মঙ্গলবার, ০৮ Jul ২০২৫, ১২:১৬ পূর্বাহ্ন
মাহফুজা অনন্যা:
শব্দটা ছোট—‘প্রেম’। কিন্তু সমাজের চোখে তার মানে বিশাল, আর পরকীয়া শব্দটা যেন চিৎকার করে ওঠে—দোষ! পাপ! প্রতারণা! তবুও, আমরা অস্বীকার করতে পারি না—সংসার, সন্তান, সামাজিক স্বীকৃতি সব থাকার পরও কেন একদিন এক মানুষ আরেক মানুষের দিকে গভীরটানে ঝুঁকে পড়ে?
প্রেম যতই আড়ালে থাকুক, যদি তা কাউকে ভেঙে না ফেলে–বরং জোড়া লাগায়- তবে সেই প্রেমের বিচার কেবল সমাজের চোখ দিয়েই করা যায় না। একটা সম্পর্ক কি কেবলই নাম, দায়িত্ব আর সামাজিক স্বীকৃতির বন্ধন? নাকি হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা, সংযোগ, টান আর একান্ত আবেগের বাস্তব রূপ? সংসার, সন্তান, স্থিতি—সব কিছু থাকার পরও যখন নারী-পুরুষের মধ্যে গোপন এক সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তখন প্রশ্ন ওঠে—এটা প্রেম, না পরকীয়া? ভালোবাসা, না নৈতিকতা স্খলন?
কোনো কোনো ভালোবাসা জন্ম নেয় দিনের আলোয়, আবার কিছু সম্পর্ক কেবলই রাতের ঘ্রাণে, নিঃশব্দে গড়ে ওঠে। সেখানে থাকে না নাম, দায়িত্ব, অথচ থাকে এক গভীর টান—যা ব্যাখ্যা করা যায় না, অস্বীকারও করা যায় না। সংসার মানে কি কেবল কাগজে ছাপা দাম্পত্যের ঘোষণা? নাকি সম্পর্ক মানে দু’টি হৃদয়ের প্রতিনিয়ত নতুন করে একে অপরকে খুঁজে পাওয়া?
এই যে বহু বছর পর কেউ হঠাৎ কাউকে ভালোবেসে ফেলে, সেটা কি শুধুই শরীরের আকাঙ্ক্ষা? না কি তা কোনো অবহেলিত হৃদয়ের কান্না, যে বহুদিন ধরে কারো ছুঁয়ে দেওয়ার অপেক্ষায় ছিল? সমাজ বলে—‘এই প্রেম পরকীয়া।’ তারা দাগ লাগিয়ে দেয়—নারী বেপরোয়া, পুরুষ চরিত্রহীন। কিন্তু সমাজ কখনও জিজ্ঞেস করে না—এই মানুষগুলো কতদিন ধরে উপেক্ষিত, নিঃসঙ্গ, অথবা রোবটের মতো সংসার টানছে?
আমরা মুখে মুখে প্রেমের গল্প বলি, সিনেমায় ভালোবাসার মৃত্যু দেখে কাঁদি। তবু বাস্তবে, যখন কেউ নিজের নিঃশ্বাসকে জীবন্ত রাখতে চায়, তখন তাকে ‘নৈতিকতার দোষী’ বানিয়ে দিই। প্রেম যদি দম বন্ধ হয়ে যাওয়া জীবনে একটু আলো আনে, একটু শ্বাস নেওয়ার সুযোগ দেয়—তবে তাকে কি কেবল ‘পরকীয়া’ নামে নিন্দা করা উচিত?
এখানে প্রেম মানে গোপনতা নয়, বরং বুঝতে পারার অভাবের বিরুদ্ধে এক নীরব প্রতিবাদ। হয়তো কেউ শুধু চেয়েছিল—একটু শোনা, একটু বোঝা, একটু গুরুত্ব। যেখানে সংসারে তার পরিচয় কেবল মা, স্ত্রী বা উপার্জনকারী, সেখানে কেউ একজন এসে বলেছে, ‘তুমি কেমন আছো?’- এই ছোট্ট প্রশ্নটাই অনেক সময় হয়ে ওঠে প্রেমের নতুন জন্ম। তবে হ্যাঁ, সব সম্পর্কই পবিত্র নয়, কিছু সম্পর্ক ভাঙে ঘর, কিছু মানুষ ব্যবহৃত হয়, ভোগ হয়, কিছু প্রেম আসলেই শুধু শরীর পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। তাই একে গৌরব গাথাও বলা যায় না। কিন্তু সবাইকেই একই মাপে মাপা কি ন্যায্য?
তাই আমাদের দরকার–তীব্র মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। যেখানে মানুষকে বিচার নয়, বোঝার চেষ্টা করা হবে। যেখানে সম্পর্ক মানে কেবল বিয়ের স্বীকৃতি নয়, বরং মানসিক সান্নিধ্য, আবেগের যত্ন, একে অপরকে ধরে রাখার আন্তরিকতা। ভালোবাসা যদি কাউকে নতুন আলো দেয়, যদি সে সম্পর্ক কারো ভেতরের ভাঙা মানুষটাকে জোড়া লাগায়, তবে সেটিকে শুধু ‘পরকীয়া’ বলে নাকচ করে দেওয়ার আগে—আমাদের ভাবা উচিত: এই প্রেম কি আসলে পাপ? না কি উপেক্ষার ছাইচাপা থেকে উঠে আসা জীবনের আর্তনাদ?
সংসার শব্দটা যেমন মাটি ঘেঁষা, তেমনি তার বুকে গাঁথা থাকে আগুনের রেখা। বিয়ে মানে কেবল এক টুকরো দলিল নয়, এক সমঝোতা, সামাজিক স্বীকৃতি, দায়বদ্ধতার নাম। সেখানে থাকে শপথ, অনুশাসন, ভবিষ্যতের মানচিত্র। তবু, এই গদ্যময় রুটিনের ভিতর দিয়েই কোনো এক অপার ছায়া, নিঃশব্দ আকাঙ্ক্ষা, কাঁপতে থাকা শূন্যতা জন্ম নেয়—যে জায়গায় গিয়ে প্রশ্ন দাঁড়ায়: এটি কি প্রেম, না পরকীয়া?
অনেক সময় দেখা যায়—সব কিছু থাকার পরও কিছু নেই। সংসার আছে, সন্তান আছে, নিয়ম আছে, দায়িত্বও ঠিকঠাক চলছে—তবুও হৃদয়ের উঠোন খালি। সেখানে শব্দ থাকে না, থাকে না ছুঁয়ে যাওয়ার ভাষা। সময়ের স্রোতে ক্লান্ত হয়ে ওঠা মানুষটি তখন হৃদয়ের কোনে এক অনাহূত অথচ অপরিহার্য আর্তিকে টের পায়। ঠিক তখনই কে যেন এসে বসে পাশে। একটুখানি মনোযোগ, একটুখানি বোঝার চেষ্টা, একটুখানি ভালোবাসার ছায়া—এতটুকুই কি একটা মানুষকে ঠেলে দেয় তথাকথিত ‘নৈতিক বিচ্যুতি’-র দিকে?
সমাজ পরকীয়াকে দোষ দেয়, মানুষটিকেও হেয় করে। সম্পর্কের প্রেক্ষাপট না জেনে, চাহিদার ভাষা না বুঝে একরকম ঢালাও শাস্তির চোখে দেখে। অথচ ভালোবাসা তো কখনো সাদা-কালো হয় না, তার রঙ ধূসর—অবচেতন, ভাঙা, জোড়া, ছায়া আর আলোয় গড়া।
এই তথাকথিত ‘অবৈধ’ সম্পর্কগুলো কি সবসময়ই শরীরের লোভ? নাকি মানসিক পরিপূর্ণতার অভাবের এক ঘোরতর অনুসন্ধান? নাকি একপ্রকার মুক্তি, যেখানে মানুষটিকে কেউ গুরুত্ব দিয়ে পাশে থাকে, এ এক এমন প্রশ্ন, যা হয়তো বৈধ স্বামী বা স্ত্রী বহু বছর ধরে আর করে না। তবে একে কি বলা যায় নিখাদ প্রেম? নাকি এটি কেবল আবেগের এক তাৎক্ষণিক আশ্রয়, ক্লান্ত হৃদয়ের বারান্দায় কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকা ?
প্রেমের ধারণা কি কেবল বৈবাহিক বৈধতায় বন্দি থাকবে? না কি প্রেম সেই যা জীবনকে অর্থ দেয়, এমনকি ভুলের ভিতর দিয়েও? তত্ত্ব বলে, পরকীয়া মানে প্রতারণা, বিশ্বাসভঙ্গ। কিন্তু মানবমনের জটিলতা বলে—একটি সম্পর্ক যতই বৈধ হোক, যদি সেখানে হৃদয়ের সংলাপ না থাকে, তবে সে সম্পর্কও এক ধরনের বিশ্বাসভঙ্গ। তখন মানুষ অন্য কোথাও খোঁজে হারিয়ে যাওয়া অর্থ, আত্মপরিচয়, জীবনের রঙ। সমাজ এখানে কেবল বিচারক, কিন্তু হৃদয় চায় বুঝতে। এই বুঝতে পারার জায়গায়ই কিছু মানুষ তীব্রভাবে ব্যর্থ।
এখন প্রশ্ন, তাহলে কী হবে? সবকিছু ছেড়ে মানুষ তার আকাঙ্ক্ষার পেছনে ছুটবে? না, বরং আমাদের দরকার সম্পর্কের নতুন পাঠ। যেখানে থাকবে দায়, থাকবে ভালোবাসার যত্ন, থাকবে মানসিক পরিতৃপ্তি, থাকবে সঙ্গীর প্রতি সজাগ দৃষ্টি। যদি ভালোবাসা বজায় থাকে, শ্রদ্ধা ও বোঝাপড়ার আলো না নিভে যায়, তাহলে হয়তো এমন অন্ধকার বারান্দার দরজা কেউ আর খুলে দেখবে না। তবে ততদিন পর্যন্ত, আমাদের উচিত একে কেবল ‘পাপ’ বা ‘পরকীয়া’ বলে দমিয়ে না রাখা। বরং বোঝা উচিৎ—কেন এ প্রেম জন্ম নেয়, কেন সে ভালোবাসা এত গোপন, তবুও এত গভীর।
কারণ প্রেম যতই আড়ালে থাকুক, যদি তা কাউকে ভেঙে না ফেলে–বরং জোড়া লাগায়- তবে সেই প্রেমের বিচার কেবল সমাজের চোখ দিয়েই করা যায় না। একটা সম্পর্ক কি কেবলই নাম, দায়িত্ব আর সামাজিক স্বীকৃতির বন্ধন? নাকি হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা, সংযোগ, টান আর একান্ত আবেগের বাস্তব রূপ? সংসার, সন্তান, স্থিতি—সব কিছু থাকার পরও যখন নারী-পুরুষের মধ্যে গোপন এক সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তখন প্রশ্ন ওঠে—এটা প্রেম, না পরকীয়া? ভালোবাসা, না নৈতিকতা স্খলন?
সমাজ যেটাকে “পরকীয়া” বলে চিহ্নিত করে, সেটার ভেতরে কি সবসময়ই লোভ, প্রতারণা, অথবা বিকার থাকে? নাকি মাঝে মাঝে এই সম্পর্কগুলো একটি বিমূর্ত মানসিক শূন্যতা পূরণের প্রয়াস, যেখানে মানুষ তার হারানো আবেগ, উপেক্ষিত হৃদয় কিংবা অব্যক্ত ভালোবাসার সন্ধান করে?
প্রতিদিনের গৃহস্থালি, সংসারযাপন, দায়িত্ব আর দমবন্ধ রুটিনের মধ্যে অনেক নারী-পুরুষই ধীরে ধীরে তাদের সঙ্গীর সঙ্গে মানসিক দূরত্বে ভুগতে শুরু করেন। সম্পর্ক হয়ে ওঠে সহাবস্থানের এক ঘরোয়া মিশেল—যেখানে প্রেম থাকে না, থাকে কেবল কর্তব্য। সেখানে জন্ম নেয় এক গভীর নিঃসঙ্গতা, যা অনেক সময় একজন মানুষকে অন্য একজনের দিকে টেনে নেয়।
এই টান সবসময় শরীর থেকে শুরু হয় না, বরং একটা সময় পর মানসিক ঘনিষ্ঠতাই হয় সবচেয়ে আকর্ষণীয়। কারও একটা কথা, একটা বোঝাপড়া, একটুখানি আলাদাভাবে খেয়াল রাখার মধ্যেই কেউ খুঁজে পায় ভালোবাসার নতুন স্বাদ। এই সম্পর্ক তখন হয়ে ওঠে বাস্তবতা থেকে একটু পালানোর পথ, একটু শান্তি, একটু নিজের মতো করে ভালোবাসা পাওয়ার জায়গা তবে এর মানে কি হচ্ছে—নৈতিকতার পতন? সমাজ যে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়, সেই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কি সম্পর্কের এই বাস্তবতাগুলো বিবেচিত হয়? না কি আমরা সম্পর্কের বহুমাত্রিকতা বোঝার আগেই তাকে গালি দিয়ে দূরে ঠেলে দিই?
এই সম্পর্ক যদি সত্যিই গভীর হয়, যদি ভালোবাসা থাকে, তবে তা কি কেবল “পরকীয়া” নামেই নিন্দার বিষয় হবে? না কি আমাদের চিন্তা, অনুভব ও মূল্যবোধের সংজ্ঞাকে আরও গভীর, মানবিক ও বাস্তবমুখী করে তুলতে হবে? আমাদের সমাজ এখনো বিয়েকে চূড়ান্ত বন্ধন মনে করে। কিন্তু সম্পর্কের মূল শক্তি তো প্রেম, মায়া, মমতা, বোঝাপড়া, আন্তরিকতা আর মানসিক উপস্থিতি। বিয়ের বন্ধন থাকলেও যদি সে জায়গাগুলো অনুপস্থিত থাকে, তবে কি সম্পর্ক বেঁচে থাকে শুধুই সামাজিক খাতায়?
এখানে কারও পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া কঠিন। কারণ সম্পর্ক মানেই দ্বৈততা, সেখানে রয়েছে অস্পষ্টতা, টানাপড়েন, দায়, আকাঙ্ক্ষা আর বাস্তবতার ছায়া। তবে এটুকু বলা যায়—একটি সম্পর্ক যদি কারও জীবনে প্রেম ও শান্তি আনে, তবে তার বিচার হোক দায়বদ্ধতার আলোকে, কেবল দোষারোপের নয়। কারণ প্রেম আর পরকীয়ার মাঝের রেখাটা হয়তো সূক্ষ্ম, কিন্তু অদৃশ্য নয়। কিন্তু আমরা কি সেই রেখাকে সাদা-কালোর চোখে দেখব, নাকি সময় এসেছে অনুভূতির এই ঘন জটিলতাকে বুঝে নতুন আলোচনার দরজা খুলে দেওয়ার?
লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক।
সূত্র: জাগো নিউজ/ভয়েস/আআ