মঙ্গলবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৩২ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

যে ফুল কখনো ফোটে না!

মোরশেদুল আলম মহব্বত:

আমি প্রতিনিয়ত দুই রকমের বাস্তবতার সম্মুখীন হই। প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠার পর আমার চার বছরের ছেলেকে দাঁত ব্রাশ করতে সাহায্য করি, এরপর একসঙ্গে বার্নিশ করা চেয়ারে বসে সকালের নাস্তা সেরে অফিস যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হই। এই যে বাসা থেকে বের হই, এরপর যা দেখি তা আমাকে মুহূর্তেই বিপরীতমুখী বাস্তবতার মুখোমুখি করে। ছোট ছোট ফুলের দল ভিক্ষা মাঙছে। সঙ্গে থাকা তাদের বাবা-মা কিংবা অভিভাবক সেসব ফুল প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই ঝরে যেতে বাধ্য করছে। এর মধ্যে সদ্যোজাত অনেক শিশু কোলে নিয়ে ভিক্ষা করা হয়, তারা খাবারের জন্য অবিরত কাঁদতে থাকে।

প্রতিদিন আমি একই চিত্র দেখি। নতুন বছর আসে, আমরা ঈদ ও অন্যান্য অনুষ্ঠান উদযাপন করি, কিন্তু এই অসহায় শিশুদের জীবনে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আসে না। একদিকে, আমরা অতীতের চেয়ে আরও আড়ম্বরপূর্ণভাবে বিভিন্ন উৎসব উদযাপন করি, অন্যদিকে এই নিষ্পাপ শিশুগুলোর সঙ্গে অন্যায় ও অনাচার চলতে থাকে। যখন এই শিশুদের পাশ দিয়ে হেঁটে যাই, তখন সমাজের এই নিষ্ঠুর বাস্তবতা ও উদাসীনতার জন্য নিজের ভেতর এক ধরনের অপরাধবোধ তৈরি হয়।

এই শিশুদের দেখে আমার শাহেদ আলীর গল্প ‘জিবরাইলের ডানা’র নবীর কথা মনে পড়ে। মাত্র আট বছর বয়সে মা বিড়ির কারখানায় ভর্তি করে দিয়েছে। যে বয়সে আকাশে ঘুড়ি ওড়ানোর কথা সে বয়সে দুঃসহ বাস্তবতার সম্মুখীন। চোখে স্বপ্ন আছে, মনে আশা আছে, কিন্তু জীবন নবীকে সুযোগ দেয়নি। দিয়েছে শুধু এমন এক ঘর যার মধ্যে রোদ-বৃষ্টি আর হাওয়ার অবারিত যাতায়াত। নবীর ঘরের টিনের সুরাখ দিয়ে নীল আসমান দেখা যায়, স্বপ্নগুলো ঐ ফাঁক দিয়ে উড়ে যায়, বাস্তব রূপ আর নেয় না।

এই নবীর মতো রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য বড় শহরে হাজার হাজার শিশু আছে যাদের আমরা টোকাই, ছিন্নমূল বা ভাসমান শিশু হিসেবে চিনি। এই শিশুরা প্রতিদিনই অমানবিক আচরণের শিকার হচ্ছে এবং দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। একটি শিশুর যত ধরনের অধিকার পাওয়ার কথা সেগুলোর কোনোটাই এরা পায় না। প্রতি পদে পদে বঞ্চনার শিকার হয় এই কোমলমতি শিশুরা।

দেশে ছিন্নমূল বা ভাসমান শিশুর সংখ্যা কত, এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, দেশে প্রায় ১৬ লাখ পথশিশু রয়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৪,৫০,০০০ পথশিশু ঢাকায় বসবাস করে। এই শিশুরা সরকার কর্র্তৃক বাস্তবায়িত কোনো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় (সোশ্যাল সেফটি নেট) আসে না, বরং এরা প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে এবং রাস্তায় প্রকাশ্যে ভিক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছে। কারও কিছু যায় আসে না না ওই শিশুটির খুব কাছে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ, না আমার মতো পথচারী যারা দিনে দিনে আরও অনুভূতিহীন, মানসিকভাবে অবশ হয়ে যাচ্ছে!

পথশিশুদের এমন করুণ পরিস্থিতি দেখে কিছু প্রশ্ন মনে আসে। প্রথমত, আমরা কি সত্যিই শিশু অধিকারের বিষয়ে আন্তরিক? কেন এই শিশুরা শৈশবের আনন্দ উপভোগ না করে রাস্তায় পড়ে আছে, ভিক্ষা করছে? যে বয়সে ঘুড়ি ওড়ানোর কথা তখন রাস্তায় কেন চেয়েচিন্তে তাদের বাঁচতে হচ্ছে? এই বাচ্চাদের বাবা-মা কোথায়? কেন অভিভাবকদের জবাবদিহির আওতায় আনা হচ্ছে না এবং শিশুশ্রমে বাধ্য করার জন্য শাস্তি পেতে হচ্ছে না? এই পরিস্থিতিতে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা কী?

আসলে সমাজ হিসেবে আমরা ভয়ানকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট এবং ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতিদিন এই শিশুদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অন্যায়গুলো দেখেও না দেখার চেষ্টা করি। অথচ প্রতিনিয়ত এই শিশুরা যৌন হয়রানি, অমানবিক আচরণ, মাদকের অপব্যবহার ও অন্যান্য আরও অনেক ধরনের অন্যায় সহ্য করছে। বিভিন্নভাবে নিপীড়িত হচ্ছে। দেখার কেউ নেই। ওই নবীর মতো শিশুরা প্রতিনিয়ত স্বপ্ন দেখে কোনো একদিন সুপারম্যান আসবে, আর রক্ষা করে নিয়ে যাবে এমন এক পৃথিবীতে যেখানে শৈশব হবে আনন্দময়। কিন্তু, ঐ দিন আসে না, আসে শুধু টিনের ফাঁক দিয়ে সূর্যের প্রখর আলো। মুহূর্তেই স্বপ্নের আসমান থেকে ফেলে দেয় বাস্তবতার কশাঘাতে।

এই পরিস্থিতির একটি বড় কারণ আমাদের সামাজিক কাঠামো ও সমাজের উদাসীনতা। ছোটবেলা থেকেই আমাদের সামাজিকভাবে পিতামাতাকে প্রশ্নবিদ্ধ না করার জন্য প্রোগ্রামিং করা হয়। আমাদের এটা বিশ্বাস করতে বাধ্য করা হয় যে, বাবা-মা যা করবে তাই ঠিক। অথচ আমরা কেউ ভুলের ঊর্ধ্বে না। গণমাধ্যমেও পথশিশুদের কষ্টের খবর তেমন আসে না, বা গুরুত্ব পায় না। সমাজের এমন উদাসীনতা বিভিন্ন চক্র ও দায়িত্বজ্ঞানহীন অভিভাবকদের জন্য শিশুদের বিভিন্ন অবৈধ ও অমানবিক উপায়ে অপব্যবহার করার মাধ্যমে দ্রুত অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে উৎসাহ জোগায়।

এছাড়া, রাষ্ট্র ও সরকারের সদিচ্ছার অভাব আছে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মতো অন্যান্য দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান পথশিশুদের অধিকার নিয়ে যথেষ্ট সোচ্চার না। আমরা যখন শিশু অধিকারের কথা বলি তখন আমরা আসলে কী বোঝাই? এই শিশুরা কি সেই অধিকারের আওতার মধ্যে পড়ে না? বাস্তবে এই সরকারি সংস্থাগুলো এই বিষয়ে নিছক উদাসীনতা দেখায়, যার কারণে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নাকের ডগায় শিশুরা বিভিন্ন নিপীড়নমূলক আচরণের শিকার হচ্ছে।

এই সংকট উত্তরণে সমাজের প্রচলিত রীতিগুলোকে প্রশ্ন করা শিখতে হবে। যদিও সহজ কথা যায় না বলা সহজ করে, তবুও বলতে হয় অন্তত বলার চেষ্টা করতে হয় : যদি আমার একটি বাচ্চাকে বড় করার মতো সামাজিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা না থাকে, তাহলে কেন আমরা একটি শিশুর জীবনকে চরম দুর্দশা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেব? প্রথমে একটি সন্তানের ভরণপোষণ পালন করার মতো অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করার জন্য পরিশ্রম করতে হবে। যখন আমি নিজের সন্তানের জন্য একটি সুন্দর শৈশব উপহার দেওয়ার মতো পর্যায়ে পৌঁছাতে পারব, তখন সন্তান গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারও জীবন নিয়ে খেলা করার বা একজন নবজাতকের জীবনকে বিপন্ন করার অধিকার কারও নেই। এটাই স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য যে শিশুরা ভুল করবে, কিন্তু একজন প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে আপনি ভুল করে সন্তান জন্ম দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না।

এছাড়া, রাষ্ট্রকে এক্ষেত্রে আরও দায়িত্বশীল আচরণ ও মনোভাব প্রদর্শন করতে হবে। যেসব পিতামাতা, অভিভাবক কিংবা চক্র শিশুদের পণ্য বানিয়ে তাদের দিয়ে ভিক্ষা করাচ্ছে, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। এটি মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিত। প্রয়োজনে সরকারকে সেই পরিবারের জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করতে হবে যেন শিশুদের রাস্তায় পড়ে থাকতে না হয়। শিশু নিপীড়নের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীল নীতি গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি, সরকার এমন দুর্ভাগা পথশিশুদের জন্য আলাদা উন্নয়ন প্রকল্প (চাইল্ড হোম) গ্রহণ করতে পারে, যেখানে ভাসমান শিশুদের জন্য সব ধরনের সুবিধা থাকবে।

রাস্তায় পড়ে থাকা এই শিশুরা অনেকটা গ্যাস্ট্রোডিয়া কুরোশিমেনসিস উদ্ভিদের মতো। জাপানের একদল গবেষক ২০১৬ সালে কুরোশিমা দ্বীপে এক ধরনের উদ্ভিদ আবিষ্কার করেন যা দেখতে খুব সুন্দর, কিন্তু এই উদ্ভিদের ফুল কখনো ফোটে না। পথশিশুরা এই ফুলের মতো যার ঘ্রাণ আছে, মায়া আছে, কিন্তু কখনো ফোটে না। কারণ ফুল ফোটার জন্য যে আলোর ঝলকানি ও উপযুক্ত পরিবেশ প্রয়োজন সেটা ওরা কখনো পায় না। অযতেœ অবহেলায় এই ফুল একসময় মরে যায়, দেখতে বীভৎস হয়ে যায়, ধরতে গেলে ব্যথা পাওয়া যায়। এ কারণেই পথশিশুরা এক সময় জড়িয়ে পড়ে বেআইনি ও অনৈতিক কার্যক্রমে।

এ দায় আমাদের, এই সমাজ ও রাষ্ট্রকে নিতে হবে। সব শিশু যেন ফুলের মতো ফুটতে পারে এবং একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ পেতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্য যা যা করা দরকার তা করার দায়িত্ব আমাদের সবার। শুধু নিজের সন্তানের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার যে স্বার্থপর স্বপ্ন এই মোহ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।

লেখক: কলামিস্ট

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION