বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ১১:২৩ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

বাজেটে আদিবাসী-প্রান্তিক মানুষের জীবন

সঞ্জীব দ্রং:

কঠিন করোনাকাল চলছে। চারদিকে মৃত্যু আর হতাশার খবর। আরও আছে সীমাহীন অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার হাতছানি। প্রান্তিক মানুষের নীরব হাহাকার আর আর্তনাদ। রাষ্ট্র ধনী হলে, উন্নত হলে, শিক্ষিত হলে তাদের নাগরিকদের এক ধরনের সুবিধা ও স্বস্তি দিতে পারে। আমাদের মতো প্রবল বৈষম্যপীড়িত দেশে নাগরিকদের জীবনে, বিশেষ করে দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের জীবনে সেই সম্মান ও মর্যাদা এখনো স্বপ্ন দেখার পর্যায়ে রয়ে গেছে। আরও বহু দূর পাড়ি দিতে হবে। এই করোনাকালে প্রবল আকারে বোঝা গেল, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কাছে তার জীবনের চেয়ে জীবিকার মূল্যই বেশি। এমনও কথা তারা প্রকাশ্যে মিডিয়াকে বলেছেন, পেটে খাবার না থাকলে এমনিই তো মরে যেতে হবে। এই-ই হলো সাধারণ দরিদ্র ও প্রান্তিক খেটে খাওয়া মানুষের জীবনের নিয়তি স্বাধীনতার প্রায় অর্ধ শতকে এসে। তাই বাজেটের আকার চার লাখ কোটি পেরিয়ে পাঁচ লাখ কোটিতে গিয়ে ঠেকলেও এই প্রান্তিক মানুষদের জীবনে বৈষম্য ও হতাশা ছাড়া লক্ষ কোটি টাকার বড় বাজেটের প্রতিফলন নেই। প্রখ্যাত লেখক, ম্যাগসেসে পুরস্কারপ্রাপ্ত, পদ্মভিভূষণ উপাধিতে ভূষিত, বিখ্যাত সব উপন্যাস হাজার চুরাশির মা, অরণ্যের অধিকার ও রুদালির রচয়িতা মহাশ্বেতা দেবী বলতেন, ‘গরুকে খাওয়ান, সে স্বাস্থ্যপুষ্ট হবে। ঘর সাফ করুন, ঘর পরিষ্কার হবে। বই পড়ুন অনেক, জ্ঞান বাড়বে। গাছ লাগিয়ে যান ও যতœ করুন, সে ফুল-ফল-পাতা দেবে। অর্থাৎ যতœ, অর্থ ব্যয়ের প্রতিফলন একটা ছোট-বড় মাপের ক্ষেত্রেই ইতিবাচক হতে বাধ্য। ভারতবর্ষের সমগ্র আদিবাসী জীবনে, আদিবাসীর জন্য যে ব্যয় হচ্ছে তার প্রতিফলন নেই। তার কারণও সহজবোধ্য (বুঝতে চাইলে), এগুলোর যথার্থ রূপায়ণ নেই, তার চেষ্টাও করা হয়নি।’ এই যে রূপায়ণ হয়নি, এটিই মূলকথা। অর্থাৎ বাজেট বরাদ্দ হলেই হবে না, এই অর্থ ব্যয়ের সঠিক রূপায়ণ থাকতে হবে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও আন্তরিকতার ছোঁয়া থাকতে হবে কর্মকা-ে। যাদের জন্য ব্যয় করা হচ্ছে, সেই মানুষদের প্রকৃত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। দয়া ও করুণা নয়, মর্যাদা ও মানব অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও যতœবান হতে হবে। দুঃখের বিষয়, দশকের পর দশক ধরে আমরা প্রান্তিক নাগরিকদের প্রতি এক ধরনের অবহেলা, উপেক্ষা ও অনুকম্পাসম আচরণ দেখি আর হতাশ হই। ভারতের অনেক রাজ্যে আদিবাসী জনগণ আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার ভোগ করছে, স্বশাসন ব্যবস্থা সেখানে আছে। এত সবের পরও অনেক রাজ্যে ‘বৃহত্তর স্বশাসনের জন্য’ তাদের আন্দোলন চলমান। তারপরও মহাশ্বেতা দেবী এই কথাগুলো বলেছেন। আমাদের দেশের আদিবাসীদের দশা অতি করুণ। এর কারণ জাতিসংঘ বলেছে, ঐতিহাসিকভাবে বিশ্বের আদিবাসী জনগণ নানা শোষণ, বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার।

দুই.

আমাদের আশা ছিল বাজেট বক্তৃতায় আদিবাসী মানুষের পরিচয়, অধিকার, সংস্কৃতি, নিজস্ব জীবনধারা, তাদের উন্নয়ন এসব বিষয়ে কিছু উল্লেখ থাকবে। গত কয়েক বছর ধরে এটি অনুপস্থিত। অথচ অতীতে মূল বক্তৃতায় একটি প্যারাগ্রাফ থাকত। বাজেট মানে তো শুধু টাকা-পয়সা নয়, এখানে আদিবাসীদের সম্পর্কে রাষ্ট্রের ভাবনা-চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিরও প্রকাশ ঘটে। দুঃখের বিষয় এবারও আদিবাসীদের বিষয়টি দারুণভাবে উপেক্ষিত। বাজেটে আদিবাসীদের জন্য বরাদ্দ কী পরিমাণ হবে, এ ক্ষেত্রে একটি সমস্যা হলো, আদিবাসীদের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ না করা এবং প্রকৃত আদিবাসী জনসংখ্যা কত, তা না জানা। আদিবাসী জনগণ বাংলাদেশের সবচেয়ে বঞ্চিত, দরিদ্র ও অনগ্রসর অংশের মধ্যে অন্যতম। স্বাধীনতার প্রায় পঞ্চাশ বছরে এসে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় গত বছর মার্চ মাসে নির্ধারণ করল দেশে বিভিন্ন আদিবাসী/ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী আছে ৫০টি। এটি স্বীকৃত হলো। ভালো কথা। অন্য তথ্যগুলোর কী অবস্থা? এই নাগরিকদের জনসংখ্যা কত? শিক্ষার হার কত, স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা কী, মাতৃমৃত্যু হার বা শিশুমৃত্যু হার কত? এই ধরনের বিভাজিত তথ্য কি আছে? এসব নিয়ে ভাবনাই তো শুরু হয়নি। পদ্মা-মেঘনা-যমুনার সঙ্গে শংখ-মাইনী-সোমেশ্বরী-বুগাই নদীকে মেলাবার আয়োজন শুরুই হয়নি। আমরা আদিবাসী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর কাছে একটি আবেদনপত্র জমা দিয়েছি গত বছর, যাতে আগামী লোকগণনার সময় আদিবাসীদের বিভাজিত তথ্য যুক্ত করা হয়। আমি নিজে ওই সভায় ছিলাম। ডিজি মহোদয় খুব আন্তরিক ছিলেন এবং ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছেন। এভাবে অতি ধীরে কিছু কাজ হয় অ্যাডভোকেসির ফলে।

তিন.

পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতল উভয় অঞ্চলের আদিবাসীদের সিংহভাগ এখনো জীবিকা নির্বাহের জন্য জুম ও কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। সমতলের আদিবাসীদের দুই-তৃতীয়াংশ বা তারও অধিক এখন ভূমিহীন। তার ওপর আদিবাসীদের ভূমি নিয়ে বিরোধ সর্বত্র। এই করোনাকালে এক কঠিন অনিশ্চিত জীবনের দিকে ধাবিত হচ্ছে দেশের ৩০ লক্ষাধিক আদিবাসী মানুষ। অন্যান্য প্রান্তিক মানুষ, যেমন চা বাগানের শ্রমিক ও তাদের পরিবার, দলিত জনগণ, হাওর অঞ্চলের মানুষ, ভাসমান খেটে খাওয়া নাগরিক আর অনানুষ্ঠানিক বা স্বীকৃতিহীন কর্মকা-ে যারা জড়িত, যেমন গৃহস্থালির কাজ, বিউটি পার্লারের পাঁচ সহস্রাধিক আদিবাসী নারী, যারা ইতিমধ্যে কাজ হারিয়েছে এবং অনেকে গ্রামে চলে গেছে শহর ছেড়ে, এদের জন্য রাষ্ট্রীয় সহায়তা ও বাজেট প্রণোদনা অতি জরুরি।

বাজেট বরাদ্দ সাধারণত হয় মন্ত্রণালয়ভিত্তিক। সমতলের আদিবাসীদের জন্য একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় গঠন করা আবশ্যক। এটি বহু পুরনো দাবি। এখন পর্যন্ত বিষয়টি দেখার জন্য যেহেতু কোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগ নেই, সে জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এই থোক বরাদ্দ পরিচালনার জন্য সমতলের আদিবাসীদের সমন্বয়ে একটি কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা কমিটি বা বোর্ড গঠনের দাবিও পুরনো। এতে ভুলত্রুটি এড়ানো সম্ভব হবে এবং দুর্নীতি রোধ করা যাবে। এ বছর সমতলের আদিবাসীদের জন্য ৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। গত বছর ছিল ৫০ কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ হলো সমতল অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য সরাসরি বৃত্তি প্রদান। গত কয়েক বছর ধরে এটি চলমান আছে। ছাত্রছাত্রীরা পঁচিশ হাজার টাকার চেক পেয়েছে এবার। এই করোনার সময় এটি বিশেষ কাজে লাগবে। আমরা বারবার দাবি জানিয়ে আসছি আদিবাসীরা যেহেতু দরিদ্রদের মধ্যেও অতি দরিদ্র, তাই তাদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ প্রদান আবশ্যক। এই করোনার সময় এমন বাজেট বরাদ্দ রাখা উচিত, যাতে অন্তত পাঁচ হাজার প্রান্তিক মানুষের পরিবারে ছয় মাস বা এক বছরের জন্য একজন করে তরুণের কর্মসংস্থান হয়। হোক না তা অস্থায়ী ভিত্তিতে। তবুও এই কঠিন সময়ে পরিবারগুলো কিছুটা আশার আলো দেখতে পাবে। অনেকে বলবেন, মূল বাজেটে ১৬ কোটি মানুষের সবার জন্য বরাদ্দ আছে, সেখানে আদিবাসীরাও আছে। কথাটা শুনতে সুন্দর। বাস্তবতা ভিন্ন। এই জন্যই সুনির্দিষ্ট করে পেছনে পড়া মানুষদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা প্রয়োজন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনগ্রসর বঞ্চিত ও উপেক্ষিত নাগরিকদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখার বিধান আছে। আমাদের সংবিধানেও আছে। বাস্তবেও আমাদের দেশে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য জাতীয় সংসদে আসন সংরক্ষণসহ অন্যান্য বিশেষ ব্যবস্থা আছে। যেহেতু ঐতিহাসিকভাবেই আদিবাসীরা নানাকারণে শোষণ, বৈষম্য ও মানবসৃষ্ট দারিদ্র্য ও বঞ্চনার শিকার, তাই তাদের উন্নয়নে বিশেষ বরাদ্দ আরও বেশি হওয়া উচিত।

কঠিন এই করোনাকালেও পাঁচ লাখ কোটির অধিক টাকার বাজেট ঘোষিত হলো। এটি পাসও হয়ে গেছে। ক্ষীণ নয়, বড় আশা করব, অন্তত মানবিক বিপর্যয়ের এই করোনাকালে এবার আদিবাসীদের কথা শাসক-শ্রেণি বিবেচনা করবে। তাদের মধ্যে আত্মোপলব্ধি হবে, আত্মজিজ্ঞাসার বোধোদয় হবে। আর সত্যি দেশের সব প্রান্তিক মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, পাহাড়ি, আদিবাসী, চা জনগোষ্ঠী, হাওরের মানুষ, অরণ্যচারী, দলিত আর লাখ লাখ বেকার তরুণ, যারা নিয়তিকে মেনে নীরব দর্শক হয়ে গেছে, কেউ লিবিয়ায় গিয়ে গুলি খেয়ে মরছে, কেউ থাইল্যান্ডের জঙ্গলে অকালে জীবন বিসর্জন দিচ্ছে, সাগরে কারও সলিল সমাধি হচ্ছে, তাদের স্বজনদের কথা রাষ্ট্র ভাববে। এখন সত্যি ক্রুদ্ধ গর্জন, অহংকারী ও কথার কচকচির সময় নয়। এখন সত্যি একটু পেছন ফিরে মানুষ আর আকাশের পানে তাকিয়ে অবনত, নম্র ও আত্ম-অনুসন্ধানী হওয়ার সময়।

লেখক-
কলামনিস্ট ও সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম
sanjeebdrong@gmail.Com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION