বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৪২ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

নারী ও পোশাকের রাজনীতি

চিররঞ্জন সরকার:

রাজধানীর পল্টন এলাকার একটি মাঠে ছেলের সঙ্গে এক মায়ের ক্রিকেট খেলার ছবি সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। কিন্তু মা আর সন্তানের খেলার ওই মুহূর্তটিকে ছাপিয়ে আলোচনা শুরু হয় ওই নারীর পোশাক নিয়ে। বোরকা পরা ওই নারীর পক্ষে যেমন অনেকে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন, অনেকে আবার একে ‘পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তানের ছবি’ বলেও কটাক্ষ করেছেন।

আসলে নারীর সমাজ নির্মিত একটি চেহারা আছে এবং সেই চেহারাটা হিন্দুদের জন্য এক রকম, ধর্মনিরপেক্ষদের জন্য একরকম, নারীবাদীদের জন্য একরকম, মুসলমানদের জন্য একরকম, খ্রিস্টান-বৌদ্ধদের জন্য আরেক রকম। এক শ্রেণির মানুষ এই বিষয়গুলোকে হাতিয়ার করে সামাজিক বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। নানা কু-তর্কে বিভেদের রেখাটাকে বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করেন। তাই তো কিছুদিন পর পর নারীর পোশাক নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে। যে যার মতাদর্শ ও বুঝ মতো নারী কোন পোশাক পরবে, আর কোনটা পরবে না সে বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করেন। তাতে সমাজমনস্তত্ত্বেরই প্রকাশ ঘটে।

সমাজ বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশে পোশাকও বিবর্তিত হয়েছে। আবার শিক্ষা, ধর্মীয় রীতিনীতির চর্চা, নগরায়ণও পোশাকের ওপর প্রভাব ফেলেছে। এক সময় অল্প কিছু চাকরিজীবী ছাড়া অন্য পুরুষরা লুঙ্গি পরতেন। এখন কৃষকসহ শ্রমজীবি শ্রেণি ছাড়া অন্যরা ঘরের বাইরে খুব একটা লুঙ্গি পরেন না। শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে প্যান্ট, ট্রাউজার, শর্টস পরার প্রবণতা বাড়ছে। মেয়েরা শাড়ি বাদ দিয়ে সালোয়ার-কামিজ পরছেন। এক সময় হিন্দু নারীরা বিশাল ঘোমটা টেনে কাপড় পরতেন। কালের বিবর্তনে ঘোমটা ছোট হয়েছে কিংবা উঠে গেছে। পাশাপাশি সমাজে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মীয় ধ্যানধারণা বৃদ্ধির কারণে বোরকা পরার প্রচলন বেড়েছে। এটা কূটতর্কের বিষয় নয়, এটা একটা প্রবণতা ও বাস্তবতা। এর সঙ্গে ধর্মবিশ্বাসের যোগ আছে। সমাজমনস্তত্ত্ব অস্বীকার করে বোরকার বিরুদ্ধে গর্জন করলেই যেমন এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমবে না, আবার বোরকার পক্ষে ব্যাপক প্রচারণা চালালেও সবাই বোরকা পরবে না। আমাদের সমাজটা নানা ধর্ম-বর্ণ-সংস্কৃতি-মূল্যবোধ-রুচির মানুষ নিয়ে গঠিত। সেখানে চিন্তা-ভাবনা, আচরণ, পোশাক ইত্যাদির ভিন্নতা থাকবেই। কোনো সমাজে সবাই একই রকম পোশাক পরবে, একই ধরনের চিন্তা ও আচরণ করবে এটা অলীক কল্পনা মাত্র। ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যকে মান্যতা দিতেই হবে। এটা অনিবার্য। সবাইকে এক ছকে সাজানো যাবে না।

কে কোন পোশাক পরবে, সেটা তার ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যাপার। যদিও পোশাকের সঙ্গে পারিবারিক রীতি, ধর্মীয় বিধান, ভৌগেলিক ঐতিহ্য, চলাফেরার স্বাচ্ছন্দ্য, কাজের প্রকৃতি, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, লিঙ্গ-রাজনীতিসহ অনেক কিছুর ভূমিকা রয়েছে। পোশাককে শুধু ধর্মীয় বিধানের আলোকে দেখলেও হবে না। আবার কেবল পছন্দ, স্বাচ্ছন্দ্য ও নান্দনিকতার মাপকাঠিতে দেখলেও হবে না। পোশাককে জাতীয়তা, আঞ্চলিকতা, ঐতিহ্য ইত্যাদির নিরিখেও দেখার অবকাশ আছে। মেয়েদের পোশাক নিয়ে একটা সূক্ষ্ম রাজনীতি রয়েছে। সেটা পুরুষের বা পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতি। মেয়েদের পোশাক ও অভ্যাস চিরাচরিত সামাজিক ব্যবস্থার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে তাকে অবজ্ঞার চোখে দেখা হয়। গবেষণা বলছে, মেয়েদের যে পোশাক সমাজ মানসিকতার বিরুদ্ধাচরণ করে তা পুরুষদের ক্রোধ উৎপাদন করে। মেয়েদের কোন পোশাকে দেখতে ঠিক কেমন লাগবে তার জনমত নির্ধারিত একটা গ্রাফ আছে। রাজনৈতিক ভাবেও গুরুত্ব অর্জন করতে হলে প্রথমেই মেয়েদের সেই পুরুষ নির্ধারিত-বৃত্তে বন্দি হতে হয়। মেয়েদের যোগ্যতা নয়, সামাজিক কাপুরুষতাকে প্রশ্রয় দেওয়ার মধ্যেই তাদের সনাতন ‘ভালো মেয়ে’র স্বীকৃতি লুকিয়ে থাকে। সমাজের পক্ষে একমাত্র সেই নারীই গ্রহণযোগ্য, ‘কল্যাণকর’ যিনি পোশাকে ‘শালীন’, আচরণে বিনয়ী এবং নিশ্চিত ভাবে ঘরোয়া। পোশাক কখনো মেয়েদের ভালো-মন্দের দলিল নয়। অহংকার, ঔদ্ধত্য বা নম্রতার সঙ্গেও যুক্ত নয়। পোশাকের সঙ্গে মেয়েদের স্বকীয়তা, আত্মমর্যাদা বা প্রদর্শনেরও কোনে সম্পর্ক নেই। আছে পছন্দ ও স্বাচ্ছন্দ্য ও কিছু ক্ষেত্রে স্থান-কাল-পাত্রের সাযুজ্য। নারীর পোশাক নিয়ে সমালোচনা করাটা এক সামাজিক অসুখ। সমাজ-নির্মিত যে কাম্য ও স্বীকৃত নারীত্ব, এই লিঙ্গ-নির্মাণের অনেকগুলো বিধিনিষেধের একটি প্রধান সেক্টর মেয়েদের পোশাক। পোশাকের ক্ষেত্রে ‘চয়েস’ বা ইচ্ছেকেই অনেকে প্রধান বিবেচ্য বলে মনে করেন। যদিও প্রশ্ন থেকে যায়, মেয়েরা যা পরেন, যেভাবে পরেন, তা কি তাদের নিজস্ব রুচি-পছন্দ অনুসারেই? না কি, তাদের বেলায় পোশাক মানে সত্যিই পররুচির খেলা? নারীর কাছে ‘পররুচি’-র অর্থ আসলে পুরুষের রুচি, যার ভিত্তিতে তাদের পোশাক নির্ধারিত হয়ে থাকে। পোশাকের স্বাধীনতার বা স্বাচ্ছন্দ্যের নামে মেয়েরা যা পরেন, পরতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন, আজও তা সুকৌশলে আমাদের পুরুষশাসিত সমাজই নির্ধারণ করে দেয়। পশ্চিম হোক বা পূর্ব, ভোগবাদ হোক বা রক্ষণশীলতা, বোরকা হোক বা মিনি স্কার্ট পুরুষচক্ষুই আজও নিয়ন্ত্রণ করে নারীর পোশাকের স্বাধীনতা।

পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা সমাজ-সংসারের একটা ছক এঁকে দিয়েছে। একেই আমরা প্রাকৃতিক বা ধর্মীয় বিধান হিসেবে মেনে নিয়েছি। এর বাইরে জগৎ হতে পারে, হওয়া সম্ভব এটা ভাবতে সমাজ, সমাজের প্রথাবদ্ধ মানুষেরা ভাবতে নারাজ। এই বিশ্বাস ভাঙতে গেলে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। ‘পৃথিবীর ভবিষ্যৎ’ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়। জীবনযাপনের অনেক পথ আছে। পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা এর কয়েকটাকে বড় করে দেখিয়েছে, বিশেষ মাহাত্ম্য দিয়েছে গায়ের জোরে। নারী এই, পুরুষ এই এই রকমই তাদের হতে হবে, এমন পোশাক পরতে হবে, এভাবে চলতে হবে, এভাবে যৌনতার চর্চা করতে হবে, এটা আমাদের বদ্ধমূল ধারণা। পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণা আমাদের মধ্যে এই ‘মূল্যবোধ’ দৃঢ়ভাবে প্রোথিত করে দিয়েছে।

কিন্তু এমন যুক্তিও প্রবল যে, বহুজনকে নিয়েই সমাজ। সমাজের প্রত্যেকে যেন নিজের মতো বাঁচতে পারে, নিজের পছন্দ অনুযায়ী চলতে পারে, বলতে পারে, পরতে পারে, সেটাই আজকের যুগের সমাজের এবং মানবাধিকারের মূল কথা। যা কিছু চলে আসছে ধর্ম কিংবা সামাজিক নিয়ম হিসেবে, যা আমরা বাইরে থেকে দেখে অভ্যস্ত, এই ‘বাইরের ঠিক’ সব সময় ঠিক নয়। ভেতরের বা সত্তার বিকাশই আসল কথা। সত্তাকে উপলব্ধি করতে হয়। তবে তাকে চিনতে পারা যায়। আমাদের সমাজে প্রচলিত ধর্মতান্ত্রিক ও পিতৃতন্ত্রের খাঁচায় সবাইকে ‘ফিট’ করতে চাওয়া হয়। কেউ ফিট না করলে তাকে বাধ্য করা হয়। যে ফিট করছে না তাকে তার মতো থাকতে দেওয়াটাই যে মানবাধিকারের মূল কথা এটা সামাজিক মানুষেরা, এমনকি রাষ্ট্র পর্যন্ত প্রায়শই ভুলে যায়।

ব্যক্তির ছোট ছোট স্বাধীন চেতনা, ইচ্ছে কিংবা অনিচ্ছেগুলোর ওপর প্রায়শই আমরা স্বৈরতন্ত্রী হামলা চালাই। সমাজের উপরিতলের, কিংবা সংখ্যাগুরুর (শুধু ধর্মীয় গোষ্ঠী নয়) ইচ্ছে-অনিচ্ছের ওপর নির্ভর করে আমাদের দেশের এক বিরাট অংশের মানুষের স্বাধীনতা। গ্রাম থেকে পড়তে আসা ছেলেটির কথাবার্তায় ‘মাদার টাং ইনফ্লুয়েন্স’ আছে? ব্যস, তার ‘স্বাধীনতা’র বারোটা বাজল। কোনো এক শৈলশহর থেকে মঙ্গোলয়েড শোণিত শরীরে বহন করে রাজধানী শহরে বড় সংস্থায় চাকরি করতে এলো তরুণী, তার স্বাধীনতা শেষ হলো। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারেও ‘আমাদের মতো’ নন যারা, তাদের স্বাধীনতা আজকাল দেওয়া মুশকিল। এই ভাবেই ছোট হতে থাকে বৃত্তটা। ছোট হতে হতে এক সময় নিশ্চয়ই বিন্দুতে গিয়ে শেষ হবে স্বাধীনতা বস্তুটা। আসলে, নিজের মতো পোশাক পরার স্বাধীনতা, নিজের ভাষায় কথা বলার স্বাধীনতা, চিন্তা করার স্বাধীনতা, গান গাওয়ার স্বাধীনতা, স্বপ্ন দেখার স্বাধীনতা এ সবকিছু যত দুর্মূল্য হবে, ততই একমাত্রিক হয়ে যাব আমরা। যতই আমরা ভুলে যাব সবাই মিলে বাঁচার নিয়ম, ততই আসলে আলাদা আলাদাভাবে স্বাধীনতা হারাতে থাকব আমরা এ এক আশ্চর্য ধাঁধা!

পরের রুচিতে চলতে, পরতে, পড়তে, বলতে গিয়ে আমরা ক্রমশই সবার মতো হওয়ার ভান করতে থাকি। ভান করতে করতে সব মুখগুলোই মুখোশ হয়ে যায়। শহর-গ্রাম, নগর-মফস্বল সব কেমন একই রকম হয়ে ওঠে, বা হয়ে ওঠার চেষ্টা করে। রাষ্ট্রেরও খুব বেশি রকম সুবিধে হয় তাতে। উন্নয়নের সূচক নির্ধারিত হয় মাপা পণ্যে। মানুষকে আর মানুষ ভাবতে হয় না, মুখোশ পরা মানুষকে মুখোশের পরিচয়ে চিনলেই কাজ চলে যায়!

লেখক লেখক ও কলামনিস্ট

chiros234@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION