শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:২৬ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

আখেরাতের পথের সন্ধান

মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
প্রায় শতবর্ষ আগে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে মাওলানা ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহি ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহরানপুর এলাকায় ইসলামি দাওয়াত তথা তাবলিগের প্রবর্তন করেন। একইসঙ্গে এলাকাভিত্তিক সম্মেলন তথা ইজতেমারও আয়োজন হতে থাকে। কাজের ধারাবাহিকতায় তাবলিগ বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। দিন দিন বাড়তে থাকে তাবলিগের প্রচার-প্রসার। তাবলিগের সাথী সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ১৯৬৬ সাল থেকে টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন শুরু হয়। এর আগে খুলনা, ঢাকার রমনা পার্ক সংলগ্ন কাকরাইল মসজিদ, চট্টগ্রাম হাজি ক্যাম্প, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এবং টঙ্গীর পাগাড় এলাকায় ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়।

১৯৬৬ সালের পর থেকে প্রতি বছরই ‘কহর দরিয়া’খ্যাত তুরাগ নদীর উত্তর-পূর্ব তীর সংলগ্ন ডোবা-নালা, উঁচু-নিচু জমি মিলিয়ে রাজউকের হুকুমদখলকৃত ১৬০ একর জায়গার বিশাল মাঠে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিশ্ব ইজতেমা। বর্তমানে ইজতেমায় দেশি তাবলিগি সাথী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদেশি মেহমানের সংখ্যাও বেড়েছে। চলতি বছর শতাধিক দেশের মুসল্লি ইজতেমায় অংশ নিচ্ছেন।

২০১১ সালের আগে একসঙ্গে তিন দিনব্যাপী বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হতো। স্থান সংকট, জনদুর্ভোগ বিবেচনা, মানুষের ব্যাপক উপস্থিতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নিরাপত্তা প্রদানের নিমিত্তে তাবলিগের শুরা সদস্যদের পরামর্শের ভিত্তিতে তিন দিন করে ২ ধাপে ইজতেমা আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়।

দুই ধাপে ইজতেমা আয়োজনের পরও মানুষের ব্যাপক উপস্থিতি হওয়ায় ২০১৬ সাল থেকে প্রতি বছর ৩২ জেলার অংশগ্রহণে ২ ধাপে বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন করা হয়। এরই মধ্যে তাবলিগের কাজ পরিচালনা, নেতৃত্ব প্রদান এবং দিল্লির মাওলানা সাদের কিছু বক্তব্যকে ঘিরে তাবলিগ জামাতে মতবিরোধ দেখা দেয়। তাবলিগে দুটি ধারা সৃষ্টি হয়। একটি আলমি শুরা (বিশ্বের সব দেশের শীর্ষ মুরব্বিদের নিয়ে গঠিত পরিচালনা কমিটি) অন্যটি মাওলানা সাদের একক নেতৃত্বে পরিচালিত ধারা। এ কারণে ২০২০ সালে বিশ্ব ইজতেমা দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হয়। পরের দুই বছর করোনা মহামারীর কারণে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়নি। উল্লেখ্য, শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই তাবলিগের কাজ দুই ভাগে পরিচালিত হচ্ছে।

দাওয়াতি কাজ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামের অস্তিত্ব নির্ভর করে এর ওপর। যতদিন দ্বীনের দাওয়াত থাকবে ততদিন দ্বীন থাকবে। এই চেতনাকে ধারণ করেই হজরত ইলিয়াস (রহ.) দাওয়াতে তাবলিগের বর্তমান পদ্ধতি চালু করেন। এই পদ্ধতির দাওয়াত দ্বারা সব শ্রেণি, পেশা ও বয়সের মানুষ দ্বীন শিখতে পারছে। ইসলাম সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হচ্ছে। কোরআন মাজিদে এ কাজকে অতি উত্তম কাজ বলে অভিহিত করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমাদের মধ্যে এমন এক দল থাকা উচিত, যারা আহ্বান জানাবে সৎকর্মের প্রতি; নির্দেশ দেবে ভালো কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে, আর তারাই হলো সফলকাম।’ -সুরা আলে ইমরান : ১০৪

ইসলামের দৃষ্টিতে নিজের সংশোধন ও দ্বীনের ওপর অটল থাকার জন্য দাওয়াতের কাজ অতি জরুরি। এ লক্ষ্যেই আল্লাহর দেওয়া জানমাল ও সময় আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করার এ কাজে মুসলমানদের উদ্বুদ্ধ করতে কাজ করে তাবলিগের লোকজন। এই উদ্দেশ্য অর্জন ও বিশ্বের আনাচে-কানাচে দ্বীনের কথা পৌঁছানোর জন্য আরও বেশি লোক কাজে লাগানোর চিন্তা-ভাবনা থেকে আয়োজন করা হয় বিশ্ব ইজতেমার। বিশ্ব ইজতেমা বিশ্ববাসীর কাছে এ বার্তা পৌঁছাতে চায়, আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া মানুষের আর কোনো উদ্দেশ্য নেই; থাকতে পারে না। অন্তরের গভীর থেকে এই উপলব্ধি মোতাবেক জীবন পরিচালনার মানসে নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য এখানে আসতে হবে।

মনে রাখতে হবে, মানুষ নিজে নিজে তৈরি হয়নি, তাকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। সে নিজ ইচ্ছায় দুনিয়ায় আসেনি, আল্লাহ পাঠিয়েছেন। একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছায় সে ধনী-দরিদ্র, আরব-অনারব, নারী-পুরুষ, সুস্থ-অসুস্থ অবস্থায় দুনিয়ায় অবস্থান করছে। মানুষের জীবনের সব অবস্থা আল্লাহ প্রদত্ত। তাই মানুষকে দুনিয়ায় আগমনের লক্ষ্য অনুধাবনের পাশাপাশি আল্লাহর দেখানো পথ ও দ্বীনের ওপর চলা জরুরি। যা দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতার চাবিকাঠি। রোগে-শোকে, সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বিষাদে এক কথায় সর্বাবস্থায় দ্বীনের ওপর চলার চর্চা শেখায় তাবলিগ। দুনিয়াব্যাপী এ কাজের লোক কীভাবে আরও বাড়ানো যায় বিশ্ব ইজতেমায় সেই চিন্তা করে বেশি বেশি জামাত দেশ-দেশান্তরে পাঠানো হয়।

এক কথায়, বিশ্ব ইজতেমা হচ্ছে, মুসলমানদের জন্য আখেরাতের পথ দেখানোর, আখেরাতের কথা স্মরণ করানোর জমায়েত। ইজতেমায় দাওয়াতের কাজ করা হয়। যেসব দেশ-বিদেশের মুসল্লিরা জমায়েত হন, তারা ইসলামের আলোকে নিজেদের জীবন ও চরিত্র গঠন করেন। সেই সঙ্গে আল্লাহ ও তার প্রেরিত রাসুলের (সা.) প্রতি তাদের ভালোবাসা জন্ম নেয়। ইজতেমা শেষে অংশগ্রহণকারী মুসল্লিরা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পৃথিবীর যে দেশে মুসলমান আছে, সেখানে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার জন্য ছুটে যান।

আমরা জানি, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দ্বীনকে বোঝা এবং তা আত্মস্থ করার জন্য ইমান প্রয়োজন। ইজতেমায় আগত বরেণ্য আলেমদের বয়ান, আল্লাহর নেয়ামত ও কুদরতের বরকতি আলোচনা, দ্বীনি পরিবেশ তাবলিগের সাথীদের সেই চিন্তাকে সংহত করে ইমানকে মজবুত করে তোলে। বস্তুত ইমান হচ্ছে এমন এক অমূল্য সম্পদ, যা মানুষকে আল্লাহর দেওয়া জানমাল ও সময়কে সর্বদা আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিয়ে জীবনের আসল লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করে। ইমান হলো সেই প্রেরণা, যা শত বাধা-বিপত্তির মধ্যে আল্লাহর বিধান থেকে মানুষকে চুল পরিমাণ নড়তে দেয় না। ইমান হলো সেই প্রতিজ্ঞা আর শক্তি, যার কারণে আল্লাহর হুকুমে নিজেকে কঠিন থেকে কঠিনতর পরীক্ষায় ফেলতে মুমিন কুণ্ঠিত হয় না। ইমান যত মজবুত হবে দ্বীনের ওপর চলা তত সহজ হবে। দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতা মানুষের পদচুম্বন করবে। আল্লাহ তার ওপর সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন। একজন মুমিনের জন্য এর চেয়ে বড় সাফল্য আর কিছু নেই, থাকতে পারে না। তাবলিগের যাবতীয় কাজ ইমান লাভ ও মজবুত করার লক্ষ্যে পরিচালিত।

লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক

muftianaet@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION