শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ১১:০৯ অপরাহ্ন
ড. মো. আলতাফ হোসেন:
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় নাগরিকের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক যুক্তিগ্রাহ্য, মানবিক ও শ্রেয়তর করার অব্যাহত প্রচেষ্টার মধ্যেই নিহিত আছে সভ্যতার উৎকর্ষ সাধনে মানুষের চিরকালীন আকাক্সক্ষা। জনমানসে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে নাগরিকতাবোধ, জনমনে ক্রমশ দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে সার্বভৌমত্বের ধারণা। আইন, বিচার ও শাসন বিভাগের পাশে যুক্ত হয়েছে গণমাধ্যম; যা গণতান্ত্রিক অনুশীলনের সংস্কৃতিতে যুক্ত করেছে নতুন মাত্রা, নতুন গতি।
গণমাধ্যম সমাজের দর্পণ। আধুনিক সমাজ জীবনের প্রতিটি স্তরেই গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান যার মাধ্যমে আমরা জানার পরিধিকে প্রতিনিয়তই প্রসারিত করতে পারি। গণমাধ্যমের মাধ্যমেই আমরা আমাদের চারপাশে কী ঘটছে জানার সুযোগ পাই, অজানাকে জানতে পারি। আবার এই গণমাধ্যমের সুবাদেই আমরা এমন সব বিনোদন আয়োজন উপভোগ করতে পারি, এমন সব অনুষ্ঠান সরাসরি দেখতে পারি বা জানতে পারি, যা গণমাধ্যমের অনুপস্থিতিতে সম্ভব হতো না। কিন্তু গণমাধ্যমের ভূমিকা বা ব্যবহার এখানেই শেষ নয়। গণমাধ্যম আমাদের তথ্য সমৃদ্ধ করে। যারা যত বেশি তথ্যসমৃদ্ধ, তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে তত বেশি সক্ষম। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও জাতি সব ক্ষেত্রেই তা সমভাবে প্রযোজ্য। সেজন্যই বলা হয়ে থাকে Information is for enrichment process। আর এই ইনফরমেশন বা তথ্য আমরা পাই গণমাধ্যম থেকে এবং এভাবেই গণমাধ্যম সমাজ জীবনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সামাজিক মূল্যবোধ, ঐতিহ্য, আচার-আচরণ তথা সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে।
একটি উন্নয়নশীল গণতন্ত্রকামী সমাজে অবাধ, স্বাধীন ও শক্তিশালী গণমাধ্যম বিবেচিত হয় কর্নারস্টোন বা ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে। গণমাধ্যমের ভূমিকা ও এর প্রভাব পরিধি সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলছে। আজ যাবতীয় যোগাযোগ উপায় বা কমিউনিকেশন টুলগুলোও মিডিয়া বা গণমাধ্যমের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত। এ তালিকায় আছে মুদ্রিত সংবাদপত্র, ইলেকট্রনিক সংবাদপত্র, সাময়িকী, বেতার, টেলিভিশন, সংবাদ সংস্থা, ব্লগ, ওয়েবপোর্টালসহ আরও কত কী! চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৮ সালের জুনে মোট নিবন্ধিত পত্রপত্রিকা ছিল ৩০৬১টি। সর্বশেষ ২১ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে নিবন্ধিত পত্রপত্রিকার সংখ্যা ৩২১০টি (অনলাইন গণমাধ্যম ছাড়া) যার মধ্যে ১৩৫৭টি ঢাকা থেকে এবং ১৮৫৩টি অন্যান্য জেলা থেকে প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে দৈনিক পত্রিকা ১৩০৯টি, অর্ধ-সাপ্তাহিক ৩টি, সাপ্তাহিক ১২১৪টি, পাক্ষিক ২১৬টি, মাসিক ৪২৫টি, দ্বিমাসিক ৮টি, ত্রৈমাসিক ৩০টি, চতুর্মাসিক ১টি, ষাণ¥াসিক ২টি এবং বার্ষিক রয়েছে ২টি। বাংলাদেশে ক্রমাগতভাবে গণমাধ্যমের বিকাশ লক্ষ করা যাচ্ছে এবং প্রচার সংখ্যাও আকাশছোঁয়া। বর্তমানে দেশে সরকারি ৪টি টিভি চ্যানেল রয়েছে। এছাড়াও বেসরকারি ৩০টি টিভি চ্যানেল রয়েছে। বাংলাদেশ বেতার সারা দেশে ১৪টি আঞ্চলিক পর্যায় থেকেও বেতার সম্প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
গণমাধ্যম গণযোগাযোগের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। বর্তমান সময়ে গণমাধ্যম একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। গণমাধ্যম সমাজের সব স্তরের মানুষের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। বলা হয়ে থাকে, Man extends himself through Media। এমনকি মানুষের সাধারণ আচরণ, ব্যবহার, পারস্পরিক সম্পর্কের মাত্রা কেমন হবে সেটিও মিডিয়া ঠিক করে দিচ্ছে। আর এ কারণেই জনজীবনে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম। গণমাধ্যম শুধু তথ্য সরবরাহ করে না; কখনো কখনো নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, ধ্যান-ধারণা ব্যাখ্যাসহ মতামতও প্রকাশ করে। তাই গণমাধ্যমগুলোর উচিত সুস্পষ্ট, বস্তুনিষ্ঠ সত্য ঘটনা জনসম্মুখে প্রকাশ করা। মূলত সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনে গণমাধ্যম যেমন গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে ঠিক তেমনি গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভুল তথ্যের জন্য পারমাণবিক বোমার চেয়েও বেশি ক্ষতি হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, হলুদ সাংবাদিকতাই ১৮৯৮ সালের স্প্যানিশ-আমেরিকান রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের জন্ম দিয়েছিল। ১৮৯৮ সালে সংঘটিত স্পেন ও আমেরিকার মধ্যে এ যুদ্ধ আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাসে একটি মাইলফলক।
দেশের গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থেই বিচার বিভাগ ও সংবাদ মাধ্যম এই দুই গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। স্বাধীন বিচার বিভাগ ও স্বাধীন গণমাধ্যম উভয়ই জনগণের সাংবিধানিক অধিকার। এ দুই প্রতিষ্ঠান একে অপরের রক্ষা কবচ। আমাদের সংবিধান ৩৯(২)(খ) অনুচ্ছেদে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার যে নিশ্চয়তা দিয়েছে, তা রক্ষার জন্য সংবিধানের ৪৪ ও ১০২ অনুচ্ছেদে আমাদের সুপ্রিম কোর্টকেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিকাশে সংবাদপত্র নতুন যুগের সূচনা ঘটায়। মানুষের ভাবনা, চিন্তা, ধর্ম, রাজনীতি, আদর্শের বাহনে পরিণত হয় গণমাধ্যম। এখানে ‘মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ নতুন ব্যঞ্জনা লাভ করে। ঔপনিবেশিক আমল এমনকি দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সংবাদপত্রে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের প্রাধান্য সুস্পষ্ট ছিল। তবে এ কথাও সত্য যে, সরকার বা সরকারবিরোধী মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা বা জনমত সংগঠনে সংবাদপত্রের প্রচ্ছন্ন বা প্রবল ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রে যুগ নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করেছে।
একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা কতটা গণতান্ত্রিক, কতটা বিরুদ্ধমত সহনীয়, তা পরিমাপের মাপকাঠি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। সমালোচনা বন্ধ হলে গণতন্ত্র সৌন্দর্য হারাবে, বিকল্প তথ্যপ্রবাহ চালু হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সামরিক, ধর্মভিত্তিক এমনকি গণতান্ত্রিক সরকারও কখনো কখনো মুক্তচিন্তার প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করেছে। অগণতান্ত্রিক চিন্তার বিকাশকে উৎসাহিত করেছে, ফ্যাসিস্ট শক্তিকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে।
আবার তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের অকল্পনীয় উন্নতির ফলে সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল ও রেডিওর মতো গতানুগতিক সংবাদমাধ্যমের পাশে জায়গা দখল করে নিয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। ডিজিটাল সংস্কৃতিতে যে কোনো মানুষ নিজের মতামত একটি কম্পিউটার এবং ইন্টারনেটের সাহায্যে প্রকাশ করতে পারে। মাঝে-মধ্যেই ফেক নিউজ তাই আলোচ্য হয়ে উঠছে। সামাজিক মাধ্যমের নেতিবাচক এ শক্তি সমাজের ওপর ভয়ংকর প্রভাব ফেলতে পারে। যা পক্ষপাতদুষ্ট রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা সহজ হয়ে যায়। সে কারণে প্রিন্ট হোক বা ইলেক্ট্রনিক কিংবা ডিজিটাল যে মাধ্যম সংবাদ পরিবেশন করে তার ওপরই সজাগ থাকার দায় বর্তায়।
লেখক : খ-কালীন সহকারী অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।