বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:৫১ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের পুনরুজ্জীবন

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী:

সব মানুষ নিশ্চয়ই চুপ করে থাকেনি। কিন্তু তাদের কণ্ঠ চাপা পড়ে গেছে সুবিধাভোগী চাটুকারদের বড় গলার আওয়াজের নিচে। গণমাধ্যম তাদের বক্তব্যকে তুলে ধরেনি, গুরুত্ব দেওয়া পরের কথা। গণমাধ্যম সুবিধাভোগীদের দখলে। বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে মোবাইল ফোনের রেজিস্ট্রেশনের উপযোগিতা নিয়ে অনেকে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। সরকার শোনেনি। এগিয়ে গেছে। এখন দেখা যাচ্ছে হাজার হাজার মোবাইল ফোন এই পদ্ধতিতেই ভুয়া রেজিস্ট্রেশন নিয়ে বাজারে বিক্রি হচ্ছে। নিয়ম এটাই। গরিবের কথা প্রথমে বাসি হয়, তার পরে ফলে। রামপালে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন যে অত্যন্ত ক্ষতিকর হবে এ কথাও বলা হয়েছে, গরিবরাই বলছে, সেটাও হয়তো এক দিন ফলবে, তবে তখন দেরি হয়ে যাবে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ সম্বন্ধেও আপত্তি উঠেছে। নানা বিপদের কথা বলা হয়েছে। কায়মনোবাক্যে আমরা কামনা করব যে এক্ষেত্রে গরিবের কথা যেন মিথ্যা প্রমাণিত হয়; কারণ সত্য বলে প্রমাণিত হলে যে বিপর্যয় ঘটবে তা কল্পনারও বাইরে।

জঙ্গি সমস্যা বিষয়ে ফেরত আসা যাক। ধারণা করা হতো যে, মাদ্রাসাছাত্ররাই শুধু জঙ্গি হয়। এখন দেখা যাচ্ছে মাদ্রাসার ছাত্রদের কেউ কেউ ওই কাজে যুক্ত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাদের চেয়ে অনেক ভয়ংকর হচ্ছে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষিতদের একাংশের জঙ্গি সংযোগ। এদের শক্তি, দক্ষতা, যোগাযোগ অনেক উঁচুমানের। মাদ্রাসা ও ইংরেজি মাধ্যম এই দু’য়ের ভেতর মিল অবশ্যই আছে। সেটা হলো গন্তব্যের। আর পার্থক্য যেটা তার ভিত্তি হলো শ্রেণি। ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষিত জঙ্গিরা ধনী পরিবারের সন্তান; মাদ্রাসা থেকে যারা এসেছে তারা নিম্নবিত্ত। পার্থক্যটা ইংরেজি মাধ্যম ও মাদ্রাসা শিক্ষার দূরত্বের সমান সমান। শিক্ষার উভয় ধারাই উৎপাটিত এবং জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা পরকালের কথা ভাববে এতে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। কিন্তু ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রদের মনোযোগ তো বর্তমান জগতে সাফল্যের দিকেই থাকার কথা। তাহলে? ব্যাপার আসলে এটাই যে, ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষিত ওই তরুণরা ইহজগতের উপার্জনে সন্তুষ্ট নয়। ইহজগতে তাদের তেমন একটা সমস্যা নেই, ঘরবাড়ির ব্যবস্থা পিতামাতাই করে দিয়েছেন, দেশে করেছেন, মাশাল্লা বিদেশেও করবেন, কিন্তু পরকালের কথাও তো ভাবতে হবে, সেখানেও তো বিষয়আশয় দরকার। হয় তো সেই চিন্তাটাই তাদেরকে পেয়ে বসেছে। সেই সঙ্গে এটাও হতে পারে যে, বাঙালি পরিচয়ে তারা আর সন্তুষ্ট নয়, মুসলমান পরিচয়টাকে বড় করে তুলতে চায়; ভেবেছে তাতে সম্মান বাড়বে, বড় একটা পরিসরও পেয়ে যাবে। রাজনীতিতে ধর্মের যে ব্যবহার চলছে তার প্রভাবও তাদের ওপর গিয়ে পড়বার কথা। পুঁজিবাদীরা ধর্মকর্মের জন্য সুখ্যাত নয়, কিন্তু তারা ধর্মের কথা খুব করে বলে। জর্জ বুশ তো ক্রুসেডই ঘোষণা করেছিলেন। ক্রুসেড উৎসাহিত করেছে জিহাদকে। এরা কেউই জনগণের পক্ষে নয়, সবাই জনগণের বিপক্ষে। ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদের চর্চা যে বাংলাদেশের তরুণদের ওপর পড়ছে না এমনও নয়। পড়ছে, এবং পড়তে থাকবে।

ওদিকে বাংলাদেশের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বহু আগেই নির্বাসিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বলে দাবি করে যে আওয়ামী লীগ, তারা ক্ষমতায় একাধিকবার এসেছে কিন্তু একবারও চেষ্টা করেনি ধর্মনিরপেক্ষতার রাষ্ট্রীয় নীতিকে সংবিধানে ফেরত আনতে। উপরন্তু এরশাদের রাষ্ট্রধর্ম সংযোজনকে তারা নীরবে মেনে নিয়েছে। এমনকি বহু অপরাধসহ রাষ্ট্রধর্ম সংযোজনের অপরাধেও অপরাধী, রাষ্ট্রদ্রোহী এরশাদের সঙ্গে রাজনৈতিক ভাবে তাদের একত্রে থাকাটা নির্বিবাদে চলেছে। এরশাদ ছুটে যেতে চাইলে জেলের ভয় দেখিয়ে তাকে কাছে টেনে আনা হয়েছে।

জঙ্গিদের সংখ্যা অল্প। আমরা জানি একাত্তরে দেশের সব মানুষ ছিল একদিকে, মুষ্টিমেয় কিছু ছিল হানাদারদের পক্ষে; জঙ্গিদের সংখ্যা ওই কুলাঙ্গারদের তুলনাতেও অল্প। কিন্তু এদের সংখ্যা বাড়ছে। এবং ধনীগৃহের সন্তানরাও ওই পথে চলে আসছে, বিপদটা বিশেষভাবে সেখানেই। ভরসাও কিন্তু আবার তরুণরাই। শাহবাগে যে তরুণরা এসে জড়ো হয়েছিল সংখ্যায় তারা বিপুল। তারাও অবস্থাপন্ন ঘরেরই সন্তান। কিন্তু তাদের আদর্শবাদটা ছিল ভিন্ন ধরনের। সেটি ছিল সমষ্টিগত মুক্তির যে-স্বপ্ন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পেছনে কাজ করেছে সেই স্বপ্নটিকে পুনরুজ্জীবিত করার।

তারা অবশ্য বেশিদূর এগোতে পারেনি। কারণ তাদের জাগরণটা স্বতঃস্ফূর্ত হলেও ছিল অসংগঠিত। সংগঠন না থাকলে শুধু স্বতঃস্ফূর্ততায় কাজ হওয়ার নয়। কাজ হয়ওনি। যে তরুণরা জঙ্গি হয়ে যাচ্ছে তাদেরকে শাহবাগের পথে নিয়ে আসাটা দরকার। সে জন্য রাজনৈতিক আন্দোলন চাই, চাই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাজ। এসব ক্ষেত্রে অভাবটা যে কত মর্মান্তিকরূপে ক্ষতিকর জঙ্গিবাদের তৎপরতা তারই প্রমাণ।

তরুণদেরকে সামাজিক ভাবে সংকুচিত করার চেষ্টাটা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা পরিসর পাচ্ছে না। ফেইসবুক সামাজিক মাধ্যম হিসেবে গণ্য হয়েছে, আসলে কিন্তু সে যা ঘটাচ্ছে তা হলো ছায়ার সঙ্গে যোগাযোগ। ব্যক্তিকে নিয়ে আসছে ছোট বৃত্তের ভেতর, অথচ ধারণা দিচ্ছে যে মিলন ঘটছে অসংখ্য জানা-অজানা মানুষের সঙ্গে। ওই মানুষগুলো তো মানুষ নয়, তারা মানুষের চিহ্ন মাত্র। যোগাযোগ দরকার জীবন্ত মানুষের সঙ্গে। সেটা ঘটছে না। লোকে এখন সিনেমা হলে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে, তারা ছবি দেখে একাকী, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পর্দায়। সবকিছুই কামরার ভেতর, তার বাইরে জগৎ নেই। খেলার মাঠ নেই। বেড়াবার পার্ক নেই। পাঠাগার নেই যেখানে থেকে বই আনবে এবং যেখানে গিয়ে মিলিত হবে। পাড়ায় মহল্লায় সাংস্কৃতিক কাজ নেই। মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ থেকেও নেই। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে তো নেই-ই, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশগুলোতে অকার্যকর অবস্থায় আছে। এ রকম অবস্থা ব্রিটিশ কিংবা পাকিস্তান আমলে হলে আমরা ভীষণ উত্তেজিত হতাম, বলতাম অসহনীয় ষড়যন্ত্র। কিন্তু এখন কিছু বলি না। কারণ এখন আমাদের নিজেদের লোকেরাই শাসনকর্তা। কিন্তু এক্ষেত্রে স্বদেশি শাসনকর্তাদের আচরণ যে বিদেশি শাসকদের তুলনাতেও খারাপ সেটা তো পরিষ্কার। ছাত্র সংসদকে ঘিরে সম্ভাব্য

সাংস্কৃতিক কাজকর্মের অভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন শিক্ষিত লোকদের বস্তিতে পরিণত হয়েছে। সেখান থেকে সংস্কৃতিচর্চায় দুর্বল এবং সামাজিকতা-অনুশীলনের সুযোগবঞ্চিত যে তরুণরা বের হয়ে আসছে তারা তাদের নিজের ভবিষ্যতের জন্য তো নয়ই, দেশের ভবিষ্যতের জন্যও কোনো উজ্জ্বল প্রতিশ্রুতি বহন করে না। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জঙ্গি বের হয়ে আসার ঘটনায় তো এই সত্য প্রমাণিতই হয়ে গেছে। অথচ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও যে ক্ষমতা রাখে নিজেদের অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপের সফল প্রতিরোধের সেটার প্রমাণ পাওয়া গেছে ভ্যাট বসানোর বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলনে। ছাত্রদের এই ক্ষমতাকে রাষ্ট্র অত্যন্ত অপছন্দ করে। ভয়ও পায়। কারণ রাষ্ট্র জনবিরোধী। শিক্ষিত তরুণরা রাজনীতিতে অংশ নিতে পারছে না; সমাজ, পরিবার এবং নিজের জন্যও তারা এখন বোঝা। এই বোঝা বিপজ্জনক। এর ভেতর বিস্ফোরক আছে। লুকানো।

বড় দুই রাজনৈতিক দল জনগণের স্বার্থ দেখে না, দেখে নিজেদের স্বার্থ। ওই দুই দলই এখন প্রধান, অন্যগুলো গ্রহ-উপগ্রহ মাত্র। তাদের পারস্পরিক সংঘাত মতাদর্শের নয়, স্বার্থের। মতাদর্শের ক্ষেত্রে তারা অভিন্ন; উভয়েই অসংশোধনীয় রূপে পুঁজিবাদে দীক্ষিত। লক্ষ্য নিজেদের আখের গোছানো। যেকোনো অঘটনের জন্য তারা একে অপরকে দায়ী করে থাকে। জঙ্গি তৎপরতার জন্য বিএনপি-জামায়াতই দায়ী এমন কথা সরকারের বড় বড় মুখপাত্ররা অনর্গল বলছিলেন। সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী তৎপরতা কিন্তু এমন তথ্য দিচ্ছে যে জঙ্গিদের কেউ কেউ আওয়ামী পরিবারেরই সদস্য। এই বাস্তবতার ব্যাখ্যা আছে। এসব পরিবারেরই এখন ক্ষমতা বেশি। আসল সত্য অবশ্য হলো এটা যে, আওয়ামী লীগ বা বিএনপি-জামায়াত নামে পৃথক ঠিকই, কিন্তু শ্রেণিতে এবং কাজে মিলেমিশে তারাই হচ্ছে শাসকশ্রেণি। দীক্ষায় ও আচার-আচরণে তারা পৃথক নয়, পার্থক্য যা তা মূলত নামেই। যখন যে অংশ ক্ষমতায় আসে তখন তারা মেহনতি মানুষের ওপর নিপীড়ন চালাবার কর্তব্য নির্ভুল রূপে পালন করে। মেহনতিদের প্রত্যক্ষ শত্রু হয়ে দাঁড়ায়।

লেখক ইমেরিটাস অধ্যাপক,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সূত্র:দেশরূপান্ত।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION