শনিবার, ২৮ Jun ২০২৫, ১২:০৮ পূর্বাহ্ন
আতিকুর রহমান:
ইতিহাসের পাতায় এমন কিছু চিঠি আছে যেগুলো সভ্যতা, নৈতিক দর্শন ও অনন্য নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক। ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলি ইবনে আবু তালিব (রা.)-এর লেখা চিঠিগুলো এ রকমই অতুলনীয় সম্পদ, যেগুলো সময়ের পরিক্রমায় হারিয়ে যায়নি, বরং হয়ে উঠেছে নেতৃত্ব, প্রশাসন ও ন্যায়ের অনন্ত অনুপ্রেরণা। তার চিন্তা-চেতনা, শাসনদর্শন ও মানবিক মূল্যবোধের স্বাক্ষর বহন করে সেসব চিঠি, বিশেষ করে মালিক আল-আশতারকে উদ্দেশ্য করে রচিত তার ঐতিহাসিক পত্রটি।
এই পত্র কেবল প্রশাসনিক আদেশ নয়, এটি এক নৈতিক সনদ, যেখানে সংবেদনশীলতা, শাসনের জবাবদিহি, জনগণের প্রতি দয়া ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা স্পষ্টভাবে বিবৃত হয়েছে। এমনকি জাতিসংঘও এই পত্রের গভীরতা ও তাৎপর্য অনুধাবন করে একে ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তা, প্রশাসনিক কাঠামো ও গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে এই পত্রের ভাবনা বিস্ময়করভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ।
যে সময়ে রাজনৈতিক নেতারা অধিকাংশই ক্ষমতা, প্রভাব ও স্বার্থের বৃত্তে আবদ্ধ, সেই সময়ে আলি (রা.)-এর নেতৃত্বজ্ঞান ও শাসনদর্শন এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হতে পারে। তিনি শাসনব্যবস্থাকে দায়িত্ব ও আমানতের প্রতীকরূপে দেখেছেন, যেখানে জনগণ শাসনের কেন্দ্রবিন্দু, আর ন্যায়বিচার তার মূল ভিত্তি। তার শিক্ষা, সুবিচার, পরামর্শ, বিনয়, দুর্নীতিবিরোধিতা ও দরিদ্রের অধিকার রক্ষার বিষয়টি আজকের যুগেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়।
আধুনিক গবেষণা ও প্রায়োগিক প্রেক্ষাপটেও মালিক আল-আশতারকে লেখা তার পত্রের তাৎপর্য বহাল রয়েছে। ২০০২ সালে জাতিসংঘের একটি ফোরামে এই পত্রকে ইতিহাসের এক অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যেখানে ন্যায় ও জনসেবার মৌলিক ধারণা তুলে ধরা হয়।
বিশ্ব জুড়ে ফেডারেলিস্ট পেপারস ও ম্যাগনা কার্টার মতো গুরুত্বপূর্ণ নথিগুলোর সঙ্গে এই চিঠিকেও নৈতিক নেতৃত্বের অনুশীলনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ইসলামি কিংবা অন্য কোনো প্রেক্ষাপটে নেতৃত্ব গঠনের পাঠক্রমে এটি ব্যবহৃত হচ্ছে নৈতিক নেতৃত্বের বিকাশে সহায়ক হিসাবে।
এই পত্রে ইসলামি প্রশাসনের ন্যায়বিচারের মূলনীতি সংক্ষেপে উপস্থাপিত হয়েছে। এতে শাসকদের কর্তব্য, দায়িত্ব, অধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সচিব ও অধীনস্ত কর্মচারীদের তদারকি, প্রশাসনিক বিভাগের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন, পারস্পরিক সমন্বয় ও কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার বিষয়ে দিকনির্দেশনা রয়েছে।
আধুনিক বিচারব্যবস্থার মতোই এই চিঠিতেও ন্যায়, নিরপেক্ষতা ও আইনের শাসনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, যা সমকালীন গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মূলভিত্তি। আলি (রা.) স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘শাসনের ভিত্তি হোক ন্যায়বিচার’, যা আধুনিক বিচার চিন্তার সঙ্গে সরাসরি মিলে যায়।
তিনি মালিককে পরামর্শ দেন যেন দুর্বল ও শক্তিশালী উভয়ের অধিকার সমান গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়। সমাজ, ধর্ম বা অর্থনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে সবার প্রতি সুবিচার ও সম্মানের আচরণ করা হোক, এমন নীতির প্রচার করেছেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘সাধারণ মানুষই হোক শাসনের শক্তির মূল উৎস’, এই দৃষ্টিভঙ্গি আজকের অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজিএস) ও মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার (ইউডিএইচআর) সঙ্গে এর মিল রয়েছে।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) তথ্যানুযায়ী, কানাডা ও নেদারল্যান্ডসের মতো দেশগুলো অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিতে বিশ্বাস করে, তারা মানব উন্নয়ন সূচকে (এইচডিআই) অধিকতর উন্নত। এর বিপরীতে যেসব দেশে সামাজিক বৈষম্য প্রবল, সেখানে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পায়, যা আলি (রা.)-এর নীতিকে বাস্তবিকভাবে যথার্থ প্রমাণ করে।
হজরত আলি (রা.)-এর সততা, জবাবদিহি ও স্বজনপ্রীতি পরিহারের প্রতি গুরুত্ব আরোপ আধুনিক নেতৃত্বনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তিনি মালিককে সতর্ক করে বলেন, যেন কখনো ক্ষমতার অপব্যবহার না হয় এবং শাসন যেন দম্ভের না হয়, বরং এক পবিত্র আমানত হিসেবে বিবেচিত হয়।
এই নীতিগুলো আজকের আন্তর্জাতিক সনদ ও দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা যেমন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের আদর্শের সঙ্গে মিলে যায়। ফিনল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের মতো দেশগুলোর স্বচ্ছ প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে ইতিবাচক উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হয়। বিপরীতে দুর্বল জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থার দেশগুলোতে দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা ব্যাপক হারে দেখা যায়।
অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারও তার পত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। হজরত আলি (রা.) ধনসম্পদের কেন্দ্রীকরণ সম্পর্কে সতর্ক করে দেন এবং দুর্বল ও দরিদ্রদের অধিকার সংরক্ষণের বিষয়ে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেন।
তিনি সম্পদের ন্যায্য বণ্টনের পক্ষপাতী ছিলেন এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব হিসেবে জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করার কথা বলেন। স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলো যেমন সুইডেন, নরওয়েতে শক্তিশালী কল্যাণব্যবস্থা চালু রয়েছে, যা হজরত আলি (রা.)-এর দর্শনের অনুরূপ।
অন্যদিকে যেসব দেশে ধন-সম্পদের অসম বণ্টন প্রবল, সেখানে প্রায়ই সামাজিক অস্থিরতা দেখা যায়, যা এই চিঠির তাৎপর্যকে আবারও প্রতিষ্ঠা করে।
তিনি আরও বলেন, শাসকদের উচিত পরামর্শ গ্রহণ ও ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। মালিককে তিনি উপদেশ দেন, ‘অহংকার ও আত্মকেন্দ্রিকতা পরিহার করো’ এবং ‘নানা মতামত শোনো’। এই পরামর্শ আজকের গণতন্ত্রের অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থার মতোই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে জনমত জরিপ, গণভোট এবং জাতিসংঘের অংশগ্রহণভিত্তিক সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় প্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে পাকিস্তানের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলোর জন্য এই পত্রটি এক অমূল্য দিকনির্দেশনা, যারা বৈষম্য, দুর্নীতি ও দুর্বল শাসনব্যবস্থার সমস্যায় জর্জরিত। এর মূলনীতিগুলো এসব সমস্যা সমাধানে সহায়ক হতে পারে এবং একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের পথ দেখাতে পারে।
মালিক আল-আশতারের প্রতি হজরত আলি (রা.)-এর পত্র আজও নেতৃত্ব, মানবাধিকার ও আধুনিক প্রশাসনের জন্য এক চিরন্তন পাথেয়। এটি নিছক একটি আদর্শবাদী দলিল নয়, বরং ন্যায়, জবাবদিহি, অন্তর্ভুক্তি ও মানবিকতা, এই মূলনীতিগুলো বাস্তব উদাহরণ দ্বারা প্রমাণিত। এই পত্র এখনো বিশ্বব্যাপী নৈতিক শাসনের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলে এটি
স্বীকৃত। নেতৃত্ব ও নীতির ক্রমবর্ধমান জটিলতা ও নৈতিক সংকটের এই যুগে সুবিচার ও মানবিক সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে হজরত আলি (রা.)-এর শিক্ষা এক উজ্জ্বল বাতিঘর হয়ে রয়েছে। -দ্য মালয় জার্নাল অবলম্বনে
ভয়েস/আআ