রাজধানীর এক হোটেলে কনসালটিভ গ্রুপ ফর ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ও বাংলাদেশ রিসার্চ পোর্টফোলিও ইন্ট্রাডাকশন অ্যান্ড পার্টনারশিপ ডায়ালগের উদ্বোধনী সভায় খোদ কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, বাংলাদেশের কৃষিতে অনেক অর্জন রয়েছে। তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ভূমি ও পানির ঘাটতি, উন্নত প্রযুক্তির অভাব, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণে পিছিয়ে থাকা, জলবায়ুর অভিঘাত, দুর্বল মার্কেট লিংকেজ, কৃষি শ্রমিকের ঘাটতিসহ বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে কৃষি খাত। বিশেষ করে করোনাভাইরাস মহামারী এ চ্যালেঞ্জগুলোকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এ মহামারী বাংলাদেশের জীবন, জীবিকা এবং কৃষিকে প্রভাবিত করেছে। তিনি আরও বলেন, এ প্রভাব মোকাবিলায় কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ, শ্রমিকের যাতায়াত, অনলাইন বিপণন সুবিধা, স্টিমুলাস প্যাকেজ বাস্তবায়নসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
বাস্তবেই নানা প্রতিকূলতার দরুন বাংলাদেশের কৃষি খাতকে বরাবরই বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হয়। কোনো পণ্যের উৎপাদন বাড়লে কৃষকের কপাল পোড়ে। কিন্তু কৃষিপণ্য সংরক্ষণ উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে সবজি সংরক্ষণ উপযোগী হিমাগারের বড়ই অভাব। সবজিচাষিরা সবজি চাষ করে উপযুক্তভাবে সংরক্ষণ করতে না পারায় অনেক সময়ই পানির দামে সবজি বিক্রি করতে বাধ্য হন, নতুবা ক্ষেতেই ফসল নষ্ট হয়ে যায়। মানুষের বেঁচে থাকার সবজি হয়ে যায় পশুর খাদ্য। এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হয় সত্য, কিন্তু এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার বাস্তবভিত্তিক কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন না। ফলে কৃষকের ভাগ্যের পরিবর্তনও হয় না। উল্টো বৈশি^ক নানামুখী সমস্যার কবলে পড়ে কৃষককে সর্বস্বান্ত হতে হয়।
অতি সম্প্রতি জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎ ঘাটতি তীব্র আকার ধারণ করেছে। পত্রিকায় দেখলাম ঠাকুরগাঁওয়ে হিমাগারে মজুদ রাখা আলু পচে যাওয়ায় সে আলু রাস্তায় ঢেলে চাষিরা বিক্ষোভ করেছেন। শুধু তাই নয়, বিদ্যুতের অভাব, গ্যাসের অভাবে দেশের সার কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে সারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আবার ইউরিয়ার দাম বেড়েছে কেজিতে ৬ টাকা। যদিও সরকার সারের ঘাটতির কথা মানতে নারাজ। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং কৃষিমন্ত্রীও বলেছেন পর্যাপ্ত সার মজুদ আছে। সারের কোনো সংকট হবে না। তবে বাস্তবতা হচ্ছে পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে সারের জন্য কৃষকরা বিক্ষোভ করছেন। আমরা মনে করি, সারের জন্য যেন কৃষককে বিক্ষোভ করতে না হয়, তা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। কারণ সার হচ্ছে উন্নত চাষাবাদের বড় নিয়ামক। চাষিরা ফসল ফলাবে, সে ফসল দিয়ে মানুষের জীবন রক্ষা হবে। অর্থাৎ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে কৃষি চাষাবাদ যেন কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।
এমনিতেই বৃষ্টির অভাবে আমন আবাদের জমি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আমনের ফলন কমে আসার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। ফলে সরকার গ্রামাঞ্চলে আমনের জমিতে সেচ দিতে রাত ১২টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। এমনকি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আমনের জমিতে সেচের পানি কীভাবে সমন্বয় করা যায়, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে এরই মধ্যে নির্দেশ দিয়েছে। আমনের পরপরই শুরু হবে বোরো চাষাবাদ। বোরো চাষাবাদ থেকে বছরের মোট চাহিদার সিংহভাগ ধান উৎপাদন হয়ে থাকে। আর বোরোর চাষাবাদ সম্পূর্ণ সেচনির্ভর। দেশে সেচযন্ত্রের সংখ্যা ১৬ লাখ ১০ হাজার। এর মধ্যে ১৩ লাখ ৪০ হাজার ডিজেলচালিত। বাকি ২ লাখ ৭০ হাজার সেচযন্ত্র বিদ্যুৎচালিত। অর্থাৎ সেচের অবলম্বন হচ্ছে একদিকে বিদ্যুৎচালিত পাম্প, অন্যদিকে ডিজেলচালিত শ্যালো ও ডিপ টিউবওয়েল। দুদিকেই মহাবিপদ। একদিকে বিদ্যুতের সংকট, অন্যদিকে ডিজেলের অভাব। আবার ডিজেল পাওয়া গেলে লিটারে ৩৪ টাকা বেশিতে কিনে সেচ দিতে হবে। এর অর্থ দাঁড়ায়, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। আর ধানের উৎপাদন খরচ বাড়লে সাধারণ ভোক্তাদের বেশি দামে চাল কিনে খেতে হবে। অনেকটা ‘গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার’ অবস্থার মতোই। কৃষি চাষাবাদের উপকরণ সার, বিদ্যুৎ, ডিজেল, কৃষিশ্রমিক সব ক্ষেত্রেই যদি ধানচাষিদের বেশি খরচ করতে হয়, তাহলে উৎপাদন যেমন কমে আসবে, তেমনি বাড়তি দামে চালও কিনতে হবে।
দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে নির্বিঘœ চাষাবাদের কোনো বিকল্প নেই। মনে রাখা দরকার, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর নেতিবাচক প্রভাব কৃষি খাত থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য অর্থনীতি সব ক্ষেত্রেই বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। ফলে সরকারের এখনই ভর্তুকির পরিমাণ বাড়িয়ে জ¦ালানি, বিশেষ করে ডিজেলের দাম আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য সবই মুখ থুবড়ে পড়বে। পরিণামে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কৃষি খাত। সবদিক বিবেচনায় নিয়ে কৃষি খাতের আগামী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের আরও দায়িত্ব নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
লেখক : কৃষি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক
ahairanju@gmail.com