শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:০৬ অপরাহ্ন
মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
মৃত্যু এই জগৎ সংসারের এক অবধারিত, অনিবার্য ও ধ্রুব সত্য। ‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথায় ভবে?’ জীবন-মৃত্যুর সৃষ্টিকর্তার নিজস্ব ঘোষণা, ‘ভূপৃষ্ঠের সবকিছুই ধ্বংসশীল। একমাত্র আপনার মহিমাময় ও মহানুভব পালনকর্তার সত্তা ছাড়া।’ -সুরা আর রাহমান : ২৬-২৭
‘আল্লাহতায়ালার সত্তা ছাড়া সমস্ত কিছুই ধ্বংসশীল, বিধান তো তারই এবং তারই দিকে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।’ -সুরা আল কাসাস : ৮৮
এভাবে কোরআন মাজিদে বিভিন্ন ভাবভঙ্গিমায় ১৬৪ স্থানে মৃত্যুর কথা আলোচিত হয়েছে। সেই সর্বগ্রাসী তিক্তময় সন্ধিক্ষণ। যার আগমনে সন্তান অনাথ, স্ত্রী বিধবা এবং পিতামাতা হয় নয়নমণিহারা। সে এক বিষাদ ও বিরহের মুহূর্ত! কিন্তু আফসোসের কথা হলো, মানুষ এটা থেকে একেবারে উদাসীন ও বিস্মৃত। মহান আল্লাহ বলেন, ‘প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদের মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে, যতক্ষণ না তোমরা কবরের সম্মুখীন হয়েছ। না, এ সংগত নয়। তোমরা শিগগিরই জানতে পারবে…।’ -সুরা তাকাসুর : ১-২
মৃত্যুর সত্যকে হয়তো ভুলে থাকা যায়, কিন্তু অতিক্রম করা যায় না। কোরআন মাজিদের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা, ‘প্রত্যেক প্রাণীকে আস্বাদন করতে হবে মৃত্যু। আর তোমরা কেয়ামতের দিন পরিপূর্ণ বদলা প্রাপ্ত হবে। তারপর যাকে দোজখ থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, তার কার্যসিদ্ধি ঘটবে। আর পার্থিব জীবন ধোঁকা ছাড়া অন্য কোনো সম্পদ নয়।’ -সুরা আলে ইমরান : ১৮৫
কোরআন মাজিদ আমাদের জানাচ্ছে, মৃত্যুর পর মানুষকে তার কর্মফলের মুখোমুখি হতে হবে। হিসাব দিতে হবে জীবনের সময় ও কর্মের। মৃত্যু ও পরকাল সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা কোরআন মাজিদে বারবার সচেতন করেছেন। একইসঙ্গে মানুষের চারপাশের প্রকৃতিতে স্থাপন করেছেন চিন্তাশীলতা ও বার্তা গ্রহণের অসংখ্য উপাদান। দিন-রাতের গমনাগমন, সকাল-দুপুর-বিকেলের প্রাকৃতিক পরিবর্তন, সপ্তাহ-মাস-বছরের চক্রাকার আবর্তন এই সবকিছু বারবার মানুষকে বলে যাচ্ছে তার বেলা ফুরানোর কথা। আপনার দেহ-মনের পরিবর্তন আপনাকে বার্তা দিচ্ছে। আপনার স্বজন-প্রিয়জনের চলে যাওয়া বার্তা দিয়ে যাচ্ছে আপনারও বেলা ফুরোবার। আপনি কি ভেবে দেখেছেন, মহান আল্লাহ কতবার আপনাকে বার্তা দিয়েছেন? কতভাবে দিয়েছেন? তবুও যদি ফিরে না আসেন তাহলে কীভাবে আশা করতে পারেন চিরস্থায়ী জীবনে নাজাতের?
মহান আল্লাহ বার্তা দিয়েছেন অসংখ্যবার, আপনি শোনেননি। যতদিন গেছে, না শোনার পাল্লা ভারী হয়েছে। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এসে এবার অন্তত শুনুন তার ডাক। তিনি করুণাময়, দয়ালু। তিনি অতীতের জমে ওঠা সব অমনোযোগিতা, ভ্রƒক্ষেপহীনতা এক নিমেষে ক্ষমা করে দেবেন। এমন যেন না হয় যে, তিনি শুধু ডেকেই গেলেন আর আপনি রইলেন মুখ ফিরিয়ে। আর এভাবেই আপনার আয়ু শেষ হয়ে গেল। তাহলে বুকে হাত দিয়ে বলুন, কীভাবে, কোন্ যুক্তিতে মহান আল্লাহকে দোষ দেবেন?
আপনি সব বোঝেন। অর্থোপার্জনের লসাগু-গসাগু মুখস্থ। ক্ষমতা-প্রতিপত্তির সব রসায়ন কণ্ঠস্থ। রাজনীতির সরল-জটিল সব সূত্র ঠোঁটস্থ। কূটনীতি-সমাজনীতির সূক্ষ্ম ও স্থূল সব ইঙ্গিত আয়নার মতো পরিষ্কার। এই সবকিছু বোঝেন, শুধু বোঝেন না ক্ষণস্থায়ী জীবনের সমাপ্তির বার্তা! চারপাশের আবর্তনশীল দিন-রাতের ভাষাহীন বাণী! আপনার স্রষ্টা এবং রব আল্লাহর আহ্বান ও হুঁশিয়ারি! বলুন, এই না বোঝা কি আপনার পক্ষে যথেষ্ট অজুহাত?
যদি না হয় তাহলে এবার থামুন। একান্তে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করুন। জীবনের পড়ন্ত বেলায় নিজের দিকে তাকান। গোধূলির লাল সূর্যের দিকে তাকিয়ে হিসাব করুন- তার অস্তাচলে যাওয়ার আর কতখানি বাকি! সেই সঙ্গে মৃত্যুকে স্মরণ করুন। স্মরণ করুন মৃত্যুর পরের দিনগুলোর কথা। কী হতে পারে তখন? স্বজন-প্রিয়জনেরা আপনার মৃত্যুর সংবাদে চমকে উঠবে। বেদনায় ভারাক্রান্ত হবে। কিছুদিন অশ্রু ফেলবে। এরপর সব আগের মতোই চলতে থাকবে। মাটির ওপরের এই মানুষগুলো আপনার মতোই একটা সময় পাড়ি দেবে। পৃথিবীর আলো-বাতাস গ্রহণের সুযোগ পাবে, কিন্তু আপনার কী হবে?
যে অর্থবিত্তের জন্য সকাল-সন্ধ্যা মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছেন, তা জনে জনে ভাগ করে নিয়েছে। যে ক্ষমতার জন্য নিজের ও অন্যের আরামের ঘুম হারাম করেছেন তা অন্যরা দখল করেছে। যে জ্ঞান-প্রযুক্তি নিয়ে আপনার গর্ব ছিল, যে শিল্প-সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে যুক্তির পর যুক্তি দিয়েছেন, বন্ধুদের সঙ্গে ধূমায়িত চায়ের পেয়ালা হাতে উচ্ছ্বসিত সন্ধ্যা অতিবাহিত করেছেন, সভা-সেমিনারে তত্ত্ব ও তথ্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন, আপনার জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতায় মুগ্ধ শ্রোতার করতালিতে সেমিনারকক্ষ মুখর হয়ে উঠেছে, এই সবকিছু সুখস্বপ্নের মতো কীভাবে মিলিয়ে গেল!
কবর জীবনে এসে দেখছেন সবকিছু অচেনা, অজানা। আপনার এই বাস্তব ঘর তিন হাত কবর, একেবারেই বিরান পড়ে আছে। এখানে লাগেনি বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ছোঁয়া। এখানে না আছে বিদ্যুৎ, না মোবাইল, না ইন্টারনেট। ওপরে-নিচে চারপাশে শুধু মাটি! মাটির ওপরে সারা জীবন কত কিছু করেছেন, কিন্তু মাটির নিচের আপনার নিজের এই ঘরটিকে প্রস্তুত করতে পারেননি। জীবনভর যা করেছেন সব মাটির ওপরে রেখে এসেছেন। এখন এই মাটির ঘরে যা আপনার অতি প্রয়োজন তা সঙ্গে আনতে ভুলে গেছেন।
বুকে হাত দিয়ে বলুন, তখন আপনার হাহাকার কোথায় গিয়ে পৌঁছবে? নিজেকে কেমন নিঃস্ব, অসহায় ও সর্বস্বান্ত মনে হবে? দুনিয়ার ফেলে আসা আলো-ঝলমলে জীবনটাকে কতই-না অসার প্রবঞ্চনাকর মনে হবে! আপনার চারপাশে যারা ছিল তাদের মনে হবে শঠ, প্রতারক, প্রবঞ্চক। তখন তো আপনার বুক ফেটে মারা যাওয়ার মতো অবস্থা হবে; কিন্তু না, মৃত্যু আর আসবে না!
আবারও স্মরণ করুন কোরআনে কারিমের বাণী, হ্যাঁ। এখনো সময় আছে। সৃষ্টিকর্তার ডাকে সাড়া দিন। সব মোহ-মায়া, অনুরাগ-বিরাগ, দর্প-অহংকার পুরনো কাপড়ের মতো ছুড়ে ফেলুন। পরম করুণাময়ের প্রতি সমর্পিত হোন। তার সব বাণীকে সত্য বলে মেনে নিন। তার সব আদেশ শিরোধার্য করে নতুনভাবে নিজেকে সজ্জিত করুন।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক
muftianaet@gmail.com