শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০২:৪৭ পূর্বাহ্ন
আবু আফজাল সালেহ:
পর্যটনে সম্ভাবনাময় একটি দেশ আমাদের বাংলাদেশ। একটু নজর দিলে এ-খাত থেকে প্রচুর আয় করা সম্ভব। এটিকে বলা হয় অদৃশ্য অর্থনৈতিক শক্তি। পর্যটন বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম খাত। অনেক উন্নয়নশীল দেশের অন্যতম শীর্ষ আয়ের খাত পর্যটন। পর্যটন শিল্প অনেক উন্নয়নশীল দেশের জন্য রক্তপ্রবাহ হিসেবে ভূমিকা রেখে ওইসব দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক ব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। এ-শিল্পের সঙ্গে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে অনেক শিল্প নির্ভর করে। পর্যটন একটি বহুমাত্রিক ও শ্রমঘন শিল্প। সবচেয়ে দ্রুত সম্প্রসারণশীল ও বৃহৎ বাণিজ্যিক কর্মকা- হিসেবে এ শিল্প বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করেছে। প্রচুর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয় পর্যটন খাতে। পর্যটন শিল্পের সঙ্গে পরিবহন, হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ, রিসোর্ট, এয়ারলাইনস ও অন্যান্য বহু খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। পর্যটন বিকশিত হতে হলে যোগাযোগ খাতও বিকশিত হয়। এর মাধ্যম পৃথিবীর অনেক দেশ প্রতি বছর প্রচুর রাজস্ব আয় করে, যা অন্য অনেক বড় শিল্প থেকে পাওয়া আয়ের চেয়েও বেশি। আমাদেরও পর্যটনে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থান এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের জন্য অত্যন্ত অনুকূল।
পর্যটন শিল্পের প্রচারের জন্য ট্রেন/বাস/স্টিমার/লঞ্চ প্রভৃতির যাত্রী টিকিটে সংশ্লিষ্ট এলাকার ট্যুরিজম/ঐতিহ্যের ছবি সংযুক্ত করা যায়। সংশ্লিষ্ট ট্রেন-স্টেশন থেকে টিকিটে সেই এলাকার পর্যটন এলাকার ছবি ও একেবারেই সংক্ষিপ্ত শিরোনাম দিতে হবে। এতে মনের অজান্তেই যাত্রীরা সংশ্লিষ্ট এলাকার গুরুত্বপূর্ণ এলাকা/ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারবেন। জেলাভিত্তিক না-করা গেলেও রেলের টিকিটে অঞ্চলভিত্তিক এ উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। তবে বাস বা নৌযাত্রীদের টিকিটে সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রাধান্য দিতে হবে। বাসমালিকদের ক্ষেত্রে সরকার এরকম আদেশ জারি করতে পারে। আর একটি সুপারিশ খুব কার্যকর হতে পারে সেটি হলো ট্রেন স্টেশনগুলোতে বা বাস টার্মিনালে বা নৌবন্দরে সংশ্লিষ্ট এলাকার ভ্রমণের চিত্র দেয়ালে তুলে ধরা এবং ভিডিও প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা। এতে ট্রেনের অপেক্ষায় থাকা যাত্রীরা কাছাকাছি স্পট ঘুরে আসতে অনুপ্রাণিত হবেন বলে মনে করি।
পাঠ্যপুস্তকে আরও বেশি করে ট্যুরিস্ট স্পট নিয়ে লেখা-ছবি অন্তর্ভুক্ত করা যায়। অনেক উন্নত দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ভ্রমণের ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীরা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন কালচার সম্পর্কে বাস্তব অবস্থা জানতে পারে এবং পরে বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলায় সহযোগী হতে পারে। ভ্রমণফিচার বা ট্যুরিস্ট স্পট নিয়ে যেসব ব্যক্তি/সংস্থা লেখালেখি করেন তাদের অনুপ্রাণিত করার জন্য বিভিন্ন পুরস্কারের ব্যবস্থা করা যায়। অনেক দৈনিকে ভ্রমণফিচার ছাপা হয়। প্রায় সব পত্রিকা/মাধ্যমে ভ্রমণফিচারের জন্য আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে। এসব বিষয়ও মাথায় রাখতে হবে। ভালো পাতার পত্রিকারও মূল্যায়ন করার ব্যবস্থা করতে পারে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর/সংস্থা। বিভিন্ন দূতাবাসে লিফলেট বা তথ্য সংবলিত ম্যাগ/বই প্রেরণের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে বিদেশি/প্রবাসীদের আকর্ষণ করা যাবে। ভারত তাদের ভ্রমণ স্পটগুলো প্রচারের জন্য বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করেছে। এর জন্য বিভিন সাইটও খুলেছে অনলাইনে। এগুলো খুবই তথ্যসমৃদ্ধ। এমন একটা সাইট হলো ‘ইনক্রিডেবল ইন্ডিয়া’। ভিডিও, ছবি এবং তথ্যে সমৃদ্ধ একটি পর্যটন সাইট। ভারতের মতো আমরাও এরকম বিভিন্ন সাইট খুলতে পারি। আর যেসব সাইট বিদ্যমান, সেগুলো আরও তথ্যসমৃদ্ধ করতে পারি। চট্টগ্রাম অঞ্চলের জন্য আলাদা পরিকল্পনা নিতে হবে। একইসঙ্গে পাহাড়, সমুদ্র সৈকত, নদী, পাথর, বনাঞ্চল, ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্থাপত্য, বিভিন্ন ধর্মীয় স্থাপনা ইত্যাদির প্যাকেজ পৃথিবীর আর কোনো এককস্থানে নেই। শুধু চট্টগ্রাম অঞ্চলে পর্যটনে আলাদা গুরুত্ব দিতে হবে, বাজেট বাড়াতে হবে। বিদেশিরা অনেক সময় খোলামেলা পরিবেশ পছন্দ করেন। এসব সেদেশের কৃষ্টি-কালচার। বিদেশিদের জন্য কক্সবাজার, কুয়াকাটা বা সৈকত এলাকায় সংরক্ষিত এলাকা তৈরি করা দরকার। বাঙালির ভিড় এড়িয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতে পারলে বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট করা সম্ভব হবে। সর্বোপরি ট্যুরিস্ট-¯পটগুলোতে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। কয়েকটি ¯পট বাদে এ ক্ষেত্রে আমরা খুবই পিছিয়ে।
পর্যটন খাতের জন্য দক্ষ ও প্রশিক্ষিত গাইড তৈরি করা খুবই জরুরি। যারা বাংলা ভাষার পাশাপাশি ইংরেজিতেও দক্ষ হবেন, কৌশলী হবেন। বিদেশিদের আস্থা অর্জন করতে পারবেন। এ-জন্য পর্যাপ্ত ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা নিতে হবে। বিদেশিদের জন্য আমরা আলাদা জোন করতে পারি। সেখানে আবাসিক ব্যবস্থা, বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে বিদেশিরা যেমন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে তেমনই বিপুল পরিমাণ খরচ করবে তারা। এতে আমরাই লাভবান হব। ভারতে দেখেছি ট্রেনে বিদেশিদের জন্য আলাদা টিকিটের ব্যবস্থা আছে। আমরাও তা করতে পারি। রেলসুবিধা বাড়াতে হবে যাতে বিদেশিরা আরামদায়ক যাতায়াত করতে পারেন। যেসব পর্যটন এলাকাগুলোতে রেললাইন নেই সেখানে রেললাইন সম্প্রসারণ করতে হবে। বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে জাতীয় পরিকল্পনায় পর্যটন শিল্পকে অগ্রাধিকার প্রদান, জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ রাখা, ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, স্পটভিত্তিক বিশেষ পর্যটন-পুলিশ গড়ে তোলা, পরিকল্পিত প্রচারণা চালানো, দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা এবং পরিকল্পিত বিনিয়োগ প্রয়োজন বলে মনে করি। সুষ্ঠু-পরিকল্পনা গ্রহণ করে বাংলাদেশও পর্যটন খাত থেকে প্রচুর আয় করতে পারবে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা বা মালদ্বীপ পর্যটন খাত থেকে অনেক আয় করে থাকে। এসব দেশের বিভিন্ন উদ্যোগ অনুসরণ করে আমাদের দেশে উদ্যোগ নিয়ে বা স্থানিক চাহিদার ভিত্তিতে রূপান্তর করে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, যানবাহনগুলোতে সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে আমরা বিদেশি পর্যটক আকর্ষণ করতে পারি। সোশ্যাল মিডিয়াতে বা অনলাইন/ গণমাধ্যম বা দূতাবাসের মাধ্যমে আমাদের পর্যটন এলাকা নিয়ে তৈরি লিফলেট, প্রামাণ্যচিত্র, ভিডিও ইত্যাদি গৃহীত প্রচার-উদ্যোগ গ্রহণ করে বিশ্বদরবারে তুলে ধরতে পারি।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক
abuafzalsaleh@gmail.com