সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ১০:০১ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

নবীজির পরশে

ধর্ম ডেস্ক:

বন্ধ দুচোখের তারায় স্থির, মক্কার ধুধু মরুর সৌন্দর্য; হেরা পর্বতের রূপ-ঐশ্বর্য এবং হৃদয়জুড়ে আঁকা বদর প্রান্তের বালুকণা স্পর্শ করে ছুটে চলা হাবিবে রাসুলের সাকার নামের সেই ধূসর বর্ণের ঘোড়ার বিমুগ্ধ চিত্র। হৃদয়ের গহিনে যেন চোখের খুব কাছে এই তো সেই খেজুর বৃক্ষময় বুলন্দ শহর মদিনা, যেখানে হাবিবে রাসুলের আগমনকে ‘তালাআল বাদরু’ সুরের মূর্ছনায় স্বাগতম জানানো হয়েছিল। স্বাগত সে মিছিলে সাকিয়ে কাউসার রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শান্ত উপস্থিতি কিংবা খন্দকের যুদ্ধে তীব্র ক্ষুধার যাতনায় পেটে পাথর বাঁধার সেই দৃশ্য শুধু সে হৃদয়েই অনুভূত হয়, যে হৃদয়ের প্রতিটি কোনা রাব্বুল আলামিন নবীজির ভালোবাসার আবরণে পূর্ণ করে দিয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এ ভালোবাসা জন্মানোর প্রধান মাধ্যম সিরাতুন নবী।

আরবি ভাষার বিখ্যাত অভিধান ‘মিসবাহুল লুগাত’-এ সিরাত শব্দের অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে কর্ম-নৈপুণ্যগতি, পথ, পদ্ধতি, ধারা, আকার ইত্যাদি অর্থে।

নবী করিম (সা.)-এর মূল সিরাত হলো তার বিশাল হাদিসভাণ্ডার। তবে প্রাথমিক যুগের মনীষীদের মতে রাসুল (সা.)-এর সরাসরি অংশগ্রহণ করা যুদ্ধসমূহ এবং রাসুল কর্র্তৃক প্রেরিত যুদ্ধাভিযানসমূহের সমষ্টিকে সিরাত বলে। বরং তাদের মতে সিরাত হলো সিরাত, আদব, তাফসির, আকাইদ ইত্যাদি আটটি বিদ্যার সমষ্টির নাম। সে হিসেবে সিরাত ইলমে হাদিসের একটি অংশ। তবে এখনকার সময়ের পণ্ডিত মনীষীরা সিরাত বলতে নবী করিম (সা.)-এর পূর্ণাঙ্গ জীবনচরিতকে বুঝিয়েছেন।

সিরাতচর্চায় প্রথম পর্যায় : ইসলামের পঞ্চম খলিফা হিসেবে খ্যাত হজরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের পরামর্শক্রমে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাতের ৮৫ বছর পর ইমাম শিহাব আল জুহরি (জন্ম ৫১ হিজরি, মৃত্যু ১২৪ হিজরি) সিরাতচর্চা শুরু করেন। তিনি যে সংক্ষিপ্ত জীবনী রচনা করেন, সেটিই সিরাতবিষয়ক প্রথম গ্রন্থ। শিহাব জুহরির ছাত্র মুসা ইবনে উকমা (মৃত্যু ১৪১ হিজরি) দ্বিতীয় সিরাত গ্রন্থটি রচনা করেন। পরে শিহাব জুহরির আরও কয়েকজন ছাত্র ইবনে ইসহাক, ওমর ইবনে রাশেদ, আবদুর রহমান ইবনে আবদুল আজিজ ও ইবনে সালেহ প্রমুখও সিরাত গ্রন্থ রচনা করেন। প্রথম সিরাতকার হিসেবে বর্তমান বিশ্বে যে নামটি সম্মানের সঙ্গে উচ্চারিত হয় তিনি হলেন ইবনে ইসহাক (জন্ম ৮৫ হিজরি, মৃত্যু : ১৫১ হিজরি)।

হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাতের মাত্র ৭৪ বছর পর মদিনায় জন্মগ্রহণকারী ইবনে ইসহাকের রচিত ‘সিরাতু রাসুলুল্লাহ’ সিরাতবিষয়ক সর্বাধিক প্রাচীনতম এবং পূর্ণাঙ্গ প্রামাণ্য গ্রন্থ। এরপর ইবন হিশাম তার পূর্বসূরি ইবনে ইসহাক রচিত ‘সিরাতু রাসুলুল্লাহ’ নামক গ্রন্থটির সংশোধিত, পরিমার্জিত রূপ দিয়ে সংক্ষিপ্তাকারে ‘সিরাতে নবুবিয়্যা’ নামে প্রকাশ করেন, যা সিরাতে ইবনে হিশাম নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। আজ পর্যন্ত এ গ্রন্থটি প্রামাণ্য সিরাত গ্রন্থ হিসেবে সর্বাধিক সমাদৃত।

সিরাত অধ্যয়নের প্রভাব : সিরাত অধ্যয়ন এমন এক পথ, যা পাঠককে পৌঁছে দেয় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সার্বিক জীবনের স্বর্ণদীপ্ত সময়ে। তাছাড়া হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা স্থাপন ইমানের অংশ। ইরশাদ হয়েছে, ‘(হে রাসুল! আপনি) বলে দিন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও তবে আমাকে অনুসরণ করো। তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন, আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।’ সুরা আলে ইমরান : ৩১

পবিত্র মেঘমালা সিরাতে নববি : সিরাতে নববি সেই পবিত্র মেঘমালা, যা হৃদয়ের বিরান ভূমিকে সজীব করে। সিরাতের অলিগলি সব আত্মিক-ব্যাধি থেকে আরোগ্য দান করে এবং দ্বিধা-সংশয় দূর করে দেয়। সিরাত অধ্যয়নে পাঠকের হৃদয়ে একীভূত হয় হাসি, আনন্দ, উৎকণ্ঠার ত্রিমুখী অনুভূতি, তখন পাঠকের হৃদয়জুড়ে এক জান্নাতি প্রশান্তি রাব্বে কারিম নাজিল করেন। সিরাত অধ্যয়নের ধারাবাহিকতা যখন পাঠককে নবীজির ওফাতে পৌঁছে দেয় তখন দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসে, হৃদয় হয় বিদগ্ধ মরুপ্রান্তর। তবুও বারবার এ অধ্যায়েই চোখ বুলিয়ে হৃদয় যন্ত্রণায় জ্বলতে চায় গলতে চায়, সিরাতের মধ্যেই যে পুঞ্জীভূত সব তৃপ্তি পরিতৃপ্তি।

হাবিবে রাসুল (সা.)-এর জীবন সহজ সরল ও খোলামেলা স্পষ্ট। এতটাই স্পষ্ট যে, পাঠক রাসুল (সা.)-এর পূর্ণ ব্যক্তিত্বের বর্ণনা পড়লে অবাক হতে বাধ্য। সিরাত গবেষকরা রাসুলুল্লাহর দৈহিক, আত্মিক ও দিন-রাতের কর্মের সবকিছুর বিবরণ এমনভাবে দিয়েছেন যার কোনো অপূর্ণতা নেই। হজরত আনাস (রা.) বলেন, আমি নবীজির চুল ও দাড়িতে গুনে গুনে ১৪টি চুল পেয়েছি। মুখতাসারুশ শামায়েল

রাহমানুর রাহিম রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ভেতর-বাহির স্বচ্ছ ও পবিত্র করেছেন। সিরাতের সবচেয়ে হৃদয়কাড়া দিক হলো ‘সমগ্র সিরাতই প্রীতির দিকে আহ্বান করে।’ মূল কথা হচ্ছে নবীজির জীবনী এতটাই সংরক্ষিত যে, তার পাকা চুল-দাড়ি এবং সেই কেশগুলোর অবস্থানও অতি যতেœ সিরাত গবেষকদের গ্রন্থিভুক্ত হয়েছে। সিরাতের পাতায় পাতায় তার প্রতিটি কথা, নড়াচড়া, জনতায় ও নির্জনতায় একেকটি ভাব ও ভাষার নমুনা, চলাফেরা, জীবনযাপন, পোশাকপরিচ্ছদ, খাবার গ্রহণ ও চেহারা-সুরত ইত্যাদি সবকিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা সিরাতের পাতায় পাতায় এখনো বিদ্যমান রয়েছে; সিরাত সংকলকরা অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে তা সংরক্ষণ করেছেন এবং আজও সিরাত সংকলন, চর্চা ও অধ্যয়ন অব্যাহত রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা ইমান আনো আল্লাহর প্রতি ও তার বার্তাবাহক উম্মি নবীর প্রতি যে আল্লাহ ও তার বাণীতে ইমান আনে এবং তার আনুগত্য করে, যাতে তোমরা সঠিক পথ পাও।’ সুরা আরাফ : ১৫৮

সভ্যতার নির্মাতা : আরবের তপ্ত প্রান্তরে অজ্ঞতা এবং অশান্তির চরমে লিপ্ত থাকা একটি জাতি হাবিবে রাসুল (সা.)-এর পরশে আমূলে পাল্টে যায় এবং সেই জাতিই পরে রাসুল (সা.)-এর অনুসরণে-অনুকরণে হয়ে উঠে ইতিহাসের সবচেয়ে সমৃদ্ধ সভ্যতার নির্মাতা।

ইসলামি এ সভ্যতার বিশাল বিশাল বিজয়ী কাফেলার ইমান জাগানিয়া বিবরণ স্বর্ণাক্ষরে ইতিহাসের পাতায় উল্লেখ আছে। ইমান পরিপূর্ণ হয়েছে কি না তা বোঝার অন্যতম মাপকাঠি হচ্ছে হাবিবে রাসুল (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা। সাহাবায়ে কেরাম প্রিয় নবীজিকে ভালোবাসতেন নিজেদের জীবনের চেয়েও বেশি। নবীয়ে রহমত (সা.)-এর প্রতি সাহাবায়ে কেরামের ভালোবাসার হাজার উদাহরণ রয়েছে সিরাতের পাতায় পাতায়। এসব ভালোবাসা পাঠকের চোখ শীতল করবে।

হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সিরাতচর্চা ইসলামের সূচনালগ্ন থেকে অব্যাহত গতিতে চলে আসছে এবং চলতে থাকবে। তার সম্পর্কে কেউ কোনো ভুল ব্যাখ্যা, অপব্যাখ্যা, সত্যের অপলাপ করতে পারবে না। মুসলিম সিরাত চর্চাকারীরা এ সুযোগ তাদের দেবেন না, বরং নবী করিম (সা.)-এর সিরাত সম্পর্কে লাখো গ্রন্থ মুসলিম লেখকরা অত্যন্ত যতে্নর সঙ্গে তথ্যপূর্ণভাবে রচনা করেছেন এবং করছেন। আদর্শহীন কোনো জনগোষ্ঠী পৃথিবীতে সমাদৃত হতে পারে না, মানবসমাজের সব ক্ষেত্রে গৌরবময় উত্তরণের পথই হলো নবুওয়তি আদর্শ। রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘কারও কাছে সৎপথ স্পষ্ট হওয়ার পরও যদি সে রাসুলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের পথ ছাড়া অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে যেদিকে সে ফিরে যায় সেদিকেই তাকে ফিরিয়ে দেব এবং তাকে জাহান্নামে দগ্ধ করব, আর তা কত মন্দ আবাস।’ সুরা আন নিসা : ১১৫

মুমিনের হৃদয়ে প্রিয় নবীজির প্রতি ভালোবাসার স্ফুলিঙ্গ আজও বিদ্যমান, যে কারণে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি কথা কিংবা কাজে কেউ কটাক্ষ করলে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে মুমিনের বক্ষ। যদিও স্বীকার করতে হবে, আমাদের প্রজন্মের মধ্যে এ ভালোবাসার সংকট দেখা দিয়েছে, দেখা দিয়েছে আত্মপরিচয়ের তীব্র সংকট। সর্বোপরি এ সংকট মোকাবিলায় সিরাতে মুহাম্মদ (সা.) ছাড়া বিকল্প পথ নেই, আর এ পথে প্রিয়জনদের শামিলের দায়িত্ব আমাদেরই। মনে রাখতে হবে, সিরাতের ইতিহাস মুসলিমদের অস্তিত্ব, অস্তিত্বের পরিচয় জানা ছাড়া এই চলমান ফেতনার স্রোতের বিপরীতে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে যাবে আর এ টিকে না থাকার মানে নিজের ক্ষতির সঙ্গে সমগ্র উম্মাহকে ক্ষতিগ্রস্ত করা।

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION