শনিবার, ২৮ Jun ২০২৫, ১২:১৪ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম ও রাজনীতি: আগ্রহ নাকি উদাসীনতা?

ফায়াজুন্নেসা চৌধুরী সুরভী:
রাজনীতি যে একটি জাতির ভবিষ্যৎ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশের ইতিহাসে তরুণদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ সবসময়ই উল্লেখযোগ্য ছিল। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের ‘জুলাই বিপ্লব’ পর্যন্ত।

তবে বর্তমান সময়ে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে রাজনীতির প্রতি আগ্রহ ও উদাসীনতা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আমরা দেখতে পাই। এই প্রেক্ষাপটে তরুণদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, উদাসীনতার কারণ এবং ভবিষ্যতে তাদের ভূমিকা নিয়ে ভেবে দেখা প্রয়োজন।

২০২৪ সালের ‘জুলাই বিপ্লব’ ও তরুণদের ভূমিকা

২০২৪ সালের জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে যে রাজনৈতিক উত্তাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তা বাংলাদেশে এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করে। সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটাব্যবস্থা অনেক তরুণের কাছে অবিচার হিসেবে প্রতিভাত হওয়া এবং এর সংস্কারের দাবি তোলা থেকে শুরু হয় আন্দোলনের সূত্রপাত।

তরুণরা শুরুতে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একত্রিত হয়ে আন্দোলন সংগঠিত করে, যা একসময় রাস্তায় গণবিক্ষোভের রূপ নেয়। সরকার দাবি মেনে নিতে বিলম্ব করায় আন্দোলন আরও বেগবান হয় এবং পুলিশি দমনপীড়নের মুখেও তরুণরা আন্দোলন চালিয়ে যায়। এবং রক্তাক্ত জুলাইয়ের সূচনা হয়। যার ফলাফল আমরা সবাই দেখেছি।

জুলাই বিপ্লব প্রমাণ করে যে:

তরুণরা প্রয়োজনের সময় রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে। প্রয়োজনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও আন্দোলনের নতুন হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।

কোটা সংস্কার ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মতো ইস্যুতে তরুণরা দলীয় রাজনীতির বাইরে গিয়েও ঐক্যবদ্ধ হতে পারে।

তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান ছাত্ররাজনীতিতে লীগ আর দল কে ফ্রিজে রেখেই আজকে লিখতে চাই অন্যদের নিয়ে। শুরুতেই মাথায় আসে কয়েকটা নাম, জাসদ, বাসদ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্রমৈত্রী, ছাত্রশিবির।

বাম রাজনীতির উত্থান ও পতন: মেধাবীদের সরে যাওয়া

একসময় বাংলাদেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা বামপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকত। এখনও রয়েছে কেউ কেউ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ক্যাম্পাসগুলোতে বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ছিল। তাদের মূল দর্শন ছিল সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।

শ্রমিক শ্রেণির অধিকার রক্ষা করা ও শোষণমুক্ত রাষ্ট্র গঠন করা।

তবে, ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বৈশ্বিক রাজনীতির পরিবর্তনের ফলে বাম রাজনীতির ভিত্তি দুর্বল হয়ে যায়। মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং বিশ্বায়নের ফলে বামপন্থী রাজনৈতিক আদর্শ জনপ্রিয়তা অনেকটাই হারিয়ে ফেলে। ফলস্বরূপ, মেধাবী শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ ক্যারিয়ার ও ব্যক্তিগত উন্নতির দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং রাজনীতিতে আগ্রহ হারায়।

ছাত্রশিবির ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিতর্কিত অবস্থান

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরেও বহু মেধাবী শিক্ষার্থী যুক্ত হয়েছে, বিশেষ করে মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী একসময় এই সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত ছিল যার প্রধান কারণ ছিল ধর্মীয় মতাদর্শকে ভিত্তি করে এই সংগঠন বীজ বপণ করেছিলো। তবে সময়ের সাথে সাথে সংগঠনটির কিছু বিতর্কিত কর্মকাণ্ড এবং উগ্রবাদী ভাবমূর্তির কারণে এটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। যেখানে প্রধান সমস্যাগুলো ছিল ক্যাম্পাসে সহিংস রাজনীতি ও প্রতিপক্ষের ওপর আক্রমণ ও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ। এছাড়াও সরকারবিরোধী কার্যকলাপে অংশগ্রহণ ও উগ্রপন্থী কার্যকলাপের অভিযোগ।

ফলস্বরূপ, সংগঠনটির প্রতি সাধারণ তরুণদের আস্থা কমেছে এবং তারা রাজনীতির মূলধারায় থাকার চেয়ে দূরে থাকার প্রবণতা দেখিয়েছে।

তরুণদের রাজনীতিতে লোভের প্রবণতা ও দুর্বল নেতৃত্ব

বর্তমানে যারা ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত হচ্ছে, তাদের অনেকেই মূলত ব্যক্তিস্বার্থের দিকে বেশি ঝুঁকছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে হল দখল ও সিট বাণিজ্য, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি আবার প্রশাসনের সাথে যোগসাজশ করে ক্ষমতা বজায় রাখার মতো কার্যকলাপ করার কারণে মেধাবীরা রাজনীতি থেকে আরও দূরে সরে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্য এক বড় সংকট সৃষ্টির দিকেই ধাবিত হচ্ছে।

জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ: তরুণদের নতুন উদ্যোগ

২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তরুণদের উদ্যোগে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটলো। এই দলটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির যৌথ উদ্যোগে গঠিত, যা ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।

গণতান্ত্রিক, সমতাভিত্তিক ও জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া, রাজনীতিতে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অবসান ঘটানো এবং নতুন সংবিধানের মাধ্যমে রাষ্ট্র পুনর্গঠন করাই এই দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে তারা বিবেচনা করেছে।

তবে আমরা যদি এই দলের চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে একটু বিস্তর ভেবে দেখি তাহলে জাতীয় নাগরিক পার্টির সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে, যেমন: সারাদেশে সংগঠন বিস্তার করা।

বিদ্যমান বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করা।

এছাড়া সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, জনগণের আস্থা অর্জন করা।

তবুও সবকিছু ছাপিয়ে ওদের জন্য শুভকামনা।

তরুণদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করার উপায়

তরুণদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করতে হলে শুধু ক্ষমতা বা ব্যক্তিস্বার্থ নয়, বরং ন্যায়বিচার, স্বচ্ছতা ও গণতন্ত্রের ভিত্তিতে একটি ইতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। রাজনীতি হতে হবে জনসেবার মাধ্যম, ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতা নয়।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়া

তরুণদের রাজনৈতিক দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করতে হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নৈতিক রাজনীতি ও গণতন্ত্র বিষয়ক শিক্ষার ব্যবস্থা করা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ইতিবাচক দিক, গণতন্ত্রের মৌলিক মূল্যবোধ, এবং দায়িত্বশীল নেতৃত্ব গঠনের ওপর গুরুত্বারোপ করে বিশেষ পাঠক্রম চালু করা যেতে পারে। এতে শিক্ষার্থীরা রাজনীতিকে শুধু ক্ষমতা অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে নয়, বরং সমাজ পরিবর্তনের শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে দেখতে শিখবে।

ছাত্ররাজনীতির সংস্কার: গঠনমূলক নেতৃত্বের দিকে এগিয়ে যাওয়া

ছাত্ররাজনীতি দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গঠনের গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম। তবে বর্তমান সময়ে ছাত্ররাজনীতির গুণগত পরিবর্তন আনতে হলে দখলদারি, সহিংসতা এবং অযোগ্য নেতৃত্বের আধিপত্য দূর করতে হবে। ক্যাম্পাসগুলোকে দলীয় স্বার্থের চেয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশের প্রতি অধিক মনোযোগী করতে হবে।

প্রথমত, দখলদারি ও সহিংসতা বন্ধ করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে পারে এবং একাডেমিক কার্যক্রম নির্বিঘ্ন থাকে।

দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলোর সরাসরি হস্তক্ষেপ কমিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে হবে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্ব নির্বাচন মেধা ও নেতৃত্বগুণের ভিত্তিতে হওয়া উচিত, যেখানে যোগ্যতা, সততা ও দূরদর্শিতা থাকবে প্রধান বিবেচ্য বিষয়। দলীয় আনুগত্যের পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত প্রতিনিধি নির্বাচিত হলে ছাত্ররাজনীতি ইতিবাচক পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যাবে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হবে।

পরিবর্তন কি সম্ভব?

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তরুণদের ওপর। তারা চাইলে দেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। তবে সেই পরিবর্তন শুধুমাত্র তখনই সম্ভব, যখন তারা নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে অগ্রাধিকার দেবে। তরুণদের জন্য দরকার একটি পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক পরিবেশ, যেখানে তারা কোনও দলীয় স্বার্থের শিকার হবে না, বরং জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি হয়ে উঠবে।

প্রশ্ন হচ্ছে—তরুণরা কি সত্যিই নিজেদের রাজনৈতিক দায়িত্ব বুঝতে পারবে এবং রাজনীতিতে শুদ্ধতার এক নতুন অধ্যায় শুরু করতে পারবে? নাকি তারা আগের মতোই রাজনৈতিক অসততা ও সুবিধাবাদিতার বলি হবে?

সময়ই এই প্রশ্নের উত্তর দেবে, তবে ইতিহাস সাক্ষী—যখনই প্রয়োজন হয়েছে, তরুণরাই পথ দেখিয়েছে।

লেখক: শিক্ষক, ডিপার্টমেন্ট অফ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।

ভয়েস/আআ/সূত্র: বাংলাট্রিবিউন

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION