বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ১১:২৪ অপরাহ্ন
আনিস আলমগীর:
লাদাখের সীমান্ত বিরোধে অস্ত্র ব্যবহার না করার চুক্তি রয়েছে চীন ও ভারতের মধ্যে। দুই দেশের মধ্যে ১৯৯৬ সালের সমঝোতা অনুসারে, ওই এলাকায় কোনোপক্ষই আগ্নেয়াস্ত্র বা বিস্ফোরক বহন করে না। সে কারণে গত ১৫ জুন উভয়ের মধ্যে যে সংঘাত হয়েছে তাতে পাথর ছোড়াছুড়ি আর হাতাহাতি হয়েছে। আর ভারত জানিয়েছে, ২০ জন সৈন্য নিহত হওয়ার পাশাপাশি তাদের ৭৬ জন আহত হয়েছে, তবে চীন তাদের সৈন্য হতাহতের ব্যাপারে কোনো তথ্য জানায়নি।
গত কয়দিন ধরে উভয়ের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলছে আর সৈন্য সরানোর কথাও হয়েছে কিন্তু সীমান্ত থেকে কেউ সৈন্য সরায়নি বরঞ্চ রিইনফোর্সমেন্ট হয়েছে এবং সমরাস্ত্রের মজুতও দুই পক্ষ বাড়িয়েছে। ভারত এখন তার সেনাদের হাতাহাতি পরিহার করে প্রয়োজনে অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। সুতরাং ভবিষ্যতে পুনরায় সীমান্ত সংঘর্ষ হলে ভয়াবহ আকারের হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে। ভারত, চীন ও রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রীরা মস্কোতে রাশিয়ার ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে একত্র হয়েছিল কিন্তু রাশিয়া এর মধ্যে কোনো বৈঠকের আয়োজন করেনি। উভয় রাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। রাশিয়া ইচ্ছে করলে বৈঠকের আয়োজন করতে পারতো।
১৯৬২ সালের পর চীন ভারতের মধ্যে কোনো নিয়মিত যুদ্ধ হয়নি কিন্তু বর্তমান লাদাখ সীমান্তে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে যেকোনো পক্ষের সামান্য ভুল সিদ্ধান্তের কারণে একটি নিয়মিত যুদ্ধের সূচনা হতে পারে। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, যুদ্ধ হবে না সে কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। অস্ট্রিয়ার যুবরাজের এক ঘটনাকে উপলক্ষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল। ঐতিহাসিকভাবে হিমালয় অঞ্চলের গালওয়ান উপত্যকায় চীন এবং ভারত উভয়ের চিহ্নিত কোনো সীমানা নেই। তারা উভয়ে এই অঞ্চলটি তাদের বলে দাবি করে।
লাদাখ একসময় কাশ্মিরের অংশ ছিল। লাদাখের একটা স্ট্যাটেজিক গুরুত্ব রয়েছে সেই কারণে লাদাখকে ভারত সরকার কাশ্মির থেকে পৃথক করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করেছে। ৫৯ হাজার ১৪৬ বর্গকিলোমিটার অধ্যুষিত লাদাখে জনবসতি খুবই কম। তিন লক্ষ মানুষ মাত্র। অর্ধেক মুসলমান আর অর্ধেক লামা বৌদ্ধ। লাদাখের পরই তিব্বত। তিব্বতের পর চীনের জিনজিয়াং প্রদেশ। জিনজিয়াংয়ের উইঘুর মুসলমান নিয়ে চীনের সঙ্গে একটা চলমান বিরোধ আছে। উইঘুর মুসলমানরা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত।
আমেরিকা উইঘুর মুসলমান নিয়ে খেলতে চায়। আমেরিকা সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙে দিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছে। এখন সোভিয়েতের পর দৃশ্যপটে এসেছে চীন। চীনকে ভাঙার পাঁয়তারাও আছে। আমেরিকা চীনের উত্থানের পর আমেরিকা তার আটলান্টিকের নৌশক্তি ৬০% প্রশান্ত মহাসাগরে নিয়ে এসেছে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় আমেরিকার মিত্র। ভারতও আমেরিকার মিত্র। ভারতকে শক্তিশালী করতে পারলে আমেরিকারই লাভ। আর এটা হচ্ছে আমেরিকার ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির অংশ। আমেরিকার লক্ষ হচ্ছে চীনকে ঘিরে ফেলা, চীনকে ভেঙে ফেলা।
দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের আধিপত্যকে জাপান, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়াকে দিয়ে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ভারতের সামরিক চুক্তি রয়েছে। অস্ট্রেলিয়া ভারতের যেকোনো বিমানঘাঁটি ব্যবহার করতে পারবে। আবার একই সামরিক চুক্তি আমেরিকার সঙ্গে ভারতের হয়েছে। ভারত আবার ভিয়েতনামের সঙ্গে সামরিক চুক্তি করেছে। ভারত মরিশাসে নৌঘাঁটি স্থাপনের চুক্তি করেছে। দেখা যাচ্ছে, চীনকে লক্ষ্য করে আমেরিকার ইন্ধনে প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় ধীরে ধীরে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হচ্ছে। আসলে এখনকার লাদাখে চীন-ভারত সীমান্ত বিরোধ তারই একটি অংশ।
আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তারা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সৈন্য সমাবেশ ঘটাবে তাদের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রয়োজনে। ন্যাটোর সদর দপ্তর থেকে এই সৈন্য নাকি আনা হবে। ভারত এতদিন পাকিস্তানকে তার প্রতিপক্ষ হিসেবে চিন্তা করত কিন্তু নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ভারত এখন চীনকে তার প্রতিপক্ষ স্থির করেছে। নরেন্দ্র মোদি উচ্চবিলাসী মানুষ। যে কারণে চীন সীমান্তে ভারত যোগাযোগব্যবস্থা উন্নয়নের কাজ করেছে। ভারতের কোনো কোনো সামরিক অফিসারও ১৯৬২ সালের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার অভিলাষ ব্যক্ত করেছেন।
ভারতের সামরিক শক্তি সামর্থ্য ১৯৬২ সালের পর্যায়ে নেই । চীনেরও একই অবস্থা। উভয় রাষ্ট্র এখন আণবিক শক্তির অধিকারী। আগামী নভেম্বরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্প কিংবা জো-বাইডেন যে নির্বাচিত হোক- চীনকে সাইজ করার ব্যাপারে কারও কোনো শিথিলতা দেখানোর অবকাশ থাকবে না। আমেরিকা কখনও চাইবে না ক্ষমতার বলয় দক্ষিণ এশিয়ার হাতে চলে আসুক।
চীনের আর্থিক অগ্রগতি জাপান, তাইওয়ান সবারই গাত্রদাহের কারণ হয়েছে। সাংহাইয়ের ইপিজেড থেকে তারা তাদের শিল্পকারখানা সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চীনের ব্যবসাকে প্রতিরোধ করার এই প্রচেষ্টার কারণে চীন তার বাণিজ্যনীতির পুনর্বিন্যাস করবে নিশ্চয়ই। এর সঙ্গে তার সামরিক ব্যবস্থা হয়তো পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন হবে। সুতরাং ব্যবসায়িক স্বার্থের সংঘাত সূচনা হলে তার সামরিক সংঘাতে গড়াবে না এই কথা নিশ্চিত বলা মুশকিল।
করোনার কারণে বিশ্বকে আর্থিক মন্দার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সুতরাং এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যবস্থার একটা আমূল পরিবর্তন আসবে। এই পরিবর্তনটা সম্মিলিত প্রচেষ্টার মধ্যে হলে বিশ্ব উপকৃত হতো। কিন্তু কোনো সম্মিলিত প্রচেষ্টার কোনো উদ্যোগ এই পরিবর্তনে আসবে বলে মনে হচ্ছে না। এইখানেও একটি সংঘাতের বাতাবরণ তৈরি হতে পারে এবং বিশ্ব পুনরায় দুই ব্লকে বিভক্ত হয়ে থাকবে।
যাই হোক আমেরিকার দীর্ঘ প্রচেষ্টার ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙেছে। এখন চীনকে ভাঙার উদ্যোগ সফল করতে হলে আমেরিকার ভারতের সহযোগিতার প্রয়োজন। মনে হয় সেই সহযোগিতা প্রদানে ভারত মানসিকভাবে প্রস্তুত। দীর্ঘসময় ভারত চীন সীমান্তের যোগাযোগব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটাচ্ছে যা চীন ভালো চোখে দেখার কথা নয়।
১৯৬২ সালে চীন ভারত যুদ্ধে ভারতের পরাজয়ের পর থেকে ভারত ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ভারতের সে প্রস্তুতি কতটুকু মজবুত ও ব্যাপক তার কোনো পরীক্ষা চীন কখনো করেনি। এবার লাদাখ সীমান্তে চীন সম্ভবত তার পরীক্ষা করছে। সুতরাং সব মিলিয়ে ভারত-চীন সীমান্তে সংঘাত সহজে মিটবে বলে মনে হচ্ছে না।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
anisalamgir@gmail.com