বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:৫১ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

দ্রুততর সময়ে ধর্ষণের শাস্তি নিশ্চিত হোক

ডা. পলাশ বসু :

ধর্ষণ মূলত নারীর উপর চরম ধরণের মনস্তাত্বিক নিপীড়ন৷ কারণ সারাজীবনে নারীটি তার এই নির্যাতনকে ভুলতে পারে না। কোনো না কোনোভাবে তা তার মনের ভেতরে রয়েই যায়। অনেক নারীর কাছে জীবনে অর্থহীন মনে হয়। তখন আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটে থাকে। এটাকে বলে “রেপ ট্রমা সিনড্রোম”। এই সিনড্রোম সত্যিই ভয়াবহ হতে পারে। সময়ের সাথে সাথে এর তীব্রতা হয়ত কমে আসে। তবে ঐ যে বললাম একদম নিঃশেষিত হয়ে যায় না।

সোশ্যাল মিডিয়ার সূত্রে ধর্ষণ, ধর্ষিতা ও ধর্ষকের বাইরে এ নিয়ে কথা বলছে এমন লোকের সংখ্যা কম নয়।সমস্যা হচ্ছে এদের মধ্যে অনেকে তাদের লেখায় কোন না কোনোভাবে ধর্ষণের দায় নারীর উপরেই চাপিয়ে থাকে। নারীর পোশাক, তার চলাফেরা, ব্যক্তিগত জীবনকে এসব সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত মানুষেরা ধর্ষণের কারণ হিসেবে সরাসরি উল্ল্যেখ করে থাকে।অনেকে আবার একটু ভদ্রতার মুখোশ পরার ভান দেখিয়ে বলে থাকে যে, এসব কথা বলে সে ধর্ষকের পক্ষ নিচ্ছে না; বরং ধর্ষিতারও যে ভুল আছে সেটাই তুলে ধরার চেষ্টা করছে।

মুখ্যত এরা ” পাটসোনালিটি ডিজঅর্ডার” নামক মানসিক সমস্যাগ্রস্থতায় ভুগছে। একটু কঠিনভাবে বললে বলা যায়-এরাও হয়ত ধর্ষকের মতোই মনস্তত্ত্বকে লালন করে থাকে তবে সুযোগের অভাবে এই কালিমা গায়ে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ পারসোনালিটি ডিজঅর্ডারে যারা ভোগে তারা তাদের শান্তির জন্য, স্বস্তির জন্য, সন্তুষ্টির জন্য যে কোন কাজ করতে পারে। এরা সমাজবিরোধী ও খুবই আক্রমনাত্মক ও ভয়াবহ হয়ে থাকে।এদেরকেও চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনাটামনে হয় জরুরি হয়ে পড়েছে।

নোয়াখালীর ঘটনার পরে জনমতের ইচ্ছার প্রতিফলনস্বরূপ ধর্ষণের জন্য মৃতুদন্ড আইন হয়েছে।সম্প্রতি হাইকোর্ট বলেছে, মেডিকেল রিপোর্ট কোন কারণে ধর্ষণ প্রমাণে ব্যর্থ হলে পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও স্বাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই ধর্ষকের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এসব খুবই ভালো উদ্যোগ। তবে, আবারও বলছি আমার মনে হয় এতে ধর্ষক বা ধর্ষিতার সংখ্যা কিন্তু কমবে না। এটা কমাতে হলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। ঘটনা ঘটার পরে প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে ঘটনা যাতে না ঘটে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

এজন্য আমার প্রস্তাব থাকবেঃ
(১) প্রতিটা পরিবারের উদ্দেশ্যে বলব তারা যেন তার ছেলে সন্তানটিকে যথাযথ শিক্ষা দেন। নারীকে সম্মান করতে উৎসাহিত করেন। তাছাড়া বড় কাজ হচ্ছে, পরিবারে ছেলে ও মেয়ে শিশুকে আলাদাভাবে দেখার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে।ছেলে মেয়ে উভয়কেই সমান গুরুত্ব দিয়ে মানুষ করে তুলতে হবে। আচ্ছা, বলুন তো, ধর্ষকের পিতা-মাতা পরিচয়ের চেয়ে আর কোন খারাপ কিছু কি কারো জীবনে ঘটতে পারে? ফলে আপনি ছেলে সন্তানের জন্য, নিজের জন্য হলেও তাকে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, বিবেকবান মানুষ হিসেবে গড়ে তুলুন।
(২) সমাজের প্রভাবশালী লোক, রাজনৈতিক অঙ্গনের ক্ষমতাবান মানুষ, মাতব্বর টাইপের যারা আছেন তারা দয়া করে ধর্ষণের ঘটনার পরে আপোষ মীমাংসার জন্য মেয়েটির পরিবারকে চাপ দিবেন না। শুধু তাই নয়, অনেক সময় ধর্ষকের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়ারও কথা আমরা শুনতে পাই। এতে কি সমাজের কোন উপকার হবে? অন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করে কোনো সমাজ কখনো উন্নত হয়েছে, দেখাতে পারবেন?

(৩)এখন আসি রাষ্ট্রের দায় প্রসঙ্গে। রাষ্ট্রের প্রথম কাজ হচ্ছে, ছোট ছোট বাচ্চাদের মনস্ত্বত্ব নিয়ে কাজ করা।সেই সাথে আইনের শাসন দ্রুততম সময়ে প্রতিষ্ঠা করা। ছোট ছেলেমেয়েদেরকে জেন্ডার, ধর্ম, গায়ের রং, পোশাক আশাক এসব দিয়ে মানুষকে বিচার নয় বরং তাদেরকে শেখাতে হবে সকল মানুষই স্রষ্টার কাছে সমান তাই আমরা মানুষ হিসেবে যেন কোনো বৈষম্য না করি। এজন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে।একে মানুষ তৈরির কারখানা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

এ সব কথা মাথায় রেখে প্রাইমারি থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠে অধ্যয়নরত ছেলে-মেয়েদের জন্য সাইকোলজিস্ট নিয়োগ দিতে হবে। তারা সপ্তাহে অন্তত ১ দিন করে সকল ক্লাসে ছেলে-মেয়ে সবাইকে কাউন্সিলিং করবে, উদ্বুব্ধ করবে সমাজবিরোধী কাজে জড়িত না হতে।

আর সবসময়ই একটা কথা শুনে থাকি “আইনের মারপ্যাচে” অপরাধীরা নাকি পার পেয়ে যায়। ফলে এই যে বস্তাপচা এক কথা “আইনের মারপ্যাচ” বলে যা শুনছি তাকে কি বিদেয় করা যায় না? আইনকে কি যুগোপযোগী করা যায় না? আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে বিচার প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। আমাদের জানা আছে যে আমাদের বিচারিক স্বল্পতা আছে। এজন্য যথেষ্ট সংখ্যক বিচারক নিয়োগ দিতে হবে।

সেই সাথে যে কোন সন্দেহভাজন মৃত্যু, হত্যা বা ধর্ষণ কেসে “ফরেনসিক রিপোর্ট” খুব গুরুত্বপূর্ণ হলেও এ সেক্টরে ডাক্তারের সংখ্যা তীব্র অপ্রতুল। এটা কাটিয়ে উঠতে হবে। নতুন তৈরী হওয়া প্রতিটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে “ফরেনসিক মেডিসিন ডিপার্টমেন্ট” জরুরি ভাবে চালু করুন।আর মেডিকেল কলেজগুলোতেও এ বিষয় যথেষ্ট শিক্ষক নেই। এ সেক্টরে গুণগত শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করুন।

এবার আসুন পুলিশ বিভাগের কাজ নিয়ে দুটো কথা বলি। ধর্ষণের যে কোন ঘটনায় পুলিশই যেহেতু রাষ্ট্রের প্রথম “রেসপন্স ও রেসকিউ” টিম ফলে এ কাজে প্রতিটা থানায় আলাদাভাবে প্রশিক্ষিত পুলিশ বিশেষ করে মহিলা পুলিশ নিয়োজিত করা যেতে পারে। এর ফলে ধর্ষিতা অযাচিত প্রশ্নবান থেকে রেহাই পাবে। তাতে তার আত্মবিশ্বাস বাড়বে।অন্যরা তখন উৎসাহিত হয়ে ঘটনা লুকিয়ে না রেখে থানায় আসবে অভিযোগ দায়ের করতে। এদিকে প্রতিটি কর্মরত পুলিশ সদস্যরা যে মেন্টাল স্ট্রেস নিয়ে কাজ করেন সেটা প্রতিটি পুলিশ স্টেশনে কাউন্সিলিং ও মেডিটেশনের জন্য সময় নির্ধারণ করা উচিত।এটা হলে এসব শিখে নিয়ে পুলিশ সদস্যরা স্ট্রেসকে যথাযথভাবে মোকাবেলা করতে পারবেন। তাতে তাদের কাজের কোয়ালিটি বাড়বে।

পরিশেষে বলব, আসুন সবাই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সমাজবিরোধী লোকদেরকে প্রতিহত করি। নিজে যেমন সমাজবিরোধী কাজে জড়িত হবো না তেমনিভাবে পরিবারের কাউকে তাতে জড়িত হতে দিব না।নাগরিক হিসেবে সবাই আমরা যদি আমাদের কাজটুকু যথাযথভাবে করে যাই তাহলেই কিন্তু সমাজ তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে সহজেই পৌঁছতে পারবে।

লেখক : শিক্ষক ও চিকিৎসক, সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ এনাম মেডিকেল কলেজ।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION