সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:২৭ অপরাহ্ন
মুফতি সাদেকুর রহমান:
মহান আল্লাহ মানুষকে এ ধরায় অল্প সময়ের জন্য প্রেরণ করেছেন। তিনি আমাদের পরীক্ষা করবেন, আমরা দুনিয়ার চাকচিক্য, রূপ-সৌন্দর্য ও ধন-সম্পদের মোহে পড়ে মহান প্রতিপালককে ভুলে যাই, নাকি এগুলোকে উপকরণ গণ্য করে মনে করে প্রকৃত সুখ-শান্তি ও সফলতা অর্জনে ব্রতী হই। তার মনোনীত পথে জীবন পরিচালিত করি।
আমরা জানি, সন্তান-সন্তুতি মহান আল্লাহর দেওয়া মহান নেয়ামত ও আমানত। এটা যে কত বড় নেয়ামত, নিঃসন্তান মা-বাবা গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। সম্পদের প্রাচুর্যে পূর্ণ একটি পরিবার, তবুও তারা বিষণœ। কারণ তাদের কোল উজ্জ্বল করেনি কোনো ফুটফুটে শিশুর হাসি। আল্লাহ যাকে দান করেন সে-ই শুধু এ নেয়ামতের অধিকারী হতে পারে। ইরশাদ হয়েছে, ‘নভোম-ল ও ভূম-লের রাজত্ব আল্লাহরই। তিনি যা চান সৃষ্টি করেন। যাকে চান কন্যা দেন এবং যাকে চান পুত্র দেন। অথবা দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই। আবার যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।’ সুরা শুরা : ৪৯-৫০
যে ব্যক্তি আমানতের খেয়ানত করে সবাই তাকে তিরস্কার করে। তাকে অপছন্দ করে। সমাজের কাছে সে ঘৃণার পাত্র হয়। ঠিক তেমনিভাবে আল্লাহর দেওয়া এই আমানতকে (সন্তান) যদি যথাযথ হেফাজত না করি, আল্লাহর বাতলানো পথে তার জীবনকে গড়ে না তুলি, তাহলে লাঞ্ছনা ও অপদস্থের শিকার হতে হবে। উভয় জাহানে এজন্য বড় খেসারত দিতে হবে। দুনিয়ায় সন্তানকে কোরআন না শিখিয়ে, তার অন্তরে আল্লাহ ও তার রাসুলের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা বদ্ধমূল না করে, আল্লাহর আনুগত্যশীল বান্দা হিসেবে না গড়ে শুধু জাগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করলে পরকালে মুক্তি পাওয়া যাবে না। দুনিয়াতেও এজন্য ভোগ করতে হবে লাঞ্ছনাকর পরিস্থিতি।
সোশ্যাল মিডিয়া ও গণ্যমাধ্যমে মাঝেমধ্যে এমন হৃদয়বিদারক কিছু ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে। ওইসব ঘটনায় দেখা যায়, অনেক বাবা সরকারি উচ্চপদস্থ চাকরিজীবী ছিলেন, সারা জীবন জমানো সব সম্পদ আদরের সন্তানের জন্য অকাতরে খরচ করেছেন। তাদের শিক্ষিত করেছেন, বিভিন্ন উন্নত রাষ্ট্রে পাঠিয়ে বড় বড় ডিগ্রি অর্জনের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু বার্ধক্যে এসে যখন বাবা-মায়ের সন্তানের সেবার প্রয়োজন দেখা দেয়, আদুরে নাতি-নাতনির সঙ্গে খেলা করে নিজেকে প্রাণবন্ত রাখার প্রয়োজন হয় তখন আর তাদের নাগাল পাওয়া যায় না। সন্তানরা মা-বাবার খোঁজখবর নেন না। অনেক সময় তাদের ঠাঁই হয় বৃদ্ধাশ্রমে। এভাবেই অযতেœ-অবহেলায় তাদের জীবন অতিবাহিত হয়। অনেকেই এমন জীবন সইতে না পেরে আত্মহত্যার মাধ্যমে জীবনের ইতি টানেন। কেউবা অব্যক্ত বেদনায় ছটফট করতে করতে ইহকাল ত্যাগ করেন।
কিন্তু ইহকাল ত্যাগ করলেই তারা পার পেয়ে যাবেন এমন নয়। পরকালে তাদের সম্মুখীন হতে হবে মহান প্রতিপালকের কঠিন জবাবদিহির। সেখানে অপেক্ষা করছে তাদের জন্য মর্মন্তুদ শাস্তি ও ভয়াবহ পরিণতি। কারণ যে বাবা-মা তার সন্তানকে কোরআন শেখায় না, দ্বীন শেখায় না ফলে সে বিপথগামী হয়। ভুল পথে পরিচালিত হয়। জাহান্নামের ইন্ধন হয়। সেই সন্তান কাল কেয়ামতে মহান আল্লাহর আদালতে তাদের বিরুদ্ধে নালিশ করবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘সেদিন তাদের মুখমণ্ডল আগুনে ওলট-পালট করা হবে। সেদিন তারা বলবে, হায়! আমরা যদি আল্লাহকে মানতাম ও রাসুলকে মানতাম। তারা আরও বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক আমরা আমাদের নেতা এবং অভিভাবকদের আনুগত্য করেছিলাম, তারা আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল। হে আমাদের প্রতিপালক! তাদের দ্বিগুণ শাস্তি দাও এবং তাদের বড় অভিশাপ দাও।’ সুরা আহজাব : ৬৬-৬৭
হজরত রাসুলে করিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘শুনে রাখো, তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। …পুরুষ তার পরিবারের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। তাকে সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। নারী তার পরিবার, সন্তান-সন্ততির বিষয়ে দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। …জেনে রাখো, প্রত্যেক ব্যক্তিই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই তার অধীনস্থদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে।’ বোখারি : ৭১৩৮
অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহতায়ালা যদি বান্দাকে কারও দায়িত্বশীল বানান আর সে নিজ অধীনস্থদের কল্যাণের ব্যাপারে যতœশীল না হয়, তাহলে সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না।’ সহিহ বোখারি ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে নামিবিয়া ছিল জার্মান ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে। তখন দখলদার জার্মান সেনাবাহিনী দুবার অভিযান চালিয়ে হত্যা করে প্রায় এক লাখ নিরীহ আদিবাসীকে। যারা ছিল মূলত নামিবিয়ার হেরেরো, সান ও নামা সম্প্রদায়ের। স্বাধীনতাকামী এ দুই সম্প্রদায়কে বিলীন করে দেওয়া এই হত্যাকাণ্ড ২০ শতকের ‘বিস্মৃত গণহত্যার’ স্বীকৃতি পায়। লিখেছেন নাসরিন শওকত: ৭১৫০
নবী করিম (সা.) আরও বলেন, ‘সৎ শিক্ষার চেয়ে উত্তম কোনো কিছুই কোনো মা-বাবা তার সন্তানের জন্য রেখে যায় না।’ সুনানে তিরমিজি : ১৯৫২
তাই আমাদের সন্তান কোন পথে অগ্রসর হচ্ছে, প্রত্যেককেই সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। বিশেষ করে যেসব মা-বাবা সন্তানদের নিয়ে প্রবাস জীবনযাপন করছেন। সে দেশের নাগরিকত্ব লাভ করেছেন। তাদের বিষয়টি অধিক বিবেচনায় নিতে হবে। গভীর পর্যবেক্ষণ করতে হবে, সন্তান কোন পথে অগ্রসর হচ্ছে তার গতি ঠিক আছে কি না? কোরআন শরিফ কতটুকু বিশুদ্ধভাবে শিখেছে? তার দিলের গভীরে আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস কতটা বদ্ধমূল হয়েছে? নাকি সে দেশের কৃষ্টিকালচার তার দিলে রেখাপাত করে নিচ্ছে। ভুলে যাচ্ছে সে যে একজন মুসলিম ও পরকালের যাত্রী। শুধু নিজের সন্তানকে দ্বীন শেখানোই যথেষ্ট নয়। বরং তাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্যও দ্বীন শেখার পর্যাপ্ত ও সুন্দর ব্যবস্থা করে যেতে হবে। অন্যথায় কেউ আল্লাহর পাকড়াও থেকে রেহাই পাবে না।
ভয়েস/আআ