শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:২০ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

বসন্তের হাওয়ায় শীতকাল বাড়িতে ফিরে যাক

আশফাকুর রহমান:

‘অগ্নিশিখার আলো হলো বাস্তবতার জ্ঞান, তার তাপ হলো বাস্তবতার বাস্তবতা, এবং তার সঙ্গে মিলন হলো বাস্তবতার সত্য অবস্থা।’ কিতাব আল-তাওয়াসিন, মনসুর আল-হাল্লাজ। ভাষান্তর : রায়হান রাইন।

১৯৪৩ সালে কাগজে জলরঙে ‘অপেক্ষা’ শিরোনামে ছবি এঁকেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। ১৯৫১ সালে কাগজের বোর্ডে জলরঙে আঁকা তার আরেকটি চিত্রকর্মের শিরোনাম ‘ব্রহ্মপুত্রে ফেরিতে পার হতে অপেক্ষা’। কয়েকজন মানুষ নদীর পাড়ে মাথায় ও শরীরে চাদর জড়িয়ে নির্বিকারভাবে অপলক ও অনিশ্চয়তার দৃষ্টি নিয়ে বসে আছে। ধারণা করা যায়, ওই অপেক্ষায় গ্রামবাংলার সেই সব মানুষ শীতের তীব্র কনকনে ঠা-া থেকে মুক্তি চায়। কিংবা জীবনকে জর্জরিত করার নিয়তিকে করতে চায় পরাজিত। বলিষ্ঠ রেখায় আঁকা সেইসব মানুষ আমাদের কাছে এমনই অচেনা যাদের কথা ইতিহাসে স্পষ্ট করে লেখা নেই। তারা অপেক্ষায় আছে একটু উত্তাপের আশা নিয়ে। তাদের অপেক্ষার ইতিহাস এখনো বর্তমান। এবারের শীতকালেও পত্রিকায় প্রকাশিত আলোকচিত্র ও প্রতিবেদনে সেই সব মানুষদের একটু উত্তাপের অপেক্ষার চিত্র আমাদের চোখের সামনে এখনো কটাক্ষ করছে। কবে হবে এমন অপেক্ষার অবসান? কখনো কি তাদের নবতর কোনো ছবি আমরা দেখব?

ব্রিটিশ কবি ইদিট সিটওয়েল (ঊফরঃয ঝরঃবিষষ) শীতকাল নিয়ে লিখেছেন ‘আরাম করার সময় হলো শীতকাল, ভালো খাবার আর উষ্ণতার জন্যও, একটু বন্ধুত্বপূর্ণ হাতের স্পর্শ পেতে এবং আগুনের পাশে একটু আলাপ: এই সময়টি বাড়ির জন্য।’ শীতকাল হলো বাড়িতে ফিরে আসার হিসাবখাতা। এ হিসাব-নিকাশেই বাস্তবতা মূর্ত হয় সত্যে। সত্যের কাছাকাছি পৌঁছা মানে জীবনের অসন্তুষ্টি থেকে নির্বাণ পাওয়া। শীতকাল হলো সেই সময় যখন প্রাণিজগৎ প্রতিরোধ তৈরি করে। এ প্রতিরোধ এমনই যেখান থেকে ফিরে আসতে হয় ‘নতুন’ কিছু পাওয়ার আশায়। প্রাণ-প্রকৃতিতে শীতকাল আসে চক্রের মতো নিয়ম মেনে। যার থেকে আমাদের নিস্তার নেই। আমরা কেবল পারি প্রতিরোধ করতে।

শীতকালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের মল চত্বর হয়ে যায় ভীষণ রকমের নীরব আর মাটিতে থাকে গাছ থেকে ঝরে যাওয়া অগুনতি শুকনো পাতা। সেই সময়ে আপন মনে নিজের সঙ্গে, সঙ্গীর সঙ্গে, সবার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে জগতের সবকিছু থেকে নিজেদের আলাদা করে ফেলা যায়। করোনা মহামারীপূর্ব পৃথিবীতে লাল রঙের এক শীতের পোশাকে মলিন হলুদ রঙের মল চত্বরে সবার থেকে আড়াল হয়ে এক সঙ্গীকে নিয়ে হেঁটেছিলেন তরুণ আলোকচিত্রশিল্পী শাহাদাত হোসেন। তার তোলা আলোকচিত্র নির্দিষ্ট কোনো স্থানকে নির্দেশ করে না থাকে না কোনো ইঙ্গিত। শাহাদাত নিজেও এমনটি চান না বলে জানিয়েছেন। এর মানে কি তার তোলা ছবি বিশে^র যে কোনো স্থানের কথা বলে বা তা সবার কাছে প্রাসঙ্গিক? হয়তো যে কোনো স্থানেই তার আলোকচিত্র বর্তমান অস্তিত্বের নির্দশন। হয়তো মল চত্বরের সেই কুয়াশায় থাকা বিকালে শাহাদাতের শরীরে থাকা লাল রঙের সেই পোশাক দূর থেকে দেখা কোনো এক বিভ্রম! এর মধ্যেই শীতকালটা শেষ করার মায়ায় থাকতে হয় সবাইকে।

মল চত্বরের পাশেই এক কোনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায়শিক্ষা অনুষদের সামনে রয়েছে ‘মাল্রো বাগান’। সেখানে শিলালিপিতে লেখা রয়েছে ১৯৭৩ সালের ২১ এপ্রিল অঁদ্রে মাল্রোর ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে দেওয়া এক বক্তৃতার অংশবিশেষ। তিনি বলছেন, ‘ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, আজ আমি প্রথমবারের মতো কথা বলছি পৃথিবীর একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সামনে যাদের শহীদদের সংখ্যা অনেক বেশি জীবিতের চেয়ে!’ জীবিত এসব মানুষদের জন্য সময় এগিয়েছে অনেক দ্রুত, আগের সবকিছু গিয়েছে বদলে বদলাচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু চল্লিশ ও পঞ্চাশ দশকে আঁকা শিল্পচার্যের সেই চিত্র আমরা কতটুকু বদলাতে পেরেছি? কতটা সম্ভব হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের রক্তের ঋণ শোধ করা? গ্রামবাংলার এমন শীতকাল কবে ফিরবে বাড়িতে?

জানুয়ারি মাসে বিজনেস ওয়ার্ল্ডের সূত্রে যমুনা টিভির অনলাইনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০২২ সালে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ১৬৫ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সমুদ্র ও বায়ুমন্ডলীয় জাতীয় অধিদপ্তরের পরিচালক ড. রকি স্পাইনার্ড বলেছেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন এবং চরম আবহাওয়ার কারণে ঝুঁকিতে পড়েছেন অতীতের তুলনায় বেশিসংখ্যক মার্কিনি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব পড়েছে মানুষের দৈনন্দিন জীবন, কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর খেলার জায়গাতেও।’

বৈশি্বক জলবায়ুর প্রভাব থেকে বাংলাদেশকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। মানুষের তৈরি করা আজ পৃথিবীতে প্রকৃতির আচরণ আর ‘স্বাভাবিক’ থাকছে না। এবারের শীতকাল আমাদের এমনটিই জানিয়েছে। এ বছরের ৭ জানুয়ারি ভোরের কাগজে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ বলেছেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে শীতকালে তাপমাত্রা বেশি থাকলেও শীত বেশি অনুভূত হওয়ার প্রধান কারণ হলো জলাভূমি, খাল-বিল, নদী-নালার পরিমাণ কমে কংক্রিটের অবকাঠামো বেড়ে যাওয়া।’ এছাড়া ২৪ জানুয়ারি প্রথম আলোতে ‘জলাভূমি, গাছপালা উজাড়, ঢাকায় শৈত্যপ্রবাহ আসে না’ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও জলবায়ু গবেষক আশরাফ দেওয়ান বলেছেন, ‘ঢাকা শহরের অপরিকল্পিত নগরায়ণ এখানকার সুন্দর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যকে ধ্বংস করে ফেলেছে। ঢাকায় শীতকাল ছাড়া বাকি সময়জুড়ে দিন ও রাতে একই ধরনের উত্তাপ বা গরম অনুভূত হয়।’ মানুষের তৈরি স্থানে প্রকৃতির এ বদলে যাওয়ার বিরুদ্ধে মানুষ কী করে প্রতিরোধ তৈরি করবে? মানুষ কি নিজেই তার স্থানচ্যুতির কারণ হিসেবে স্বীকৃতি নিচ্ছে?

তবুও সৃজনশীল মানুষ তার সৃষ্টিতে সাক্ষী রেখে যায় প্রকৃতির। বাংলাদেশি প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী কাজী গিয়াসউদ্দিন জাপানে আছেন দীর্ঘদিন ধরে। ঢাকার পাশে সাভারে করেছেন স্টুডিও। কাজী গিয়াসের আঁকা তেলচিত্রে সাদা রঙের প্রচুর ব্যবহার কেন সেটি জানতে চেষ্টা করেছেন তার মেয়ে লেখক ও মডেল কাজী মায়া। জাপানে জন্ম ও বড় হওয়া কাজী মায়া শৈশবে শীতকালে বাংলাদেশ ভ্রমণের স্মৃতি স্মরণ করেছেন তার বাবার সাদা রঙের ব্যবহারের কারণ জানতে। এক লেখায় তিনি লিখেছেন অনেকটা এভাবে সাভারের স্টুডিওতে দরজা খুলে দেখেছেন কুয়াশা ডাকা সকাল। জাপানের তুষারপাত নয়, তার বাবার চিত্রকর্মের থাকা সাদার উৎস সেই কুয়াশা। যদিও কাজী গিয়াসের ঢাকার স্টুডিওর চারপাশে রয়েছে সবুজ ঘাসের চত্বর। একজন সৃজনশীল মানুষের কাছে বিভিন্ন স্থানে থাকা এমন সব ‘বিশেষ’ নিয়ামকই তার সৃষ্টির উৎস। চেতনে-অবচেতনে তিনি এসব ধারণ করেন আজীবন।

এ কথার প্রেক্ষাপট থেকে বিবেচনা করা যেতে পারে, নিজের আত্মপরিচয় প্রসঙ্গে ভাষার প্রতি বাধ্যবাধকতা না থাকার বিষয়ে বলেছেন ঢাকা লিট ফেস্টের ১০ম আয়োজনে আসা তানজানিয়ায় জন্ম নেওয়া নোবেলজয়ী ব্রিটিশ কথাসাহিত্যিক আবদুলরাজাক গুরনাহ। সম্প্রতি প্রথম আলোতে প্রকাশিত তার এক সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেকেই তার পরিচয় মনে করেন বলে জানিয়েছেন। তিনি বলছেন, ‘আমার পরিচিতি নিয়ে প্রশ্ন উঠলে শুধু নিজের নামটাই বলব। নিজেকে আমি কোনো বিশেষ পরিচয়ে বেঁধে দিতে চাই না।’ যদিও তার সৃজনজগৎ ইতিহাস, মানুষ, ভূগোল, ভাষা আর সময়ের ব্যাকরণে মিলেমিশে ব্যক্তিসত্তার বিষয়কে এড়িয়ে পৃথিবীর সঙ্গে সংলাপ রচনা করতেই আগ্রহী। শুধু ভাষা নয় আরও অনেক কিছুকে নিয়ে শীতকাল কি তবে বাড়ি ফিরবে এবার?

গত বছর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে ১৯তম দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী বাংলাদেশ ২০২২-এ আয়োজিত সেমিনারের শিরোনাম ছিল ‘হোম অ্যান্ড ডিসপ্লেসমেন্ট’। সমাপনী বক্তৃতায় অধ্যাপক আহরার আহমদ বলছেন, ‘‘But if the idea of home is difficult to specify, the notion of displacement is more challenging. Is it possible to choose not to have a home, and live like wanderers, pastoralists and herders without any fixity or address?’’ মানুষকে স্থির করে শীতকাল। তার এ স্থির হওয়া কি কোনো স্থানে আটকে থাকা স্থবির হয়ে যাওয়া? না হলে কেনই-বা আমরা কেউ শুনছি না শীতের কষ্টে কোনো একভাবে প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষদের কথা?

প্রকৃতির বিচিত্র আচরণ এবং বৈশিষ্ট্যকে মোকাবিলা করেই মানব সভ্যতা সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে এগিয়েছে। অনেকেই একে বলছেন অগ্রগতি। এ অগ্রগতি কি প্রকৃতির বিরুদ্ধ আচরণকে প্রতিহত করে বেঁচে থাকা? নাকি বিদ্যা ও দক্ষতা অর্জনের মধ্য দিয়ে মানবসভ্যতার সত্য অবস্থান তৈরিতে ব্রত হওয়া? এই ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ঢাকা আর্ট সামিটের ষষ্ঠ আয়োজন। ‘বন্যা’ এবারের প্রতিপাদ্য। বন্যার মতো দুর্যোগে ঘরবন্দি মানুষের জীবন কীভাবে সৃজনশীল হতে পারে তার একটি বড় উদাহরণ শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদের ১৯৮৫ সালের আঁকা ছাপচিত্র ‘জলের নিনাদ’। বন্যায় ঘরে তৈরি হওয়া জলাবদ্ধতায় স্থির পানির মধ্যে থাকা নানাকিছুর সন্নিবেশে তৈরি হয়েছে তার এ সৃষ্টি। আসলে জীবন না থাকলে শিল্প সৃষ্টি হয় না।

সবকিছুকে বাস্তব মনে করে, সব মুহূর্তকে আলিঙ্গন করে অগ্রসর হওয়াই জীবন ও সৃষ্টির অনিবার্য অর্থ। প্রকৃতির নানারূপে কীভাবে মানুষের তৈরি পৃথিবী গড়ে উঠবে সে বিচার কারা করবে? এ প্রশ্নের জবাব পাওয়া যেতে পারে নাট্যকার সারাহ্ কেইনের লেখা এবং সৈয়দ জামিল আহমেদের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় মঞ্চনাটক ‘৪.৪৮ মন্ত্রাস’-এর একটি সংলাপে, ‘এ পৃথিবীতে ধ্বংসই একমাত্র অবিনশ^র’। ধ্বংসই সৃষ্টির মূল সুর। এ চরম সত্য শীতকালে জ¦লে থাকা আগুনের মতো। যে আগুনের আলোয় প্রাণ পায় অস্তিত্বের সন্ধান। আবার বসন্তের হওয়ায় জীবন পায় নতুন স্পন্দন। সুযোগ হয় মানুষের একটি স্বপ্নের রাজ্য তৈরি করার। শীতকালের সুযোগ হয় বাড়ি ফিরে যাওয়ার।

লেখক: লেখক ও সাংবাদিক

ashfak21@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION