শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:৩৪ অপরাহ্ন
মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
আগামী ৭ মার্চ দিবাগত রাতে পবিত্র শবেবরাত পালিত হবে। হিজরি শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত শবেবরাত হিসেবে পরিচিত, যার আরবি লাইলাতুল বরাত। ফারসি শব আর আরবি লাইলাতুন অর্থ রজনী, রাত। বারাত অর্থ মুক্তি, পরিত্রাণ। তাহলে অর্থ দাঁড়ায় পরিত্রাণের রজনী। যেহেতু হাদিস শরিফে বারবার বিবৃত হয়েছে, এই রাতে আল্লাহ মুসলমানদের গোনাহ থেকে পরিত্রাণ দেন, তাই এ রাতের নামকরণ করা হয়েছে- লাইলাতুল বারাত বা শবেবরাত। হাদিসের পরিভাষায় এই রাতের নাম হলো- লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান বা মধ্য শাবানের রাত।
ইসলামে অশুভ বলে কিছু নেই। তারপরও সৃষ্টিকর্তা দয়াময় আল্লাহতায়ালা সৃষ্টিজগতে এক বস্তুর ওপর অন্য বস্তুকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। যেমন- স্থান হিসেবে মক্কা-মদিনা অন্যান্য স্থান থেকে শ্রেষ্ঠ। কূপের মধ্যে জমজম সর্বশ্রেষ্ঠ। সাপ্তাহিক দিনের মধ্যে জুমার দিন শ্রেষ্ঠ। মাসের মধ্যে রমজান সর্বশ্রেষ্ঠ। রাতের মধ্যে লাইলাতুল কদর (শবেকদর) শ্রেষ্ঠ। ঠিক তেমনি শবেবরাতও অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাত। এসব মুমিনদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ উপহার। এ উপহারগুলো গ্রহণ করে ওই শ্রেষ্ঠ স্থান, দিন-রাত ও সময়কে মুমিনরা কাজে লাগিয়ে যত বেশি আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হয়, আল্লাহ তত বেশি মুমিনের পার্থিব-অপার্থিব মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। তাই মুমিনদের উচিত এসব স্থান ও সময়ে যথাসাধ্য ইবাদত ও জিকির-আজকারে মশগুল হয়ে আল্লাহর নৈকট্যলাভে ব্রত হওয়া।
সাহাবি হজরত মুআজ (রা.) সূত্রে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে মাখলুকের প্রতি (বিশেষ) দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষকারী ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ -সহিহে ইবনে হিব্বান : ১২/৪৮১, হা. ৫৬৬৫
আরও ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, আল্লাহতায়ালা শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে মাখলুকের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন এবং বিদ্বেষ পোষণকারী ও খুনি ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ -মুসনাদে আহমদ : ১১/২১৬, হা. ৬৬৪
ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, ‘আমার কাছে এ কথা পৌঁছেছে যে পাঁচ রাতের দোয়া কবুল হয়- জুমার রাত, ঈদুল আজহার রাত, ঈদুল ফিতরের রাত, রজবের প্রথম রজনী এবং মধ্য শাবানের রজনী। -সুনানে কাবির, ৩/৪৪৫, হা. ৬২৯৩
হজরত আলী (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা মধ্য শাবানের রজনীতে জাগ্রত থাকো এবং দিনে রোজা রাখো। সূর্যাস্তের সময় আল্লাহতায়ালা দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন এবং বলেন, আছো কি কেউ ক্ষমা প্রার্থনাকারী, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। আছো কি কেউ রিজিক যাচনাকারী, আমি তাকে রিজিক দান করব। কোনো বিপদগ্রস্ত আছো কি, আমি তাকে বিপদ থেকে মুক্তি দেব। এরূপ কেউ আছো কি? এরূপ কেউ আছো কি? এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত আহ্বান করতে থাকেন। -ইবনে মাজাহ : ১/৪৪৪, হা. ১৩৮৮
এ বিষয়ে এরূপ আরও বহু হাদিস বিভিন্ন কিতাবে রয়েছে। উল্লিখিত হাদিসগুলো থেকে অনুমিত হয়, শবেবরাত বা মধ্য শাবানের রজনীর গুরুত্ব, মহত্ত্ব, তাৎপর্য ও ফজিলত অপরিসীম। এর মধ্যে কিছু সহিহ, কিছু হাসান, আবার কিছু জয়িফও রয়েছে- শাস্ত্রিক বিশ্লেষণের দিক থেকে। সামগ্রিকভাবে এসব হাদিস গ্রহণযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য হওয়ার ব্যাপারে মুহাদ্দিসিনের বহু উক্তি রয়েছে। শায়খ আলবানি (রহ.) বলেন, শবেবরাত সম্পর্কিত হাদিসগুলোর সারকথা হলো, এ সম্পর্কে বর্ণিত হাদিসগুলো সামগ্রিকভাবে নিঃসন্দেহে সহিহ। হাদিস অত্যধিক দুর্বল না হলে এর চেয়ে কমসংখ্যক সূত্রে বর্ণিত হাদিসও সহিহ হিসেবে গণ্য হয়। -সিলসিলতুস সহিহা : ৩/১৩৮
পবিত্র ও ফজিলতপূর্ণ এ রাতে বিভিন্ন আমলের মাধ্যমে অতিবাহিত করা। এসব আমলের অন্যতম হলো- এশা ও ফজর নামাজ ওয়াক্তমতো জামাতের সঙ্গে আদায় করা, যথাসম্ভব নফল ও তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করা, সম্ভব হলে উমরি কাজা নামাজ ও সালাতুত তাসবিহ আদায় করা। কোরআন মাজিদ বেশি বেশি তেলাওয়াত করা, বেশি বেশি আল্লাহতায়ালার জিকির করা, বেশি করে দোয়া করা, মাঝে মাঝে শবেবরাতে কবর জিয়ারত করা, পরের দিন রোজা রাখা, সম্ভব হলে রাত জেগে ইবাদত করতে হবে। শবেবরাতে কবর জিয়ারত সম্পর্কে আল্লামা তকি উসমানি বলেন, ‘যেহেতু হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) এই রাতে কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে জান্নাতুল বাকিতে তশরিফ নিয়ে গেছেন, তাই মুসলমানরা শবেবরাতে কবরস্থানে যাওয়ার প্রতি খুব গুরুত্ব দিয়ে থাকে।’ -প্রাগুক্ত
এ ছাড়া ১৫ শাবান রোজা রাখার কথা রয়েছে। সম্ভব হলে রাত জেগে ইবাদত করতে হবে। একই ইবাদত দীর্ঘ সময় ধরে না করে একের পর এক বিভিন্ন নফল ইবাদত করতে থাকলে তন্দ্রাভাব চলে যেতে পারে। গোটা রাত জাগা সম্ভব না হলে রাতের বেশির ভাগ সময় ইবাদতে মশগুল থাকতে চেষ্টা করতে হবে। তাও সম্ভব না হলে শেষরাতের সময়টুকুতে কিছুতেই অবহেলা করা যাবে না। আর এ বিষয়টিও খুব খেয়াল রাখতে হবে যে রাতের নফল ইবাদতের কারণে যেন ফজরের ফরজ নামাজ ছুটে না যায়।
শবেবরাতের নামে কোনো প্রকার আনুষ্ঠানিকতা কোরআন-হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়। না কোনো নির্দিষ্ট ইবাদত বা ইবাদতের নির্দিষ্ট নিয়ম প্রমাণিত আছে। তেমনি জামাতের সঙ্গেও শবেবরাতের নামে কোনো ইবাদত করা যাবে না। যেমন- শবেবরাতের নামে জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করা ইত্যাদি। শবেবরাতকে কেন্দ্র করে সমাজে কিছু বিদআত ও কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে। যেমন- ঘরবাড়ি, দোকান, মসজিদ ও রাস্তাঘাটে আলোকসজ্জা করা। বিনা প্রয়োজনে মোমবাতি কিংবা অন্য কোনো প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা। আতশবাজি করা। পটকা ফোটানো। মাজার ও কবরস্থানে মেলা বসানো। হালুয়া-রুটি, শিরনি ও মিষ্টি বিতরণের আয়োজন করা। কবরস্থানে পুষ্প অর্পণ ও আলোকসজ্জা ইত্যাদি; শরিয়তে এসব কাজের কোনো ভিত্তি নেই।
এসব বিদআত ও কুসংস্কার থেকে আমাদের বেঁচে থাকা আবশ্যক। মনে রাখতে হবে, শবেবরাতকে ফজিলতপূর্ণ করা হয়েছে উত্তম আমল করে বেশি বেশি সওয়াব অর্জনের জন্য। এর মধ্যে যদি বিভিন্ন বিদআত, কুসংস্কার ও শরিয়তপরিপন্থী কাজ আঞ্জাম দেওয়া হয়, তাহলে সওয়াবের পরিবর্তে গোনাহর বোঝাই ভারী হবে। স্মরণ রাখতে হবে, পুণ্যময় রাতগুলোতে ইবাদতে যেমন অধিক সওয়াব, তেমনি এসব রাতের গোনাহের শাস্তিও অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি হবে।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক
muftianaet@gmail.com