শনিবার, ২৮ Jun ২০২৫, ০১:১৬ পূর্বাহ্ন
মুহাম্মদ মনিরুজ্জামান:
অহংকার মানবজীবনের এমন এক মারাত্মক ব্যাধি, যা মানুষকে ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করে। এটি নিছক কোনো আচরণগত প্রবণতা নয়, বরং আত্মার অন্তস্তলে লুকিয়ে থাকা এক অব্যক্ত বিকৃতি, যা ধীরে ধীরে মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতিকে কলুষিত করে তোলে। যখন কোনো ব্যক্তি নিজেকে অন্যদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ, ক্ষমতাবান বা অধিক মর্যাদার অধিকারী মনে করে, তখন সে এক ধরনের ভ্রান্ত অহমবোধে আক্রান্ত হয়। এই অহমবোধই তাকে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ভুলিয়ে দিয়ে আত্মমগ্নতায় নিমজ্জিত করে, যার পরিণতিতে সে ইমানের সৌন্দর্য হারায় এবং ইবাদতের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়।
কোরআনুল কারিমে আল্লাহতায়ালা অহংকার করাকে ঘৃণ্য কাজ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং অহংকারকারীদের পরিণতি সম্পর্কে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও অহংকারের বিপদ, এর পরিণতি ও নিষিদ্ধতা সম্পর্কে বহু হাদিসে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, অন্তরে অণু পরিমাণ অহংকার থাকলে জান্নাতে প্রবেশ সম্ভব নয়। এই ভয়াবহ পরিণতি আমাদের জানিয়ে দেয় যে, অহংকার কেবল একটি নৈতিক ত্রুটি নয়, বরং তা আখেরাতের মুক্তিকে বাধাগ্রস্তকারী চরম আত্মিক ব্যাধি।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যেসব জাতি, শাসক বা ব্যক্তি অহংকার ও দাম্ভিকতায় আচ্ছন্ন হয়েছিল, তারা কেউই স্থায়ীভাবে টিকে থাকতে পারেনি। কারুন, ফেরাউন, নমরুদ প্রমুখ শক্তিশালী ব্যক্তি ও সাম্রাজ্যের পতনের মূল কারণ ছিল অহংকার। তারা মহান আল্লাহর দেওয়া নেয়ামতকে নিজেদের প্রাপ্য মনে করে উদ্ধত আচরণ শুরু করে দিয়েছিল, যার শাস্তি হিসেবে মহান আল্লাহ দুনিয়াতেই তাদের লাঞ্ছিত করেছেন এবং আখেরাতেও কঠিন শাস্তির ঘোষণা দিয়েছেন।
অহংকার শুধু অন্যকে তুচ্ছ জ্ঞান করাই নয়, বরং মহান আল্লাহর দয়াকে অস্বীকার করাও বটে। মানুষ যখন নিজের বুদ্ধি, ধন-সম্পদ ক্ষমতা বা প্রভাবকে নিজের অর্জন মনে করে এবং অন্যদের তুলনায় নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবতে শুরু করে, তখনই অহংকার জন্ম নেয়। অথচ একজন মুমিনের বৈশিষ্ট্য হলো বিনয় ও নম্রতা অবলম্বন করা। সে সব সময় বুঝে যে, তার অর্জন যা কিছু, তা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত একেকটি নেয়ামত মাত্র। এখানে কোরআন-হাদিসের আলোকে অহংকারের পরিচয়, এর ক্ষতিকর দিক, এর কারণ ও প্রতিকার এবং অহংকারীদের পরিণতি সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণী উল্লেখ করা হলো।
নিজেকে অন্যের তুলনায় ক্ষমতাধর কিংবা বড় মনে করার মানসিকতাকে অহংকার বলে। এটি একটি তীব্র মানসিক অনুভূতি, যা মানুষের কথা ও কাজের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। মহান আল্লাহ সবাইকে ধন-সম্পদ, ক্ষমতা ও যোগ্যতা সমানভাবে দেন না। কাউকে দেন বেশি, কাউকে দেন কম। মানুষের উচিত হলো মহান আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। মানুষ যখন মহান আল্লাহর নেয়ামতের কথা ভুলে এটাকে নিজের সম্পদ মনে করে, তখনই অহংকারের সূত্রপাত হয়। আর এ অহংকারের কারণে মহান আল্লাহর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়।
কোরআন ও হাদিসে অহংকারী মানুষের পরিণতি ও শাস্তি প্রসঙ্গে অনেক বর্ণনা রয়েছে। মহান আল্লাহ কোনো অহংকারীকে পছন্দ করেন না। অহংকার প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ এমন লোককে পছন্দ করেন না, যে বড় হওয়ার গৌরব ও অহংকার করে।’ (সুরা নিসা ৩৬) কোরআনের অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে রেখে কথা বলো না এবং পৃথিবীতে গর্বের সঙ্গে চলবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো বড়াইকারী ও অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা লোকমান, আয়াত ১৮)
অহংকারীর সর্বশেষ পরিণতি হলো জাহান্নাম। কেননা সে অহংকারের মাধ্যমে মহান আল্লাহর অধীনতা থেকে নিজেকে মুক্ত করে বেপরোয়া হয়ে যায়। নিজেকে অনেক বড়, ক্ষমতাবান ও শক্তিশালী মনে করে এবং মানুষকে অবজ্ঞা ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। বিষয়টি হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত এক হাদিসের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে যায়। হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহংকার রয়েছে সে বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না। এক ব্যক্তি বললেন, কোনো ব্যক্তি পছন্দ করে তার কাপড় সুন্দর হোক, তার জুতা সুন্দর হোক (তাও কি অহংকার?)। হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ সুন্দর এবং তিনি সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন। প্রকৃতপক্ষে অহংকার হলো, মহান আল্লাহর গোলামি থেকে বেপরোয়া হওয়া এবং মানুষকে অবজ্ঞা করা।’ (সহিহ মুসলিম) অন্য হাদিসে আরও ইরশাদ হয়েছে, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘অহংকারী ও অহংকারের মিথ্যা ভানকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (আবু দাউদ)
মহান আল্লাহ অহংকারের শাস্তি শুধু আখেরাতে নয়, দুনিয়াতেও দিয়ে থাকেন। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আগেকার অনেক জাতি ধন-সম্পদ ও শাসনক্ষমতা নিয়ে অহংকার ও বাড়াবাড়ি করার কারণে মহান আল্লাহ দুনিয়াতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করেছেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘এমন কত জনপদ আমি ধ্বংস করে দিয়েছি, সেখানকার লোকেরা ধন-সম্পদের অহংকার করত। এই যে তাদের বাড়িঘর পড়ে আছে, যেখানে তাদের পর কম লোকই বসবাস করেছে। শেষ পর্যন্ত আমিই (এসবের) মালিক রয়েছি।’ (সুরা কাসাস ৫৮)
কোরআন ও হাদিসে পূর্ববর্তী বিভিন্ন সম্প্রদায় ধ্বংসের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। পূর্ববর্তী অনেক শাসক ও ক্ষমতাধররা অহংকার করায় মহান আল্লাহ তাদের সমুচিত শিক্ষা দিয়েছেন। তাদের এসব করুণ পরিণতির ইতিহাস বিশ্ববাসীর জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। তাই তো ফেরাউন, কারুন ও নমরুদের মতো নামগুলোকে আজও মানুষ ঘৃণাভরে স্মরণ করে।
প্রকৃত মুমিন ব্যক্তি যেকোনো অবস্থায় গর্ব ও অহংকার পরিত্যাগ করবে। তাদের কথা, কাজ ও আচরণে কখনো অহংকার নয় বরং বিনয় প্রকাশ পাবে। মুমিনদের উদ্দেশে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলছেন, ‘মাটির বুকে গর্বের সঙ্গে চলবে না। নিশ্চয়ই তুমি কখনো পদচাপে জমিনকে বিদীর্ণ করতে পারবে না। আর পাহাড়ের সমান উঁচুও হতে পারবে না।’ (সুরা বনি ইসরাইল ৩৭)
অনেক মানুষ আছে যারা দামি ও মূল্যবান পোশাক পরিধান করে অহংকার প্রকাশ করে থাকে। তাদের বিষয়ে হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি অহংকারবশত স্বীয় বস্ত্র মাটির ওপর দিয়ে টেনে চলে, কেয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তার দিকে তাকাবেন না। তখন হজরত আবু বকর (রা.) বলেন, আমার লুঙ্গি অসতর্ক অবস্থায় ঢিলা হয়ে পায়ের গিরার নিচে চলে যায়, যদি না আমি তা ভালোভাবে বেঁধে রাখি। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তুমি তা অহংকারবশত করো না।’ (সহিহ বুখারি)
অহংকার মানুষের ইবাদতকে নষ্ট করে দেয়। অহংকার থেকে বাঁচতে আল্লাহ প্রদত্ত ধন-সম্পদ, জ্ঞান ও যোগ্যতাকে আল্লাহ প্রদত্ত দয়া, রহমত ও নেয়ামত ভেবে তার শুকরিয়া আদায় করতে হবে। আর যে ব্যক্তি এসব নেয়ামত পাননি তার জন্য মহান রবের দরবারে দোয়া করতে হবে, যাতে আল্লাহ তাকেও এসব নেয়ামত দান করেন। আর এ মানসিকতা পোষণ করতে হবে, আমি যে ইবাদত-বন্দেগি করছি তা আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতের তুলনায় অতি নগণ্য। কাজেই আমার তৃপ্ত হওয়ার কিছু নেই। আল্লাহ প্রদত্ত এ নেয়ামত যেকোনো মুহূর্তে ছিনিয়ে নিতে পারেন। তিনি একজন বাদশাহকে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ফকিরে পরিণত করতে পারেন। তাই আসুন অহংকারমুক্ত জীবন গড়ে দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতা অর্জন করি।
ভয়েস/আআ