বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ০২:০৭ অপরাহ্ন
ভয়েস নিউজ ডেস্ক:
মাঠ দাপিয়ে জেলে ফখরুল:
চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে বিএনপিকে এগিয়ে নিচ্ছিলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দলের মুখপাত্র হিসেবে সারা দেশে ব্যাপক সাড়া ফেলছিলেন। সরকার তাকে কারাগারে পাঠিয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে এসব কথা জানান বিএনপির একাধিক নেতা।
নেতারা বলেন, দলের চেয়ারপারসন ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে মির্জা ফখরুল সারা দেশে বিভাগীয় সমাবেশ-সফর করে দলকে চাঙ্গা করেন। গত ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর গোলাপবাগে অনুষ্ঠিত ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশের আগে ৮ ডিসেম্বর তাকে উত্তরার বাসভবন থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গভীর রাতে আটক করে মিন্টো রোডের অফিসে নিয়ে যান। ৯ ডিসেম্বর তার জামিন বাতিল করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। বিএনপি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তার মুক্তি দাবি করে। এরপর চার দফা আদালতে জামিনের আবেদন করে ব্যর্থ হন দলের আইনজীবীরা। বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার জানান, তার বিরুদ্ধে ৮১টি মামলা রয়েছে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত দপ্তর সম্পাদক ও ময়মনসিংহ বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স গতকাল বলেন, ‘মহাসচিবের মুক্তির দাবিতে আমরা রাজপথে কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করে আমাদের মহাসচিব যখন সবার প্রিয় হয়ে উঠেছেন, তখন তাকে থামিয়ে দিতে সরকার মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগারে নিয়েছে। তবে তাকে জনগণের হৃদয় থেকে মুছে ফেলতে পারবে না।’
বিএনপি নেতারা বলেন, দল পরিচালনার পাশাপাশি মির্জা ফখরুল ঢাকায় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার ও মিশনপ্রধানরা সাক্ষাৎ করতে এলে তাতেও নেতৃত্ব দিয়েছেন। দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে প্রধান অতিথি হিসেবে অংশ নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যেরও জবাব দিয়েছেন তিনি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা প্রায়ই প্রশ্ন করেন বিএনপির পরবর্তী নেতা কে?
দলটির নেতারা বলছেন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আমাদের নেতা। তাদের অনুপস্থিতিতে মহাসচিব মির্জা ফখরুলই আমাদের নেতা হিসেবে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারা দেশে তিনশো আসনে ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে দলীয় যে মনোনয়নপত্র দেওয়া হয়েছিল তাতে স্বাক্ষর করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল তাকে। সরকার পতনের পর যে নির্বাচন হবে তাতেও দলীয় মনোনয়নপত্রে স্বাক্ষর করবেন তিনি।
মির্জা ফখরুল ১৯৯১ সালের পঞ্চম ও ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঠাকুরগাঁও-১ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়নে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ প্রার্থী খাদেমুল ইসলামের কাছে পরাজিত হন। ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একই আসনে বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে আওয়ামী লীগের রমেশ চন্দ্র সেনকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। একই বছর নভেম্বরে বিএনপি সরকার গঠন করলে খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় মন্ত্রিসভায় প্রথমে কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও পরে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান। ২০০৬ সালের অক্টোবরে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগপর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। তখন তিনি বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। এরপর দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব নির্বাচিত হন। ২০১১ সালের মার্চে দলের মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেনের মৃত্যুর পর তিনি ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হন। ২০১৬ সালে দলের ষষ্ঠ কাউন্সিলে মহাসচিব নির্বাচিত হন।
বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, দলের মহাসচিব নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তার বিরুদ্ধে অনিয়মের কোনো অভিযোগ ওঠেনি। দেশ-বিদেশে একজন পরিচ্ছন্ন রাজনীতিক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে মির্জা ফখরুল বিএনপিতে নিজের নেতৃত্ব যেমন প্রতিষ্ঠিত করেছেন তেমনি জনপ্রিয় হয়েছেন। সারা দেশে বিএনপির চলমান আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। তার নেতৃত্বে বিএনপির নেতাকর্মীরা ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠেছে। বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে জনসমাগমের রেকর্ড হয়েছে। সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেওয়া, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি প্রভৃতি দাবিতে সফলতা আশা করছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা।
তারা বলেন, দলে যে অবস্থানে মির্জা ফখরুল উঠেছেন তা হঠাৎ করে হয়নি। বিভিন্ন কর্মকা-ে দলের মধ্যে সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তাকে অপছন্দ করেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে। সব গুঞ্জন উড়িয়ে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তাকে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দলীয় মনোনয়নপত্রে স্বাক্ষর দেওয়ার অনুমিত দেন। তখন আপত্তি করেননি তৎকালীন সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সে সময় ঠাকুরগাঁও-১ ও বগুড়া-৬ আসনে নির্বাচনে অংশ নেন তিনি। ঠাকুরগাঁও-১ আসনে পরাজিত হলেও বগুড়া-৬ আসন থেকে নির্বাচিত হন মির্জা ফখরুল। নির্বাচিত হলেও সংসদে যোগ দেননি। তবে দলের বাকি নির্বাচিতরা শপথ নেন। তিনি জানান, রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে তিনি শপথ নেননি।
বিএনপির এক বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সর্বোচ্চ ব্যক্তি। তার নেতৃত্বে আমরা বিএনপিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। গত ১২ অক্টোবর শুরু হওয়া বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের প্রধান অতিথি করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল স্থায়ী কমিটিতে। পরে এ সিদ্ধান্ত বাতিল করে সব বিভাগীয় সমাবেশে তাকে প্রধান অতিথি করা হয়।
খালেদা জিয়ার মেজো বোন সেলিমা ইসলাম বলেন, মির্জা ফখরুল আমাদের ভাগ্নে। দলের দুর্দিনে সে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছে। প্রথমে দলের কেউ কেউ তাকে অসহযোগিতা করেছে। এখন দুই-একজন ছাড়া সব পর্যায়ের নেতাকর্মীরা তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে যাচ্ছে।
মির্জা ফখরুল-বিরোধী স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার না করার অঙ্গীকার করেন। কিন্তু এরপরও নেতাকর্মীদের ধরতে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্তদের ঘরে আটকে রাখতে শুরু করে। এমনকি ১৮ জনের মতো সংসদ সদস্য প্রার্থীকে আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়। তখন স্থায়ী কমিটির সদস্য প্রয়াত ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদসহ অনেকে নির্বাচন বর্জনের দাবি তোলেন। কেউ কেউ নির্বাচন কমিশনে গিয়ে অবস্থান নিতে পরামর্শ দেন। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত না নেওয়ায় এবং কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়ার জন্য মির্জা ফখরুলের সমালোচনা করেন নেতাকর্মীদের একটি অংশ। নির্বাচনের পর গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট করারও সমালোচনা করেন বিএনপির কিছু নেতা। মহাসচিব সব সিদ্ধান্ত দলীয়ভাবে চেয়ারপারসন দিয়েছেন বলে জানান। সর্বশেষ সংসদ থেকে পদত্যাগের বিষয়ে স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্য ভার্চুয়াল সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানালেও তাতে মির্জা ফখরুল একমত হননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, বিভাগীয় সমাবেশে অন্য নেতাদের পাঠালে বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো ঢাকা থেকে তাদের প্রতিনিধি পাঠাবে না বলে জানিয়ে দেয় বিএনপিকে। মির্জা ফখরুল প্রধান অতিথি থাকলে তারা ঢাকা থেকে রিপোর্টার পাঠানোর ও গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ প্রচার করার কথা জানায়। পরে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সব বিভাগীয় সমাবেশে মির্জা ফখরুলকে প্রধান অতিথি করার নির্দেশনা দেন। তিনি বলেন, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে বিএনপির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে আলোচনার দায়িত্ব দেওয়া হয় মির্জা ফখরুলকে। এভাবে সবকিছুর নিয়ামক হয়ে ওঠেন তিনি।
৭৫ বছর বয়সী মির্জা ফখরুল শারীরিক নানা জটিলতা নিয়ে দলের নেতৃত্বে রয়েছেন। ১৯৭২ সালে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষা ক্যাডারে ঢাকা কলেজে অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষকতায় যোগ দেন তিনি। বেশ কয়েকটি সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৮৬ সালে ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজে অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮৮ সালে এরশাদের আমলে তিনি শিক্ষা বিভাগের ডিজি ছিলেন। ১৯৮৮ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মির্জা ফখরুল পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হন। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের শেষের দিকে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। ১৯৯২ সালে তিনি বিএনপির ঠাকুরগাঁও জেলা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালে মির্জা ফখরুল যখন বিএনপির মনোনয়ন পান তখন তিনি ঠাকুরগাঁও জেলার প্রাথমিক সদস্যও ছিলেন না। চাচা বিএনপির প্রভাবশালী নেতা মির্জা গোলাম হাফিজের সুবাদে তিনি মনোনয়ন পান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) মির্জা ফখরুল ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (পরে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন) সদস্য ছিলেন এবং এসএম হল শাখার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি সংগঠনটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ছিলেন। জিয়াউর রহমান সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এসএ বারী এটি। তার ব্যক্তিগত সচিব পদে মির্জা আলমগীর দায়িত্ব পালন করেন ১৯৮২ সাল পর্যন্ত। স্বৈরাচার এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর এসএ বারী উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করলে শিক্ষকতা পেশায় ফিরে যান তিনি। নিজ জেলা শহর ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজে অর্থনীতির অধ্যাপক পদে যোগ দেন। পরে আবার রাজনীতিতে যুক্ত হন। রাজনীতিতে যোগ দিয়ে প্রথমে ঠাকুরগাঁও পৌরসভার মেয়র হন।
মির্জা ফখরুল বিবাহিত এবং দুই মেয়ের বাবা। বড় মেয়ে মির্জা শামারুহ বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবে কর্মরত। ছোট মেয়ে মির্জা সাফারুহ একটি স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। স্ত্রী রাহাত আরা বেগম বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।
পদ রক্ষার লড়াইয়ে কাদের
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে টানা দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করছেন ওবায়দুল কাদের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী তিনি। আগামীকাল ২৪ ডিসেম্বর দলের ২২তম জাতীয় সম্মেলন। আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে কে হচ্ছেন সাধারণ সম্পাদক?
সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ওবায়দুল কাদেরের নাম বেশি আলোচিত হচ্ছে। এবার হলে তৃতীয়বারেরমতো এ দায়িত্ব পাবেন তিনি। তবে তার শারীরিক অসুস্থতার ব্যাপারটিও বেশ আলোচিত। তিনি বাদ পড়তে যাচ্ছেন কি না সে সম্পর্কে কৌতূহল রয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের। সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেলেও তিনি কি তা সামলাতে পারবেন এমন প্রশ্নও ঘুরপাক খাচ্ছে তাদের মনে।
দলের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সরকারের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে ওবায়দুল কাদের দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছেন। তার মন্ত্রণালয়ের অধীনেই দেশের সবচেয়ে বড় অর্জন পদ্মা সেতু হয়েছে। বিশে^ বাংলাদেশকে সম্মানের আসনে বসিয়েছে এই সেতু।
তৃতীয়বার সাধারণ সম্পাদক হওয়ার আলোচনায় থাকলেও নানাবিধ চ্যালেঞ্জও সামনে রয়েছে ওবায়দুল কাদেরের। বড় চ্যালেঞ্জ হবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ মাঠে বিরোধী দল বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলন মোকাবিলা করা। তৃতীয় চ্যালেঞ্জ দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা। এই তিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কতটা সফল হবেন বা ব্যর্থ হলে কী সংকট সৃষ্টি হবে তা নিয়ে দলের ভেতরে-বাইরে বিস্তর আলোচনা চলছে। আলোচনা চলছে ওবায়দুল কাদের ছাড়া বিকল্প কে আছেন, তা নিয়েও।
২২তম জাতীয় সম্মেলনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদাকাক্সক্ষীরা ও তাদের অনুসারীরা তৃতীয় দফায় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দেখতে চান না ওবায়দুল কাদেরকে। ফলে ওবায়দুল কাদেরের শারীরিক অসুস্থতার বিষয়টি আলোচনায় আনা হচ্ছে। দলের একটি অংশ মনে করে, আগামী নির্বাচন সামলাতে ও আন্দোলন মোকাবিলা করতে হলে সাধারণ সম্পাদকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার পাশে সুস্থ-সবল একজন সাধারণ সম্পাদকের বিশেষ প্রয়োজন। তাতে সভাপতি কিছুটা চাপমুক্ত থাকতে পারবেন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সারা দেশ সফর করতে হবে দলের সাধারণ সম্পাদককে। কৌশলী রাজনীতি ও সিদ্ধান্তের প্রয়োজন পড়বে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি-কূটনীতি দক্ষতার সঙ্গে সামলাতে হবে দলের সভাপতির পাশাপাশি দলের সাধারণ সম্পাদককেও। আলোচনায় থাকা ওবায়দুল কাদেরের জন্য বয়স ও শারীরিক অবস্থার কারণে এসব কাজ সঠিকভাবে করে ওঠা কঠিন হবে।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকম-লীর এক সদস্য বলেন, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা-মেধা-দক্ষতায়, সর্বোপরি আওয়ামী লীগের জন্য কৌশলী একজন সাধারণ সম্পাদক সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যিনি দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারবেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ভালোভাবে সামাল দিতে পারবেন ও আন্দোলন মোকাবিলা করতে পারবেন। কৌশলগত রাজনীতিতে বিশেষ পারদর্শী হবেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় থাকায় বিভিন্ন মত-পথের ও আদর্শের লোক দলে জায়গা নিয়েছে, ব্যক্তি-অনুসারী বেড়েছে দলে। সংগঠনের বিভিন্ন স্তরে আদর্শের-স্বার্থের দ্বন্দ্ব-কোন্দল এখন চরমে। দ্বন্দ্ব ন্যূনতম মাত্রায় রাখতে সাধারণ সম্পাদকের ভূমিকা অনেক বেশি। এটি বিশেষ আমলে রাখতে হবে।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অবর্তমানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে উঠেছেন। সামনে ফখরুল আরও গুরুত্বপূর্ণ হবেন। এই সময়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমন কাউকে হতে হবে, যিনি ভাবমূর্তি সম্পন্ন হবেন এবং মির্জা ফকরুলকে মাঠের রাজনীতিতে ঘায়েল করতে পারবেন। গ্রহণযোগ্য একজন নেতাকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে বসাতে হবে।
আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আওয়ামী লীগের দায়িত্ব হাতে নিয়ে দল পরিচালনায় সফলতার যে স্বাক্ষর রেখেছেন, দলকে যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তাতে যিনিই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হবেন তাকে সবসময় ছায়া সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হবে। সৈয়দ আশরাফ দায়িত্ব পালনের সময়ে নানা সমালোচনায় পড়লেও দায়িত্ব ছাড়ার পর আওয়ামী লীগের সর্বস্তরে একটি আস্থার নাম হয়ে ওঠেন। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দলের সবাই চান একজন সৈয়দ আশরাফকে।
দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও শুভাকাক্সক্ষীরা দাবি করেন, এখন কাদেরের চেয়ে ভালো সাধারণ সম্পাদক বেছে নেওয়াও কঠিন। আর যাই হোক ওবায়দুল কাদেরের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ার আছে। তার দলের জন্য ত্যাগও আছে। একাধিকবার কারাবরণ করেছেন। রাজনীতির সুসময়-দুঃসময় দুটোই দেখেছেন কাছ থেকে। সারা দেশে পরিচিতিও আছে। তার চেয়ে বেশি জানাশোনা কম নেতারই আছে। আওয়ামী লীগের জন্য কমিটমেন্টও নেহায়েত কম নয় কাদেরের।
দলের সম্পাদকম-লীর আরেক সদস্য বলেন, আওয়ামী লীগের মতো প্রাচীন একটি দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এমন দুয়েকজনের নাম শোনা যায়, যারা দায়িত্ব পেলে রাজনীতি ছেড়ে দিতে চাইবেন অনেকে। তিনি বলেন, সভাপতিমন্ডলীর তিন জন ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদের একজন সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আলোচনায় আছেন। ওনাদের মধ্যে একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হলেও রাজনীতি-আন্দোলন ও নির্বাচন মোকাবিলা করা যাবে। এর বাইরে যারা রয়েছেন কেউই এই সময়ে সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য ফিট নন।
২০১৬ সালে দলের ২০তম সম্মেলনে প্রথমবার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান ওবায়দুল কাদের। ২০১৯ সালের মার্চে ২১তম সম্মেলনের আগে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তার শারীরিক অসুস্থতার বিষয়টি সামনে এনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এই পদে তাকে পিছিয়ে রাখতে বহু চেষ্টা করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আস্থা অর্জন করেছেন তিনিই।
১৯৭১ সালে মুজিব বাহিনীর হয়ে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলয় আহত ওবায়দুল কাদের। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর দীর্ঘ আড়াই বছর কারাগারে ছিলেন। কারাগারে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। পরের মেয়াদেও সভাপতি হন। তিন বারের সংসদ সদস্য ওবায়দুল কাদের। বর্ণাঢ্য এই রাজনীতিক ১৯৬৬ সালের ছয় দফা, ৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
১৯৭৫-পরবর্তী কঠিন সময়ের রাজনীতির অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ ওবায়দুল কাদের সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক পদ নিয়ে প্রথমে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আসেন। পরের দুটি সম্মেলনে এক নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯তম সম্মেলনে সভাপতিম-লীর সদস্য হন ওবায়দুল কাদের। ২০তম ও ২১তম সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক হন।
ওই সম্মেলনের আগেই সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা দিয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ওবায়দুল কাদেরকে ফিরিয়ে আনা হয়। বানানো হয় টানা দ্বিতীয়বারের মতো সাধারণ সম্পাদক। তবে দায়িত্ব পেলেও শারীরিক অবস্থা ও করোনা মহামারীর কারণে দেড় বছর ঘরবন্দি থাকতে হয়েছে তাকে। সড়ক, যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী হিসেবে দাপ্তরিক কাজও সেরেছেন ঘর থেকেই। এর ফলে সরকারি কাজে তেমন প্রভাব না পড়লেও সারা দেশে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রমে বিরূপ প্রভাব পড়ে; সংগঠন ঝিমিয়ে পড়ার দশায়। ঘরে বসে গণমাধ্যমে সরব থেকেছেন ওবায়দুল কাদের। প্রতিদিন গণমাধ্যমে দলের ও সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরেছেন সংবাদ সম্মেলনে।
চলতি বছরের শেষের দিকে ঘর থেকে বাইরে বের হতে শুরু করেন ওবায়দুল কাদের। দলীয় কর্মকা-ে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। তৃণমূলের সম্মেলন-বর্ধিতসভা, কর্মিসভা এসব আয়োজনে যাওয়া-আসা শুরু করেন। ঢাকার বাইরেও নিয়মিত যাতায়াত করছেন। শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে শোনা যায়। তাই নিজের শক্তি-সামর্থ্য প্রমাণ করতে আগের মতো সরব হয়ে উঠেছেন তিনি। এই নেতার ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তৃতীয়বারের মতো সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেতে আগ্রহী তিনি। অসুস্থতার কথা ভুলে দলীয় কার্যক্রমে নিয়মিত উপস্থিত থাকছেন তিনি।
ভয়েস/আআ/সূত্র: দেশ রূপান্তর।