বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ১১:২৫ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

সব কথা কি বলতে নেই

তপন মাহমুদ:

কহলীল জিব্রান, কেউ ডাকেন খলিল জিব্রান- প্রিয় কবিদের একজন। তার কবিতায় জীবন ও দর্শন খুঁজে পাই। চিন্তার খোরাক পাই। তুর্কি অপশাসন ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লেখালেখির জন্য এই কবি, লেখককে স্বভূমি থেকে নির্বাসনে যেতে হয়েছিল। তার একটা ছোট্ট কবিতা মনে পড়ল : সত্যি কথা বলতে কি, আমরা তো/কেবল নিজেদের সঙ্গেই কথা বলে থাকি,/আর কখনো সখনো একটু জোরে/কথা বললেই শুধু অন্যরা শুনতে পায়।

তাই তো! কথা তো মনে মনেও হয়। যতক্ষণ জেগে থাকি। চেতনে থাকি। আমাদের ভাবনাগুলোই তো আমাদের কথা। কখনো মুখ ফুটে বলি, আর কখনো বলি না। তাই ভাবি, এক জীবনে কত কথাই তো বলি! তার খুব অল্পই অন্যরা শুনতে পায়। ভুক্তভোগীরা বলেন, নতুন প্রেমিকার কাছে নাকি পুরনো প্রেমিকার কথা বলতে নেই! তুলকালাম হয়ে যেতে পারে। অযথা অভিমানের বাষ্পে কেনই বা ভিজবেন? কিন্তু তাই বলে কি মনের মধ্যে পুরনো প্রেমিক বা প্রেমিকা একবারও উঁকি দেবে না?

ভারতীয় বাংলা ছবি ‘প্রাক্তন’-এ অনিন্দ্য চ্যাটার্জির কণ্ঠে একটা গান আছে, ‘কোথায় যে কার ঘর এই ম্যাজিক শহর, কে আপন কে পর জানে মনের গুপ্তচর’। এই মনের ঘরে কে কবে সিঁধ কাটতে পেরেছে বলুন? আর এই তাবৎ দুনিয়ায় এমন কোনো বাও কি আছে যা দিয়ে মনের গভীরতা আপনি মাপতে পারবেন? কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও ব্যর্থ হয়েছেন মনের ঘরের দরজা খুঁজে পেতে। ‘ঐকতান’ কবিতায় লিখলেন, সব চেয়ে দুর্গম-যে মানুষ আপন অন্তরালে, /তার পূর্ণ পরিমাপ নাই বাহিরের দেশে কালে। /সে অন্তরময়,/অন্তর মিশালে তবে তার অন্তরের পরিচয়।/পাই নে সর্বত্র তার প্রবেশের দ্বার;

তাই একের মন অন্যের কাছে ভীষণ দুর্গমই বটে। কোনো দেয়াল নেই, কাঁটাতার নেই, অথচ কী নিরাপদ এই মনের রাজ্য। কারও ঢোকার সাধ্য নেই। রবীন্দ্রনাথ যদিও অন্তরে অন্তর মিশিয়ে কিছুটা জানার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু নিজেই জানালেন পুরোটা বোঝার সাধ্য তার নেই। কারোরই নেই। ছিল না কোনো কালে। হবে কি কখনো? এই মনের রাজ্যে কোনো রাষ্ট্রের আইন নেই। আদালত নেই। মৌলবাদীর হানা নেই। জঙ্গি হামলার ভয় নেই। প্রথার চাপ নেই। মূল্যবোধের বালাই নেই। এমনকি বিতর্কিত ধারাও নেই। তাই আজকাল মনে মনেই সব কথা বলি। শব্দ করি না। কেউ শুনে ফেলতে পারে। আর তখনই বেধে যেতে পারে বিপত্তি। তাই অন্যের আপত্তির কারণ হোক এমন কিছু বলা বা লেখা থেকে বিরত থাকাই মনে হয় ভালো! যাকে সমানা সামনি দু’কথাও শুনাতে সাহস পাই না, তাকে মনে মনে হাজার গালি দিয়ে দিতে পারি অনায়াসে। বলতে পারেন, এতো পাগলের সুখ মনে মনে। আমিও বলি, সেটাই। দুনিয়াজুড়ে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও ব্যক্তিক অসহিষ্ণুতা এতটাই বেড়েছে যে মনের কথা খুলে বলা বেশ সাহসের কাজ। অনেক সময় জান হাতে নিয়ে কথা বলতে হয়। কখনো ভয় থাকে প্রভাবশালীদের দ্বারা অপমানিত বা অপদস্থ হওয়ার। সঙ্গে কিঞ্চিৎ চড়-থাপ্পড় বা একটু-আধটু রক্তও ঝরতে পারে। এর বাইরে আবার চার শিকের ভয়ও তো আছে। জঙ্গিবাদের ভয় তো আছেই! এতসব ভয় মাড়িয়ে কথার তুবড়ি ফোটাবেন এমন সাহস কজনার হয়? আর ছাপার হরফে হলে তো কথাই নাই !! অন রেকর্ড !!

জর্জ বার্নাড শ’ বলেছেন, ‘কেউ আপনাকে ততক্ষণ কিছু বলবে না, যতক্ষণ না আপনি তার সঙ্গে কোনো দ্বিমত করছেন’। আমিও তাই ভাবি। কী দরকার দ্বিমত করার। সব কিছু মেনে নিলেই তো ভালোয় ভালোয় জীবনটা কেটে যাবে। আর কথা যখন অত হিসাব করেই বলতে হবে তখন কি না বলাই ভালো নয়, না লিখাই ভালো নয়! আমার তো তাই মনে হয়। এও তো শুনেছি যে, বোবার শত্রু নেই। এরপরও যারা লিখতে বলেন, বলতে বলেন বা লিখতে বা বলতে চান, তাদের জিজ্ঞাসা করি, মানুষ যা বলতে চায়, যা লিখতে চায়, তা কি কখনো স্বাধীনভাবে বলতে বা লিখতে পেরেছে? পৃথিবীর ইতিহাস ঘাঁটলে এটাই হয়তো বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে যে, অনেক কথাই না বলা থেকে গেছে। গুটিকয়েক অতি সাহসীরা বলেছেন। কিন্তু তারা কেউই খুব সহজে পার পাননি। বিশেষত, সমাজের প্রচলিত ধারণা বা বিশ্বাসের বাইরে যারা বলেছেন, তা যতই সত্য হোক কিংবা গুরুত্বপূর্ণ।

আসলে সত্যিটা হলো, একটা রাষ্ট্র তার ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে স্বাধীন হলেও সেখানকার মানুষগুলো কখনোই স্বাধীন নয়। কোনো দেশের মানুষই নন। এই পরাধীনতার ফাঁদ আবার মানুষেরই তৈরি। মানুষ তার রাষ্ট্র, সংবিধান, আইনকানুন, সামাজিক মূল্যবোধ, মতাদর্শ, ধর্ম কিংবা পারিবারিক নিয়ম-কানুন কত কিছুর কাছেই না বন্দি। আর শুধু একটা জায়গায় মানুষ স্বাধীন, মন। বাস্তববাদীরা হয়তো বলবেন, মনের কথা মনে লুকিয়ে রাখলে কী লাভ? তাতে কি-বা আসে যায়। আমি বলি, মানুষ শুধু বাস্তবেই বাঁচে না, কল্পনায়ও বাঁচে। হ্যাঁ, এ সময়ে লেখালেখি করা খুব কঠিন কিছু নয়। বিশেষ করে প্রভাবশালী চিন্তা বা মতাদর্শের পক্ষে বলা বা লেখা সহজই বটে। আর ক্ষমতাসীনদের পক্ষে হলে তো কথাই নেই। মামলা হামলা আদালত অবমাননা কোনো কিছুর ভয় নেই। পেছনে বড় কোনো শক্তি থাকলে বা গুরুত্বপূর্ণ কেউ হয়ে উঠতে পারলে সরকারের বিরুদ্ধেও বলা যায় বৈকি! কিন্তু সাধারণ মানুষ বা যাদের পেছনে কেউ থাকে না, তাদের ছোট্ট একটা কথা বলতেও অনেক ভাবতে হয়। শাসকশ্রেণির হাত অনেক লম্বা বলে কথা!

তবুুও মাঝে মাঝে লিখতে মন চায়। কে ক্ষমতাবান, কে দুর্বল এতসব মাথায় না রেখেও অনেক কিছু বলার থাকে। কিন্তু চারদিক থেকে যখন রাষ্ট্র, ধর্ম, আইন, আদালত, ক্ষমতা, সত্তর কিংবা বত্রিশ ঘিরে থাকে তখন প্রতিটা লেখায় কাটাকুটি খুব বেড়ে যায় অথবা হাত শুধু ডিলিটেই নিতে হয়। প্রতিবাদের ভাষায় পড়তে থাকে আপসের আঁচড়, অন্তত যারা ছাপোষা লেখা লিখতে চান না। অবশ্য সেইসব লেখকরাই নিজেদের স্বাধীন মনে করেন, যারা তাদের স্বাধীনতার সীমারেখা টেনে নেন স্বার্থের কালিতে। আমি এ পর্যন্ত পুরোপুরি স্বাধীনভাবে কিছু লিখতে পেরেছি বলে মনে পড়ে না। বাস্তববাদীরা যখন আবারও বলবেন, সময়ে সময়ে মনুষকে কৌশলীও হতে হয়। তখন জর্জ বার্নাড শ’কে আরেকবার টেনে আনতে চান। উনি বলেছেন, ‘কোনো কিছু প্রত্যাখ্যান করার সেরা উপায় হলো নীরবতা’। তাই কি?

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়-বাংলাদেশ

birpasha2010@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION