সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:২৬ অপরাহ্ন
মাওলানা আবদুল জাব্বার:
ইসলামি বিধান মতে, কোনো মানুষেরই একটি মুহূর্ত অযথা অপব্যয় করার অধিকার নেই। সবার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের হিসাব মহান আল্লাহর কাছে দিতে হবে। হয় দুনিয়ার কল্যাণে, না হয় আখেরাতের কল্যাণে সময় ব্যয় করতে হবে। ইসলামের শিক্ষা হলোসবাইকে খেটে খেতে হবে। কেউ যদি নিজ চেষ্টায় কর্মসংস্থান করতে না পারে, সরকারকে অবশ্যই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। ইসলামি রাষ্ট্রে জনগণ অভাবমুক্ত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছেরাষ্ট্রীয় প্রতিপালন নীতি কিংবা ব্যবস্থাপনা। ব্যক্তি বৈধ উপায়ে জীবিকা অর্জনের জন্য চেষ্টা করবে। যদি চেষ্টা করে ব্যবস্থা করতে না পারে, তবে তার কর্মসংস্থানের উপায় করবে সরকার। সমাজে যদি কারও কাছে আল-আফওয়া, অর্থাৎ তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু থাকে, তবে তা বিনা ক্ষতিপূরণে নেওয়ার অধিকার রাষ্ট্র অথবা সরকারের আছে। তার মাধ্যমে বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে। বেকারদের যার যতটুকু কর্মের ক্ষমতা আছে, সেই যোগ্যতা অনুসারে সরকার তাকে নিয়োগ দান করবে।
কোরআনে কারিমে ঘোষণা করা হয়েছে, মানুষের জন্য নয়, এমন কিছু যার জন্য সে পরিশ্রম করবে না। যারা খাদ্য-বস্ত্রের জন্য আল্লাহর ওপর নির্ভর না করে বাবা, ভাই, চাচা বা অন্যের রোজগার বা করুণার ওপর নির্ভর করে, তারা হজরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)-এর মতে মুশরিক। ফতুহুল গায়েব
অবশ্য যারা শিশু, অতি রুগ্ণ, বৃদ্ধ বা পঙ্গু, তাদের কথা আলাদা। কোরআন মজিদে শ্রমের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যখনই মানুষকে সাবধান করে কিছু বলা হয়েছে, তখনই ‘যারা বিশ্বাস করে এবং কাজ করে’ বলা হয়েছে। বস্তুত আল্লাহর দেওয়া জীবনবিধান মেনে চললে তাদের কোনো অভাব ও সমস্যা থাকে না। তাদের রিজিক আল্লাহতায়ালা দেন আকাশ-বাতাস থেকে। অন্ধকার থেকে, সমুদ্রের গর্ভ থেকে, পানি ও খনি থেকে। অর্থাৎ এমন অজানা স্থান থেকে, যা মানুষ চিন্তা ও কল্পনা করতে পারে না।
কিন্তু আল্লাহর বিধান বাদ দিয়ে মানুষ যদি নিজেরা বিধান তৈরি করে চলতে থাকে, তবে তাতে কোনো সমস্যার সমাধান তো হয়ই না বরং আরও নানা নতুন নতুন সমস্যায় ব্যক্তিজীবন ও সমাজ জীবনে এমনভাবে জড়িয়ে যায় যে, তাতে দুঃখ-কষ্ট আর দুর্দশার অন্ত থাকে না। এ বিষয়ে আমাদের সামনে রয়েছে অনেক উদাহরণ দেওয়ার মতো ঘটনা।
একসময় ক্ষুধা-দারিদ্র্য ও শ্রেণি ভেদাভেদমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য রাশিয়া সমাজতন্ত্র কায়েম করেছিল। কিন্তু সে সুখের স্বর্গরাজ্য সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বরং সব মানুষের জীবনে নেমে এসেছে হতাশা, বঞ্চনা, যন্ত্রণা এবং অশান্তি। সে মানুষ আর মানুষ থাকেনি, মানুষ হয়েছে পশুসবাই হারিয়েছে মানবিক অধিকার।
ইসলামের বিধানে রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের অধিকারী হবেন, তিনি রাষ্ট্রের দুর্বল, দরিদ্র ও বঞ্চিতদের সব ধরনের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। হজরত ওমর (রা.)-এর শাসনকালে জনসাধারণ এতটা অভাবমুক্ত ও নিরাপদ ছিল যে, সে সময় দেশের কোথাও চোর, ডাকাত, সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ ও লুটপাটকারী ছিল না। জনসাধারণ ঘরের দরজা খুলে নিরাপদে ঘুমাতে পারত।
ইতিহাসে উল্লেখ আছে, তার শাসনকালে শানা থেকে হাজরামাউত পর্যন্ত দীর্ঘ হাজার মাইল পথ একজন সুন্দরী নারী বহুমূল্যবান স্বর্ণের অলংকার পরে একা রাস্তায় চলে যেত, তার প্রতি কেউ তাকাতে সাহস পেত না। আর বর্তমানে সভ্যতার গর্বে গর্বিত সমাজে নারীরা ঘরে-বাইরে, অফিসে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোথাও নিরাপদ নয়। নারীরা শহরে দিনে-দুপুরে চলতে তাদের হাতের বালা, কানের দুল ছিনতাইকারীরা ছোঁ মেরে ছিঁড়ে নেয়।
বর্তমান বিশ্বে সর্বাপেক্ষা সম্পদশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ নগরী নিউ ইয়র্ক ও রাজধানী ওয়াশিংটনের জনবহুল পার্কসমূহে বহু ভিক্ষুক দেখা যায়। পাশ্চাত্য জগতের বড় শহরগুলোয় ভিক্ষুকরা নানা বেশে ভিক্ষা করে নাগরিকদের বিরক্ত করে। কেউ গান গেয়ে টাকা চায়, কেউ দুই টাকার জিনিস পাঁচ টাকায় বিক্রি করে। কেউ আবার এতসব ঝামেলা না করে সরাসরি সামনে এসে হাত পাতে। অনেকের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই শহরে। কেউ রাতে পার্কে অথবা কোনো বাসার সিঁড়ির নিচে পড়ে থাকে। এসব দেশের ধনীরা বাসায় কুকুর পোষে, কুকুর লালন-পালন করার চাকর আছে, ট্রেনিং দেওয়ার মাস্টার আছে। কিন্তু দরিদ্রদের প্রতি কারও নজর নেই। এমন অবস্থা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
আমরা জানি, জীবন বাঁচাতে সব প্রাণীর চাহিদা থাকে। শ্রেণিভেদে তা ভিন্ন হয়। এর মধ্যে আশরাফুল মাখলুকাত মানুষের চাহিদা উল্লেখযোগ্য। তারা অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের অভাবপূরণ করতে সংগ্রামশীল। সে সংগ্রামে উত্তীর্ণ হয়ে কেউ হয় ধনধান্য, আবার কেউ অকৃতকার্য হয়ে হয় সর্বস্বান্ত। সর্বস্বান্ত মানুষগুলোর পাশে থেকে সাধ্যানুসারে সহযোগিতা করলে প্রত্যক্ষভাবে যেমন অভাব-অনটন কিংবা কাটানো যায় এর মাধ্যমে মেলে পরকালে আল্লাহর সীমাহীন অনুগ্রহ।
বর্তমানে সাধারণ মানুষ জীবনের কঠিন মুহূর্ত পার করছে। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য ইসলাম সর্বক্ষেত্রে অপচয়রোধের পাশাপাশি জাকাতভিত্তিক অর্থনীতি চালু, সুদের আদান-প্রদান পরিত্যাগ, ব্যভিচার বন্ধ এবং নির্ধারিত পরিমাণের (ওজন) কম দেওয়ার মতো মন্দ অভ্যাস বন্ধ করার কথা বলেন। সেই সঙ্গে পরামর্শ দেন, বেশি বেশি তওবা-ইস্তেগফারের।
অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা গেছে, অপব্যয়ীকে জীবনের কোনো না কোনো একসময় কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। তাদের বদভ্যাস হলোমিতব্যয়ী না হয়ে অপব্যয়ী হওয়া। স্বীয় প্রতিপত্তি বজায় রাখতে কোনো আয়োজনে প্রয়োজন অতিরিক্ত খাবার নষ্ট করা, পোশাক-গহনা পরিধান করা, বাড়ি-গাড়ি করা, বিদ্যুৎ অপচয় করা ইত্যাদি। যা দিয়ে অভাবীদের প্রয়োজন মেটানো সম্ভব। তাই মিতব্যয়ী (অপচয় না করে) হয়ে চলার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে আদম সন্তান! তোমরা প্রত্যেক নামাজের সময় সুন্দর পরিচ্ছদ পরিধান করো, খাও ও পান করো এবং অপব্যয় করো না। তিনি অপব্যয়ীদের পছন্দ করেন না।’ সুরা আরাফ : ৩১
অপব্যয়ীরা শুধু আল্লাহর অপচ্ছন্দনীয়ই নয়; বরং শয়তানের ভাই বলে অভিহিত করা হয়েছে। কোরআনে কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, ‘এবং কিছুতেই অপব্যয় করো না। নিশ্চয়ই অপব্যয়ীরা শয়তানের ভাই।’ সুরা আল ইসরা : ২৬-২৭
অপচয়ের নিকৃষ্ট দিকের নাম অহংকার। ধনাঢ্য বলেই অপচয়। নিঃস্ব হলে কুড়িয়ে নিতে যেমন লজ্জা লাগত না, ঠিক তেমনি মিতব্যয়ী হয়ে খরচ করলে নিঃস্ব হয়ে ধারে ধারে যেতে হবে না ইনশাআল্লাহ। সে সম্পর্কে বিশ্বনবী (সা.) হাদিসে ইরশাদ করেন, ‘হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা পানাহার করো, দান-খয়রাত করো এবং পরিধান করো। যেন তাতে অপচয় বা অহংকার যুক্ত না হয়।’ সুনানে ইবনে মাজাহ : ৩৬০৫
ভয়েস/আআ