বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৫২ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

করোনায় মৃত্যু কমাতে এখন যা করতে হবে

স্বদেশ রায়:

ইতালি করোনা আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইউরোপীয় কমিশনের সাত বিশেষজ্ঞ একটি মডেল তৈরি করেন। এটা ‘নেচার মেডিসিনে’ ছাপা হয়। সেখানে বলা হয়, ইতালি যদি সীমিত পর্যায়ে পরীক্ষা করে এবং তাদের লকডাউন খুব কঠোরভাবে না করে, তাহলে ইতালিতে মৃতের সংখ্যা বছর শেষে ৭০ হাজার গিয়ে দাঁড়াবে। আর যদি ব্যাপক পরীক্ষা করে ও কঠোর লকডাউন বজায় রাখে, তাহলে তাদের মৃতের সংখ্যা ২৫ হাজারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। ইতালি লকডাউন সর্বোচ্চ কঠোরভাবে বজায় রাখতে পারেনি। তবে তারপরেও যথেষ্ট কঠোর লকডাউন ও ব্যাপক পরীক্ষা করেছিল বলে তাদের মৃত্যু ২৮ হাজারের কিছু বেশি হয়েছে, ৭০ হাজার হয়নি। অন্যদিকে কঠোর লকডাউন ও ব্যাপক পরীক্ষার ফলে থাইল্যান্ড তাদের আক্রান্তের সংখ্যা তিন মাসে তিন হাজারের কমে সীমাবদ্ধ রেখেছে। মৃত্যু অর্ধশতক এবং দুই মাসের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ‘তিন’-এ নামিয়ে আনতে পেরেছে।

৩ মে যখন এই লেখা লিখছি, তখন আমাদের আক্রান্তের সংখ্যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ, অর্থাৎ ৬৬৫ জন। মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৯ হাজার ৪৪৫ ও মৃতের সংখ্যা ১৭৭ জন। আমাদের আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিন তিন ডিজিটে। অন্যদিকে মোট মৃতের সংখ্যাও তিন ডিজিটে। এই সময়ে আমরা কিন্তু সীমিত পরীক্ষা ও অনেক ঢিলেঢালা লকডাউনের মধ্য দিয়ে চলছি। তাই এ মুহূর্তে লকডাউন কঠোর না করলে এবং ব্যাপক পরীক্ষা, বিশেষ করে র‌্যাপিড টেস্টে না গেলে সমূহ বিপদে পড়ার সম্ভাবনা আছে।

কঠোর লকডাউনে খাদ্যাভাব হবে না

আমাদের লকডাউন কঠোর করার ক্ষেত্রে দুটি বিষয় বাধা হচ্ছে। এক, জনগণ সঠিকভাবে লকডাউন মানছে না। দুই, মিডিয়ার একাংশ ও কিছু এনজিও বলছে খাদ্যাভাবে মানুষ মারা যাবে। জনগণের যে অংশ লকডাউন সঠিকভাবে মানছে না, তাদের এখন আর সচেতন করে, লকডাউন মানার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে মানানোর সময় নেই। এখন আইনশৃঙ্খলার বাহিনী সঙ্গে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য যোগ করে কঠোরতার মাধ্যমেই তাদের লকডাউন মানাতে হবে। তাছাড়া আমাদের এশিয়ার অনেক দেশের মানুষের মধ্যে আইন না মানার একটা মানসিকতা আছে। আমাদের মধ্যেও সেটা আছে। তাই প্রয়োজনে শাস্তির বিধান করে হলেও তাদের ঘরে রাখতে হবে। থাইল্যান্ডের মতো রেজিমেন্টাল জনগোষ্ঠীর দেশেও দেখা গেছে, দিনে একশ’র বেশি মানুষ লকডাউন ভাঙার ফলে শাস্তি ভোগ করছে। করোনায় মৃত্যু কমিয়ে রাখতে, করোনার বিস্তার কমাতে আমাদের এখন আইন ও শাস্তি প্রয়োগে যেতে হবে। সারা দেশে যে সংখ্যক দরিদ্র মানুষ আছে আগামী দুই-তিন মাসও তাদের খাবার পৌঁছে দেওয়ার কাজটি মোটেই সরকারের জন্য কঠিন কিছু নয়। আর মিডিয়ার যে অংশ বলছে খাবারের অভাবে মানুষ মারা যাবে তারা কি গত এক মাসে একটি পরিবারের খবর বের করতে সমর্থ হয়েছে যে তারা না খেয়ে ছিল? অন্যদিকে একটি বড় এনজিও প্রধান বলেছিলেন, এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠী তীব্র খাবারের অভাবে ভুগবে। কোথাও কেউ কি কোনও খাবারের অভাবে ভুগেছে? ভোগেনি। বরং ওইসব এনজিও ব্যর্থ হয়েছে মানুষের প্রতি তাদের দায় পালন করতে। তাই এপ্রিলে যখন খাদ্যাভাব হয়নি, মে মাসেও হবে না। বরং লকডাউন কঠোর করে করোনা ঠেকানো এখন দরকার বেশি। পাশাপাশি এতদিনে সরকারের হাতে মোটামুটি একটি ডাটা এসে গেছে কারা খাদ্যাভাবে পড়তে পারে, তাদের খাদ্য পৌঁছানোর কাজে শৃঙ্খলা আনলে হবে। অন্যদিকে খাবার বণ্টনের দেখভালে প্রশাসনের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের যোগ করে একটি ভারসাম্য আনতে হবে। জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসন একত্র হলে গতি বাড়বে।

ব্যাপক টেস্ট ও ড. বিজন শীলের গণস্বাস্থ্য টেস্ট কিট

ব্যাপক টেস্টের ক্ষেত্রে আমাদের প্রধান বাধা, এখনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি যে টেস্ট ব্যাপক হারে করা হবে। এখনও সিদ্ধান্ত এমনই, যাদের লক্ষণ দেখা যাবে তাদের পরীক্ষা করতে হবে। এই সিদ্ধান্ত থেকে দ্রুত সরে আসতে হবে। ব্যাপক টেস্টের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অন্যান্য দেশে পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (পিসিআর)-এর পাশাপাশি র‌্যাপিড টেস্টও করছে। আমাদের বিশেষজ্ঞদের অবিলম্বে র‌্যাপিড টেস্টের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাছাড়া শুধু পিসিআরের মাধ্যমে ব্যাপক টেস্টে যাওয়া সম্ভব নয়। যেমন, থাইল্যান্ড প্রতি দশ লাখে এক লাখ লোকের টেস্ট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাদেরও সবকিছু চালু করার আগে এ ধরনের একটা সিদ্ধান্তে যেতে হবে। তা নাহলে দেশ বিপদে পড়ে যাবে। আর এসব কিছু নিয়ে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় যাওয়ার কোনও সুযোগ নেই। যেমন, গণস্বাস্থ্যের ড. বিজন শীলের আবিষ্কৃত কিটটি নিয়ে আমলাতান্ত্রিকতায় অন্তত সব মিলে দুই সপ্তাহ সময় নষ্ট হলো। দেশের মানুষ এখন বুঝতে পেরেছেন প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপেই বিষয়টি সুরাহা হওয়ার পথে এগোচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী এদিকে দৃষ্টি না দিলে মিডিয়ার একাংশ ও প্রশাসনের কয়েক ব্যক্তি যে আচরণ করছিল তাতে বিষয়টি নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হবে বলে অনেকে মনে করেছিলেন। কিন্তু যারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সত্যি অর্থে চেনেন, তারা জানতেন, তিনি বিষয়টিকে জটিলতায় পড়তে দেবেন না। কারণ, দেশের যেকোনও ভালোর সঙ্গে শেখ হাসিনাই একমাত্র শেষ অবধি থাকেন। ড. বিজন শীলের কিটটি যে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়েছিল তার মূল কারণ, বৈজ্ঞানিক গবেষণা সম্পর্কে আমাদের সঠিক পথ জানা না থাকা। কারণ, ওষুধ প্রস্তুতের পরীক্ষা আর বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে ওষুধ প্রশাসন একই আচরণ করে না। আমাদের ওষুধ প্রশাসন যেমন থার্ড পার্টি চুক্তি ছাড়া গণস্বাস্থ্যের কিটটি বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল ও আইসিডিডিআরবি’র মাধ্যমে পরীক্ষা করার অনুমোদন দিয়েছে, আমেরিকা ও ইউরোপের ওষুধ প্রশাসনও র‌্যাপিড টেস্টের কিটের অনুমোদনের ক্ষেত্রে একই কাজ করেছে। আমাদের সামনে উদাহরণ ছিল। তাই এ সময়ে সময় নষ্ট না করলেই ভালো হতো। যাহোক, যে ভুল হয়ে গেছে তা নিয়ে অনুশোচনা করে লাভ নেই। এখন সামনে এগোতে হবে।

ড. বিজন শীল জানাচ্ছেন, তার এ কিট শরীরের এন্টিবডি ও এন্টিজেন দুটোই পরীক্ষা করতে সমর্থ হবে। প্রতিটি টেস্টে দুই থেকে পাঁচ মিনিট সময় লাগবে। আঙুলের মাথা থেকে সামান্য রক্ত নিয়ে এটা করা হবে। এন্টিবডি নেগেটিভ ও এন্টিজেন নেগেটিভ হলে সে আক্রান্ত হয়নি। এর যেকোনও দুটোর একটা পজিটিভ হলে কোনও লক্ষণ না থাকলেও আক্রান্ত আর দুটো পজিটিভ হলে তো আক্রান্তই। আপাতত তিনি এ কাজ দুটো ডিভাইসের মাধ্যমে একই সময়ে ওই একই পরিমাণ রক্ত নিয়ে করবেন। তবে তিনি এন্টিজেন ও এন্টিবডির মধ্যে একটি ব্রিজ তৈরি করে দিয়েছেন তার আবিষ্কারে। যার ফলে এই কিট অন্য র‌্যাপিড টেস্টের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এবং একই সঙ্গে এন্টিবডি ও এন্টিজেন পরীক্ষা করা যাবে।

এক্ষেত্রে আমি ‘আমাদের সময়’ পত্রিকায় একটি লেখায় লিখেছিলাম, বিজন শীলের এই গবেষণা গণস্বাস্থ্যে হয়েছে ঠিক আছে। তবে দেশের প্রয়োজনে সরকার এটাকে বৃহত্তর পরিসরে আনার ব্যবস্থা করুক। এখনও গণস্বাস্থ্যের সঙ্গে আলাপ করে সেটা করা দরকার। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধা, সৎ এবং বড় ঘরের সন্তান। তিনি দেশের বৃহত্তর স্বার্থে একাজে রাজি হবেন বলে আশা করি। এটা অত্যন্ত জরুরি এখন দেশের স্বার্থে। কারণ, একটি ডিভাইসে দুই থেকে পাঁচ মিনিটে এন্টিজেন ও এন্টিবডি পরীক্ষা হলে এই পরীক্ষার ফলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম থাকবে। শতভাগ ঠিক হবে এমনটি কেউ কখনও বলে না। দুই-এক পার্সেন্ট ভুল থাকে। ওটা ধরে নিয়েই ডাক্তাররা চিকিৎসা করেন। আর আমাদের এখন দশ লাখে এক লাখ পরীক্ষা করতে হলে এই র‌্যাপিড টেস্টের পথেই যেতে হবে। সেক্ষেত্রে এ মুহূর্তে ড. বিজন শীলের এই আবিষ্কার আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া।

গার্মেন্টস বা জরুরি ভিত্তিতে খোলা রাখা ও দশ লাখে এক লাখ টেস্ট

সীমিত পর্যায়ে গার্মেন্টস খুলে দিয়ে ইতোমধ্যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। আশুলিয়ায় সাতজন গার্মেন্টস শ্রমিক করোনা আক্রান্ত হওয়ায় স্বাস্থ্য অধিদফতর ওই এলাকায় গার্মেন্টস বন্ধ রাখার কথা বলেছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি বলছেন, গার্মেন্টস মালিকরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ করছেন না। তাদের এই স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে গণস্বাস্থ্যের এই কিটটি সহায়ক হবে। কারণ, ড. বিজন শীল জানিয়েছেন, এই কিটের মাধ্যমে গ্রুপ টেস্ট করা সম্ভব। অর্থাৎ, ধরা যাক, মোট শ্রমিক দশ হাজার। সেখানে একশ’ জনের গ্রুপ করে ওই একশ’ জনের সকলের রক্ত একসঙ্গে মিলিয়ে একটি ‘পুল সিরাম’ তৈরি করে ওই গ্রুপটির রক্ত টেস্ট করা হবে। এভাবে একশ’ গ্রুপের একশ’টি ‘পুল সিরাম’ টেস্ট করলে দশ হাজারের টেস্ট প্রাথমিকভাবে শেষ হবে। সেখানে যদি দেখা যায় দুটি গ্রুপে পজিটিভ এসেছে তখন ওই দুটি গ্রুপের দুইশ’জনকে আলাদা আলাদা করে পরীক্ষা করলে কে কে করোনা আক্রান্ত তা চিহ্নিত করা যাবে। বাকি নয় হাজার আট’শ’র আর কোনও পরীক্ষার দরকার নেই। তারা শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে, মাস্কসহ অনান্য বিধি মেনে কাজ করতে পারবে। তখন আক্রান্ত গ্রুপের দুইশ’কে আলাদা করে পরীক্ষা করলে হবে। এবং সেখান থেকে চিহ্নিত করা যাবে কে কে করোনায় আক্রান্ত। এই পদ্ধতিতে প্রতি দশ লাখে এক লাখ টেস্টও খুব দ্রুত করা সম্ভব হবে। এক একটি এলাকা ধরে এই গ্রুপ টেস্টের পদ্ধতিতে তখন দ্রুত টেস্ট করা যাবে। শিল্প-কলকারখানা দ্রুত খোলার জন্য এবং দেশকে স্বাভাবিক কাজের মধ্যে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে এই ব্যাপক টেস্ট একান্ত জরুরি। আর এ কারণে দেশে আবিষ্কৃত গণস্বাস্থ্যের কিটটি যাতে ব্যাপকহারে উৎপাদনে যেতে পারে, সে কাজটি এখন বৃহত্তর পরিসরে আনা দরকার।

লেখক: রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION