বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৩৩ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

পেঁয়াজের ঝাঁজ ও ইলিশের স্বাদ

রাজেকুজ্জামান রতন:

পেঁয়াজের দাম নিয়ে আবার গরম বাজার ও মানুষের মন। আর প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কের মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়ায় সরব রাজনৈতিক মহল। ভারত সরকার পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতে কিছুটা সময় নিলেও বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা কিন্তু দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে ক্ষণমাত্র বিলম্ব করেনি। বরং তারা ভাবছে পেঁয়াজের দাম কতদূর পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে। পত্রিকায় লেখা হচ্ছে যে, লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। সাধারণ ক্রেতারা পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে বিচলিত। দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের অনেকেই মূল্যবৃদ্ধির এ সমস্যা নিয়ে কথা বলছেন। তাদের গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য মানুষের বিরক্তি এবং বিনোদন দুটোই উৎপাদন করেছে। বাজার নিয়ন্ত্রণ হয়ে যাবে, কোনো সমস্যা বা সংকট নাই। সংকট থাকলেও তা সাময়িক এসব কথা অনেকটা ভাঙা রেকর্ডের মতো বাজছে বহুদিন ধরে। সব সংকটের ক্ষেত্রেই একই আশ্বাসবাণী মানুষ আর কাহাতক বিশ্বাস করতে পারে! তারপরও শুনতে হয় এবং মানুষ শোনে। কিছু মানুষের বিশ্বাস করার ক্ষমতা সীমাহীন! তারা বিশ্বাস করে আর অপেক্ষা করে! বেশিরভাগ মানুষ যারা এসব দায়িত্বহীন বক্তব্যে যারপরনাই বিরক্ত হন, কখনো ক্ষোভ চেপে রাখেন আবার কখনো বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। কিন্তু ব্যক্তিগত বিক্ষোভে নিজের মনের শান্তি বিনষ্ট করা ছাড়া যে কোনো লাভ হয় না তা বুঝে শেষ পর্যন্ত আবার চেপে যান। ফলে সমস্যাও কমে না আর দায়িত্বহীন কথা বলাও থামে না।

কেউ কেউ আবার এটাও বলছেন, ক্রেতারা বেশি বেশি পেঁয়াজ কিনছেন বলেই বাজার অস্থির হয়ে গেছে। কী দারুণ পাশ কাটানো কথা! পেঁয়াজ একটা পরিবারে কতটুকু লাগে? বেশি কিনে তারা কী করবেন? এখনো ভ্যাপসা গরম চলছে। পেঁয়াজ একটি পচনশীল দ্রব্য। প্রতিদিন খোসা শুকিয়ে যায় এবং কিছু কিছু পচে যায় বলে রক্ষণাবেক্ষণ ও মজুদ রাখা সাধারণ পরিবারে সম্ভব নয়। ধরে নিলাম ‘প্যানিক বায়িং’-এর ফলে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে কেউ কেউ পাঁচ-দশ কেজি করে পেঁয়াজ কিনছেন। এ কারণেই কি দাম বৃদ্ধি হলো নাকি দাম বৃদ্ধি ও আরও বাড়ার আশঙ্কায় এ কেনাকাটা? ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে, পেঁয়াজের দাম তিনগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে, ভবিষ্যতে আরও বাড়বে, গত বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে এসব কথা ছড়ালে ক্রেতার মনে আতঙ্ক সৃষ্টি হতেই পারে। কিন্তু এটা যে ব্যবসায়ীদের ত্বরিত মুনাফার ব্যবস্থা করে দেয় সে দৃষ্টান্ত বিগত বছরগুলোতে জনসাধারণ দেখেছে এবং সম্ভবত ভুলে যায়নি। ফলে এ ধরনের প্রচারণাকে ‘প্রফিট ক্যাম্পেইন’ বা লাভের উদ্দেশ্যে প্রচারণাও বলা যেতে পারে। বেনাপোলে এবং হিলিতে পেঁয়াজের ট্রাক আটকে আছে এই খবর বিদ্যুৎবেগে ছড়িয়ে যায় সারা দেশে। আর তার চেয়েও দ্রুতগতিতে দাম বেড়ে যায় বরগুনা বা সিলেটে পেঁয়াজের দাম। বর্ধিত দামের পেঁয়াজ তো এখনো দেশে এসে পৌঁছায়নি। দেশের পেঁয়াজের দাম কেন লাফ দিয়ে বাড়ল? পেঁয়াজের দাম কি কৃষক বা উৎপাদক বাড়িয়েছে? কৃষক পেঁয়াজ বিক্রি করেছে গত বছর ডিসেম্বর আর এ বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে। ক্রেতারা কি বাজারে গিয়ে বলেছে যে, সরকারি ঘোষণায় যেহেতু আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়ে এখন ২০৪৮ ডলার হয়েছে তাই আর সস্তায় আমরা পেঁয়াজ কিনব না! তাহলে দায়ী কে এবং দায় কার? দাম বাড়ানোর এ তৎপরতায় ব্যবসায়ীরা যত উদ্যোগী সরকার দাম নিয়ন্ত্রণ করতে যেন ততটাই উদাসীন। দুয়েকজন ম্যাজিস্ট্রেট বাজারে বাজারে ছোটাছুটি করছেন। কাউকে কাউকে জরিমানা করছেন কিন্তু পেঁয়াজের দাম কমছে না। জরিমানার টাকা উসুল করতে হয়তো আরও দাম বাড়াচ্ছে ব্যবসায়ীরা। ফলে পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধিতে ব্যবসায়ীদের লাভ, সরকারের আয় আর জনগণের দায়।

এ ঘটনা ঘটেছিল গত বছরেও। আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবরে পেঁয়াজের ঝাঁজ বুঝেছে মানুষ। কত তৎপরতা দেখেছিল দেশবাসী তখন। তুরস্ক থেকে প্লেনে উড়িয়ে পেঁয়াজ আনা, রোহিঙ্গা সমস্যা সত্ত্বেও মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আনা কতকিছু হয়েছিল। দাম কমেনি বরং দাম বৃদ্ধিকে যুক্তিসংগত করা হয়েছে। দাম কমল কখন যখন ক্ষেত থেকে কৃষকের ঘরে নতুন পেঁয়াজ উঠল তখন। দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন হয় গড়ে প্রায় ২৩ লাখ টন। কৃষি বিভাগ এ তথ্য জানিয়েছে। পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা কঠিন, শুধু পচে যায় তাই নয়, নিয়মিত খোসা শুকিয়ে যায় তাই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে ১৯ লাখ টন। দেশের চাহিদা ২৬-২৭ লাখ টন। ফলে ঘাটতি ৭-৮ লাখ টন। হিসাব তো পরিষ্কার কিন্তু ঘাটতি পূরণের পরিকল্পনা কী? আমদানিই কি একমাত্র সমাধান? দেশের পেঁয়াজের চাহিদা মেটাতে আমদানির ৯০ শতাংশ আসে ভারত থেকে। ভারতে পেঁয়াজ উৎপাদন বেশি, ভারত থেকে আমদানিতে সময় লাগে কম, পরিবহন খরচ কম এসব হচ্ছে সুবিধার দিক। কিন্তু ভারতীয়

কর্র্তৃপক্ষ এ সুবিধাকে কতভাবে অসুবিধায় পরিণত করতে পারে তার দৃষ্টান্ত বিগত কয়েক বছর ধরেই তো আমরা দেখছি। ফলে সংকট সমাধানের অন্য পথ দেখতে হবে। প্রথমত উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া, দ্বিতীয়ত উৎপাদিত পেঁয়াজ যেন না পচে সেজন্য সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করা, তৃতীয়ত এক দেশের ওপর নির্ভরশীল ও জিম্মি না থেকে নতুন বাজার খোঁজা, চতুর্থত যেহেতু প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে এ সংকট দেখা দেয় ফলে বাজারের ওপর নজরদারি করা এসব পুরনো কথা নতুন করে বারবার বলছেন সবাই। কিন্তু যাদের শোনার কথা তারা যে শুনছে না তা তো দেখতেই পাচ্ছে উদ্বিগ্ন ক্রেতারা। যে পেঁয়াজ খেলে মুখে গন্ধ হয় বলে অনেকেরই বিরক্তি সেই পেঁয়াজের দাম দেখে মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে ক্রেতাদের।

ভারতের পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দেওয়া এবং দেশের বাজারে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির এ সময়েই বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাচ্ছে বাঙালির অন্যতম প্রিয় খাদ্য ইলিশ মাছ। গত বছরের তুলনায় এক হাজার টন বেশি অর্থাৎ দেড় হাজার টন ইলিশ যাবে ভারতে, প্রধানত পশ্চিমবঙ্গে। পেঁয়াজ এবং ইলিশ দুটোতেই গন্ধ আছে। একটা চোখে জ¦ালা ধরায়, পানি আনে, অন্যটা পাগল করে, জিভে জল আনে। বাংলাদেশ প্রতি কেজি ইলিশের মূল্য ধরেছে ১০ ডলার অর্থাৎ ৮৫০ টাকা। এ দামে দেশেও ইলিশ বিক্রি হচ্ছে। পুজো উপলক্ষে কিংবা পশ্চিমবঙ্গের মানুষের প্রিয় মাছ নিঃসন্দেহে প্রতি কেজি ১৫ ডলার হতে পারত। কিন্তু বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে দাম নিয়ে দরকষাকষি করাটা শোভন মনে হয় না। তাই চাহিদা আছে বলেই কি বাংলাদেশ দাম বাড়াতে পারে? না, পারে না । বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পেঁয়াজ উৎপাদনকারী দেশ ভারত প্রতিবেশী দেশে বেশি দামে পেঁয়াজ রপ্তানি করলেও বিশ্বের বৃহত্তম ইলিশ উৎপাদনকারী দেশ বাংলাদেশ তো দাম বাড়াতে পারে না। অনেকে প্রশ্ন করেছেন, পেঁয়াজ আমদানির এলসি খোলা হয়েছে তো আগে। তারপর দাম বাড়ানো কি ব্যবসায়িক নীতিতেও সঠিক? নাকি আমি যা খুশি দাম নির্ধারণ করতে পারি, আমার জিনিস আমি দাম বাড়াব তোমার পছন্দ হলে নাও, না হলে রাস্তা মাপো। এ নীতি কর্র্তৃত্বমূলক ব্যবসায়িক নীতি নয় কি? শুধু পেঁয়াজ নয়, সব ক্ষেত্রেই এখন এ নীতির প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। সম্পর্ক নাকি তরল পদার্থের মতো। যে পাত্রে রাখা যায় তার আকার ধারণ করে। ভারতের পাত্রে তার আকার যেমন বাংলাদেশে তেমন নয়। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কটা তাই ভারতের ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বন্ধুত্বের। ফলাফল সেই পল্লীগানের মতো ‘সাদা দিলে কাদা লাগাই দিলি রে, বন্ধু!’

পেঁয়াজ নিয়ে এই সংকট ও ব্যবসা কি চলতেই থাকবে? কৃষি গবেষণার ফলে উচ্চফলনশীল পেঁয়াজের জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। এসব জাতের বীজ ব্যবহার করলে গ্রীষ্ম, বর্ষা এবং শীতকাল অর্থাৎ বছরে তিনবার পেঁয়াজ উৎপাদন করা যাবে। বর্তমানে পেঁয়াজ চাষ করা হচ্ছে প্রায় সোয়া দুই লাখ হেক্টর জমিতে। চাষের এলাকা কিছুটা বাড়িয়ে এবং উচ্চফলনশীল জাত ব্যবহার করে দেশের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব বলে মনে করেন কৃষিবিজ্ঞানীরা। ফলে আমদানিনির্ভরতা না উৎপাদন বৃদ্ধি কোন পথে হাঁটবে বাংলাদেশ তা নির্ধারণ করা দরকার। দেশের অন্তত ৪০টি

কৃষিপ্রধান এলাকায় সবজি ও ফল সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ধরনের হিমাগার নির্মাণ করতে ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করলে প্রতি বছর পেঁয়াজ কারসাজিতে হাজার হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত খরচের হাত থেকে জনগণ বাঁচবে আবার কৃষক কিছুটা ন্যায্যমূল্য পাবে। তাই প্রতি বছর পেঁয়াজ সংকটে আশ্বাস নয়, দরকার কার্যকর পদক্ষেপ।

লেখক রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামনিস্ট

rratan.spb@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION