বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ০১:৩৪ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

কভিড-১৯ ও অনলাইন শিক্ষা

সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ:

বিশ্বে এখন বড় আতঙ্কের নাম কভিড-১৯ বা নভেল করোনাভাইরাস। আমরা এমন একটা সময় পার করছি, যখন বাংলাদেশেও প্রতিদিনই বেড়ে চলছে আক্রান্তের সংখ্যা। অন্য সবকিছুর মতো এখন স্থবির হয়ে পড়েছে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। লাখ লাখ শিক্ষার্থী ঘরবন্দি হয়ে এক অজানা ভবিষ্যতের দিকে দিন গুনছেন। তাই বিষয়টি অনুধাবন করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া এখন সময়ের দাবি। এই মুহূর্তে দেশব্যাপী ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োগ এবং প্রয়োজনীয়তাও আমরা বিশেষভাবে উপলব্ধি করতে পারছি।

এই দুর্যোগ মুহূর্তে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম-ই হতে পারে শিক্ষার প্রধান মাধ্যম। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অনলাইন শিক্ষা বা ই-লার্নিং বা ডিসট্যান্স লার্নিং এখন বেশ প্রয়োজনীয়। ইউরোপ-আমেরিকা ছাড়াও অনেক দেশেই এখন এটি জনপ্রিয় মাধ্যম। এর সুবিধা হচ্ছে একটি স্মার্টফোনের মাধ্যমে যেকোনো স্থান থেকে শিক্ষাগ্রহণ করা যায়। ই-লার্নিংয়ের ৮০ শতাংশের বেশি পাঠকার্যক্রম ইন্টারনেটনির্ভর। তাই কোথায়ও গিয়ে পড়াশোনা করতে হয় না। ঘরে বসেই তা সম্ভব। এ ছাড়া আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ও মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে এখন অনলাইনে শিক্ষাকে আরও ‘কমিউনিকেটিভ’ করা যাচ্ছে। বিস্তারিত বললে, একজন শিক্ষার্থীর যতটা প্রয়োজন, এ অবস্থায় ঠিক ততটাই তাকে শিক্ষাদান করা সম্ভব। এর ফলে একজন শিক্ষার্থী নিজের গতিতে শিখতে পারবে, যা কি না তার জন্য অধিকতর ফলপ্রসূ হবে। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় ৫০-৬০ জনের ক্লাসে প্রতি ছাত্র ধরে ধরে শিক্ষকের দেখিয়ে দেওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স আর মেশিন লার্নিং শিক্ষার্থীভেদে যথোপযুক্ত শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারে। নিত্যনতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে পৃথিবী-বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইনস্টিটিউটগুলোও এখন অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে ডিগ্রি প্রদান করছে। বাংলাদেশ থেকেও অংশ নিয়ে অনেকেই দক্ষতানির্ভর সনদও অর্জন করছেন। এটা বেশ অগ্রসর ধাপ। তবে এই করোনা সংকটে আমাদের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় যুক্ত রাখতে এবং তাদের মানসিক সাপোর্টের জন্য অনলাইন ক্লাস-ই হতে পারে একটা কার্যকর পদ্ধতি। কেননা, মজার ছলে আনন্দ নিয়ে নিজের পড়াটা শিখতে পারবে তারা।

করোনার কারণে দেশের বেশ কয়েকটি পাবলিক পরীক্ষার সময়সূচি নিয়ে সংকট দেখা গেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর পরীক্ষা হয়তো নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ও জানাশোনার কী হবে? এ বিষয়টি তো গুরুত্বপূর্ণ। তাদের জন্য অবশ্যই পাঠ্যবইয়ের প্রতিটি অধ্যায়, অনুচ্ছেদ রপ্ত করা জরুরি। তা না হলে জ্ঞানের এই শূন্যতা জীবনভর রয়ে যাবে! তাই সক্ষমতা অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অনন্তপক্ষে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার মধ্যে রাখতে পারে। আর সে মাধ্যম হতে পারে ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার।

পৃথিবীব্যাপী দিনে দিনে শিক্ষায় প্রযুক্তি বা এডুটেকের প্রসার ঘটে চলেছে। শিক্ষাব্যবস্থায় উদ্ঘাটিত হচ্ছে অভূতপূর্ব কিছু ধারণা, তৈরি হচ্ছে নতুন কৌশল, যা জ্ঞানের ভাণ্ডার তথা বিশ্বকে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে।

উল্লেখ্য, গত ডিসেম্বরে পূর্ব এশিয়ার দেশ চীনের সমুদ্র উপকূলীয় শহর উহানে প্রথম শনাক্ত হয় নভেল করোনাভাইরাস। সেখান থেকে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল রাষ্ট্রজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ভয়ানক এই ভাইরাস, এরপর সারা বিশ্বে। এর মধ্যেই বন্ধ ঘোষণা করা হয় চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও। তবে এই বন্ধেও তারা অনলাইনে শিক্ষাকার্যক্রম অব্যাহত রাখে। চীনের উই চ্যাট বা কিউকিউয়ের মাধ্যমে এসব ক্লাসে যুক্ত হন শিক্ষার্থীরা। প্রায় আড়াই হাজার মাইল দূর থেকেও এসব ক্লাসে যুক্ত হয়েছেন বাংলাদেশি অনেক শিক্ষার্থীও। ডিসট্যান্স লার্নিংয়ের ক্ষেত্রে একেবারে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে দেশটির ঝেজিয়াং বিশ্ববিদ্যালয় (জেডজেইউ)। করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যেই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টির পাঁচ হাজারেরও বেশি কোর্স অনলাইনে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। (সূত্র : zju.edu.cn/english))। ফলে এই ই-লার্নিং পদ্ধতির আওতায় চলে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়টির সব শিক্ষার্থী। কিছু কোর্স বিশ্বব্যাপী শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ফলে বিদেশি শিক্ষার্থীরাও এ সুযোগ পান। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টির ‘কোর্স হাব’র ব্যবস্থা করে। পাশাপাশি ই-কমার্স কোম্পানি ‘আলিবাবা’র সঙ্গে চুক্তি করে তৈরি করে ‘Ding Talk ZJU নামে একটি অ্যাপ; যা প্রায় তিন লাখ মানুষের মধ্যে দ্রুত পৌঁছে যায়। তবে সমস্যা একটা থেকেই যায়, সেটা হচ্ছে এমন অনেক শিক্ষার্থী রয়েছেন, যারা প্রযুক্তি ব্যবহারে সেভাবে দক্ষ নন। এই কাতারে আছেন কিছু শিক্ষকও। তাৎক্ষণিক তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে চীনের হাংঝু এলাকায় প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টি। ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ক্লাস শুরু হয়। এর আগেই ৩ হাজার ৬৭০ জন শিক্ষককে এ বিষয়ে দক্ষ করে তোলা হয়। এমনকি এক হাজার সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীকে এই ডিসট্যান্স এডুকেশনের অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে কমমূল্যে ইন্টারনেট ব্যবহারেরও সুযোগ করে দেয় জেডজেইউ। জানা যায়, ২০১৭ সালে জেডজেইউ স্মার্ট ক্যাম্পাস তৈরির উদ্যোগ নেয়। সম্প্রতি ২০০ স্মার্ট ক্লাসরুম তৈরি করেছে; যেখানে সহজেই শিক্ষকের ক্লাসরুমে পাঠদানের ভিডিও ধারণ এবং সরাসরি অনলাইনে প্রচারের ব্যবস্থা করা সম্ভব।

করোনাকালে আমাদের দেশেও কিছু বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেওয়া শুরু করেছে। গুগল ক্লাসরুম কিংবা অন্যান্য অনেক কলাবোরেশন সফটওয়্যারের মাধ্যমে শিক্ষকরা একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে ইন্টারেকটিভ ক্লাস নিচ্ছেন, শিক্ষার্থীদের বাড়ির কাজ দিচ্ছেন। এ ছাড়া বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হোয়াটসঅ্যাপ বা মেসেঞ্জার গ্রুপ খুলে শিক্ষার্থীদের যুক্ত করেছে। গত ৭ মে বেসরকারি ইউনিভার্সিটি অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার বিষয়ে নির্দেশনা জারি করেছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। পাশাপাশি সব বিশ্ববিদ্যালয়কে অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম চালানো-সংক্রান্ত একটি নীতিমালা তৈরিরও উদ্যোগ নিয়েছে ইউজিসি, যা যুগোপযোগী উদ্যোগ বলেই মনে করি। এটা হলে সবকিছু-ই একটা কাঠামোতে চলে আসবে। সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের প্রতি আহ্বান জানান, যেসব বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে ক্লাস পরিচালনা করছে, তারা কোনো ধরনের চ্যালেঞ্জ বা সমস্যার মুখোমুখি পড়েছেন কি না তা অবহিত করতে।

অবশ্য অনেক শিক্ষার্থী তাদের ইন্টারনেট ও প্রয়োজনীয় ডিভাইস বা স্মার্টফোন না থাকার কথা জানিয়েছেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোনো কোনো এলাকায় এখনো কাক্সিক্ষত ইন্টারনেটের স্পিড পাওয়া যাচ্ছে না। এসব কারণে অনেক শিক্ষার্থী-ই অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারছেন না। এ বিষয়ে কাজ করা যেতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ৬৩.০৮ শতাংশ। এর মধ্যে উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১২ শতাংশের বেশি। সব মিলিয়ে দেশে এখন ১৫ থেকে ৩৫ বছরের যুবক শ্রেণির সংখ্যা ৮০ মিলিয়ন (৮ কোটি)। কর্মক্ষম এই জনগোষ্ঠী আগামী দুই দশক ধরে কর্মক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অবদান রাখতে পারবে। করোনার কারণে বিশ্বজুড়ে যে অর্থনৈতিক স্থবিরতা নেমে এসেছে, তা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রেও তাদের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী যারা এখন প্রাথমিক শিক্ষাক্রমে প্রবেশ করছে, তাদের যখন কর্মক্ষেত্রে ঢোকার বয়স হবে, সে সময়কার কাজ বা বৃত্তি অথবা পেশা সম্পূর্ণ নতুন ধরনের হবে, যার সম্বন্ধে এখন আমাদের কোনো ধারণাই নেই। তাই এখন-ই সময় এ বিষয়ে ভাবার।

বর্তমানে বলা হয়, আমাদের দেশে প্রায় ২৬ লাখ শিক্ষিত বেকার রয়েছে; যারা দক্ষতার অভাবে কাজ পাচ্ছে না। এ জিনিসটা নিয়ে কাজ করতে হবে। কেননা উদ্ভাবনীমূলক ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা থাকলে, ভবিষ্যতের যেকোনো নতুন পেশা বা কাজে নিজেদের সহজে সম্পৃক্ত করা যায়, এ ব্যাপারে সবার সচেতনতা ও মনমানসিকতাও তৈরি করতে হবে। ডিজিটাল দুনিয়ায় শেষ সীমা বলে কিছু নেই। এখানে সর্বদা নতুন চিন্তা, উদ্ভাবন ও সম্পাদন চক্র চলমান থাকে। প্রয়োজনে যেকোনো সময়ে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা যায়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনলাইনভিত্তিক শিক্ষাকার্যক্রম দ্বারাই আমাদের মতো চিরাচরিত সমাজকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রমের জন্য বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রশিক্ষণযোগ্য যুবগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতা এবং অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি মাথায় রেখে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এটা বাস্তবায়ন করতে পারলে বাংলাদেশিরা ঐক্যবদ্ধভাবে অনাগত ভবিষ্যতের মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে। বিশ্বে মাথা উঁচু করে বাঁচবে।

লেখক-
উপাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর
vcbsfmstu@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION