বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫, ০২:৪৩ পূর্বাহ্ন
মুহাম্মাদ ইমাম হাসান:
কোনো বাধা ছাড়াই মুসলিম সেনাবাহিনীর বিজয়ী কাফেলা মক্কায় প্রবেশ করে। বিজয়ের পতাকা উড়ছে এখন মুসলিম সেনাপতির হাতে। আজ কোনো কাফেরের সাহস হলো না তাদের সামনে দাঁড়িয়ে বাধা দেওয়ার। ইকরিমা ইবনে আবি জাহেল শুরুতে কিছুটা বাধা দিলেও তার দুর্ভাগ্য যে, সেখানে উপস্থিত ছিলেন আল্লাহর তরবারি খ্যাত খালেদ বিন ওয়ালিদ (রা.)। তাই রণক্ষেত্র তার আনুকূল্য হয়নি। ত্রিশজন সঙ্গীর লাশ ফেলে সে পলায়ন করে।
বিজয়ী কাফেলার সঙ্গে মক্কায় প্রবেশ করেন হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তার সামনে এখন অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে আছে মক্কার কুরাইশ কাফেররা। অতীতের সব অপরাধ একে একে তাদের মনে পড়ছে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে তারা কতই না কষ্ট দিয়েছে। তাদের কেউ আল্লাহর রাসুলের চলার পথে কাঁটা বিছিয়েছে। সিজদারত অবস্থায় কেউ তার পিঠের ওপর ময়লা-আবর্জনা চাপিয়ে দিয়েছে। কত নির্মমভাবে তার পরিবারকে তিন বছর পর্যন্ত বয়কট করে রেখেছিল। তায়েফ থেকে ফিরে আসার পর তারা মক্কায় প্রবেশে বাধা দিয়েছিল। আর সর্বশেষ যারা হিজরতের রাতে তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল তারা সবাই আজ তার সামনে সমবেত।
সবাই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কারও মুখে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত নেই। সকার চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ। কারণ সবার জীবন-মরণ এখন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তরবারির নিচে। সবাই ভয়ে আতঙ্কিত। এখন তাদের সঙ্গে কী হতে যাচ্ছে? মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি প্রতিশোধ নেবেন? তিনি যদি প্রতিশোধ নেন তাহলে আজ কেউই বাঁচতে পারবে না।
রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, আমার প্রতি তোমাদের কী ধারণা? তারা উত্তর দিল, আমরা আপনার থেকে উত্তম কিছু আশা করি। কারণ আপনি তো এক মহান ব্যক্তি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন যাও, তোমাদের সবাইকে ক্ষমা করে দেওয়া হলো। তোমাদের কারও ওপর আমার কোনো অভিযোগ নেই। আজকের দিন ক্ষমার দিন, প্রতিশোধের দিন নয়।
ইকরিমা ইবনে আবু জাহেল একমাত্র সেই ব্যক্তি, যে মক্কা বিজয়ের দিনও মুসলমানদের ওপর হামলা করেছিল। তার স্ত্রী রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে তার নিরাপত্তা কামনা করলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তার সব কিছু ভুলে গিয়ে তাকে ক্ষমা করে দিলেন। পরবর্তী সময় ইকরিমা হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর ইকরিমা (রা.) বিভিন্ন যুদ্ধের ময়দানে অত্যন্ত বীরত্ব ও সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করেন। এভাবে লড়তে লড়তে তিনি শাহাদাতবরণ করেছিলেন। প্রিয় পাঠক, একটু চিন্তা করে দেখুন, রাসুলুল্লাহ (সা.) যদি তার সঙ্গে ইনসাফের মুয়ামালা করতেন (অর্থাৎ তার অপরাধের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দিতেন), তাহলে তার অবস্থা কেমন হতো? হাব্বার নামক এক ব্যক্তির অপরাধ ছিল অত্যন্ত গুরুতর। নবীজির কন্যা হজরত জয়নব (রা.) অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় যখন মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করে যাচ্ছিলেন তখন হাব্বার তার ওপর বর্শা নিক্ষেপ করে। তিনি সওয়ারি থেকে পড়ে যান। কোনো কোনো বর্ণনা মতে, এ অবস্থায় গর্ভপাত হয়ে তার মৃত্যু হয়। এই অপরাধও রাসুলুল্লাহ (সা.) ক্ষমার অযোগ্য মনে করলেন না।
কবি কাব বিন জুহাইর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নামে খারাপ ও অশ্লীল কবিতা রচনা করত। সেসব কবিতা কাফের কুরাইশদের অনেক আনন্দ দিত। মুসলমানদের অন্তরকে করত ক্ষত-বিক্ষত। রাসুলুল্লাহ তাকেও ক্ষমা করে দিলেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রিয় চাচা আমির হামজার হত্যাকারী ছিল ওয়াহশি। সে যখন নবীজির সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন তিনি বলেন, তুমি কি সেই ওয়াহশি? লজ্জায় তার মাথা অবনত হয়ে আসে। সে বলে, হে আল্লাহর রাসুল, আমিই সেই দুর্ভাগা। এরপর সে ইসলাম গ্রহণ করে। নবীজি তার ইসলাম গ্রহণে সন্তোষ প্রকাশ করেন। তাকে বলেন, তুমি কখনো আমার সামনে এসে দাঁড়াবে না। তাতে তোমার অকল্যাণ হতে পারে। এরপর থেকে ওয়াহশি নবীজির সামনে কখনো আসেননি এবং তিনি কখনো হাসেননি। তিনি শুধু সেদিন হেসেছিলেন যেদিন মিথ্যা নবুওতের দাবিদার মুসাইলামাতুল কাযযাবকে হত্যা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, নবীজির সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিকে যেমন আমি হত্যা করেছিলাম, আজ তার সবচেয়ে বড় দুশমনকে হত্যা করে সেটার প্রতিশোধ নিলাম।
সর্বশেষ হিন্দার পালা। পৃথিবীতে মাতৃত্বের ইতিহাসে এমন কলঙ্কিত নারীও হতে পারে? যে একজন পুরুষের কলিজা চিবিয়ে খেতে পারে? সে নবীজির প্রিয় চাচা আমির হামজার কলিজা চিবিয়েছিল। সে তো মনে মনে ভেবেছিল, সবার ক্ষমা হলেও হয়তো তার আজ কোনো ক্ষমা নেই। সে কীভাবে আজ নবীজির সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চাইবে? কিন্তু নবীজির পবিত্র মুখের হাসি দেখে সে বুঝতে পারল, ক্ষমার দরজা তার জন্যও আজ খোলা। রাসুলুল্লাহ (সা.) যে উটের ওপর আরোহণ করে মক্কায় প্রবেশ করেন, সেটার নাম ছিল ‘কাছওয়া’। তার সহযাত্রী ছিলেন উসামা বিন যায়েদ। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মাথায় ছিল কালো পাগড়ি। মুখে ছিল না বিজয়ের হাসি। মুখে ছিল শুধু ক্ষমার উজ্জ্বল দীপ্তি। চোখে ছিল আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতার অশ্রুর ঝিলিক। এভাবেই রাসুলুল্লাহ (সা.) সবাইকে ক্ষমা করতে করতে বিজয় উৎসব পালন করেন।
আজ আমরাও বহু রক্তের সাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা এনেছি। বিজয় অর্জনের পর স্বাধীনতাকামী এই ছাত্র-জনতাকে বলতে চাই, অবনত মস্তকে আমাদের এখন দাঁড়াতে হবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সিরাতের সামনে, তাহলে বুঝতে পারব কেন প্রতিবাদ করব, কীভাবে প্রতিবাদ করব এবং জয় লাভের পর কীভাবে বিজয় উদযাপন করব।
ভয়েস/আআ