বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:৫৫ পূর্বাহ্ন
নিতাই চন্দ্র রায়:
মোটা চাল, আলুভর্তা ও পাতলা ডাল হলো শ্রমজীবী খেটে খাওয়া মানুষের প্রধান খাদ্য। মাছ, মাংস, দুধ ও ডিম এসব লোকের ভাগ্যে বড় বেশি জোটে না। ডিম ও আলু ব্যাচেলর ও মেসে বসবাসরত ছাত্রছাত্রীদের পছন্দের খাবার। ভাতের সঙ্গে আলু সেদ্ধ, তাতে কটা কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজের কুচি ও খাঁটি সরিষার তেল, বড় পছন্দ বাঙালি জনগোষ্ঠীর। বাম্পার ফলন হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে প্রতি কেজি মোটা চাল দেশের বিভিন্ন হাটবাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা। শুধু চাল নয়; ২০ টাকা কেজির আলুও বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা কেজিতে। মোটা চাল ও আলুর দাম প্রতি কেজি ৫০ টাকা হলে এই করোনাকালে স্বল্প আয়ের খেটে খাওয়া গরিব মানুষগুলো বাঁচবেই বা কীভাবে?
সবজির জন্য এটা হলো ক্রান্তিকাল। এ সময়ে খরিপের সবজি শেষ হয়ে যায়। আবার শীতের সবজি বাজারে আসতেও বিলম্ব হয়। এবার বিলম্বিত বর্ষা, অতিবৃষ্টি ও তিন তিনবার বন্যার প্রাদুর্ভাব শীতের সবজির আগমনে বিঘœ ঘটায়। এ সময়ে পণ্যটির দাম স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে একটু বেশি থাকে। কিন্তু চার গুণ, পাঁচ গুণ হয় না। এবারের ব্যাপারটা একেবারে ভিন্নতর। মার্চ থেকে মে-জুন পর্যন্ত করোনার ভয়াবহ দিনগুলোতে লকডাউন এবং পরিবহন বন্ধ থাকায় কৃষিপণ্য সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়ে। কৃষকের কষ্টে উৎপাদিত শাকসবজি বিক্রি না হওয়ায় মাঠে পচে জৈবসারে পরিণত হয়। শাকসবজি খুব পচনশীল কৃষিপণ্য। একদিকে কৃষক যেমন উৎপাদিত সবজি নিজে সংরক্ষণ করতে পারেন না, অন্যদিকে দেশে আলু ছাড়া অন্য পচনশীল কৃষিপণ্য সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থাও নেই। আমাদের দেশের মানুষ হিমাগারে সংরক্ষিত সবজি খেতে পছন্দ করেন না। তারা চান ক্ষেত থেকে তোলা তরতাজা সবজি। হোক তা বালাইনাশকযুক্ত। তাতেও তাদের আপত্তি নেই।
এ বছর করোনার কারণে কৃষি ও কৃষি খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়। শিল্প খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তারা সরকার ঘোষিত প্রণোদনার অর্থ সময়মতো পেয়ে ক্ষতি অনেকটা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন। কিন্তু দুর্ভাগা কৃষকরা তা পারেননি। প্রধানমন্ত্রী করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষয়-ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য ৪ শতাংশ সুদে কৃষিঋণ প্রণোদনা ঘোষণা করেন। করোনায় কৃষক পানির দামে পণ্য বেঁচে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। তারপর আম্পান আঘাত হানে। এবারের আম্পানের আঘাত শুধু উপকূল অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল না। আম্পানের আঘাতে রাজশাহী, নাটোর, যশোর এলাকার শাকসবজি ও মৌসুমি ফলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। বাগানে বাগানে অপরিপক্ব আম ও লিচুর স্তূপ দেখে কত ফলচাষি কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন, সেই পরিসংখ্যান আমাদের জানা নেই। করোনা গেল। ঘূর্ণিঝড় আম্পান গেল। এলো বন্যা। একবার নয়, তিনবার। এবারের বন্যায় মাঠের সবজি শুধু নয়, বীজতলার চারাও বিনষ্ট হয়ে যায়। সবজিচাষিরা অসহায় হয়ে পড়েন। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, এক ইঞ্চি জমিও ফেলে রাখা যাবে না। কৃষি মন্ত্রণালয় কালিকাপুর মডেলে প্রতিটি বসতবাড়িতে সবজি বাগান গড়ে তোলার প্রকল্প গ্রহণ করে। এই কাজে বিনামূল্যে সবজিবীজ, সার ও সবজিচাষিদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয়। তার পরও সবজির অগ্নিমূল্য রোধ করা যায়নি।
বাংলাদেশ সবজি উৎপাদনে পৃথিবীতে তৃতীয়। প্রতি বছর প্রায় ১৬০ থেকে ১৭০ মিলিয়ন টন সবজি উৎপাদিত হয়। ১৭ কোটি মানুষের জন্য এটা খুব কম নয়। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে শীত মৌসুমে ৫.৩৯ লাখ হেক্টর জমি থেকে ১১৬.৪৫ লাখ টন এবং গ্রীষ্মকালে ৩.২০ লাখ হেক্টর জমি থেকে ৫৬.০১ লাখ টন অর্থাৎ দুই মৌসুম মিলে ওই বছর ৮.৫৯ লাখ হেক্টর জমি থেকে ১৭২.৪৭ মিলিয়ন টন সবজি উৎপন্ন হয়। গড়ে সবজি উৎপাদন হয় হেক্টরপ্রতি ২০.১০ টন। বর্তমানে বাংলাদেশে ৬০ ধরনের ও ২০০ জাতের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। ১ কোটি ৬২ লাখ কৃষক পরিবার এই সবজি চাষের সঙ্গে জড়িত। আজ থেকে ২০ বছর আগে দেশে মাথাপিছু দৈনিক সবজি ভোগের পরিমাণ ছিল ৪২ গ্রাম। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬৬ গ্রামে। সঠিক সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণের অভাবে বাংলাদেশে উৎপাদিত ফল ও সবজির প্রায় ৩১ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। হর্টেক্স ফাউন্ডেশনের ‘পোস্ট হারভেস্টে ম্যানেজমেন্ট অব ফ্রুট অ্যান্ড ভেজিটেবলস ফর ফুড সেফটি অ্যান্ড কোয়ালিটি অ্যাসিউরেন্স’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়, জমি থেকে ফসল সংগ্রহের পর ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে এই বিপুল পরিমাণ ফল ও সবজি নষ্ট হয়। সবজির মধ্যে সবচেয়ে বেশি নষ্ট হয় টমেটো। উৎপাদিত টমেটোর শতকরা ৪২ শতাংশ নষ্ট হয় সংগ্রহ-উত্তর দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে। অন্যান্য সবজির মধ্যে ফুলকপি ২২, শসা ২৪.৩, বাঁধাকপি ২৫ ও শিম ২৯.৩ শতাংশ নষ্ট হয়। সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশে এটি একটি মৌলিক ও জটিল সমস্যা।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধের প্রথম ধাপ হলো ব্যক্তিগত সচেতনতা বৃদ্ধি এবং শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলা। এসবের মাধ্যমে করোনাভাইরাস সংক্রমণের মারাত্মক লক্ষণ; শ্বাসকষ্ট ও পরিপাকতন্ত্রের সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব। ভাইরাস হলো প্রোটিন ও নিউক্লিক অ্যাসিডের সমন্বয়ে গঠিত অতি আণুবীক্ষণিক অকোষীয় রোগ সৃষ্টিকারী বস্তু। মানুষ জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট, এমনকি মারাত্মক নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে ভাইরাসের কারণে। তাই শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রতিদিন বেশি পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে।
অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হলো কিছু ভিটামিন, মিনারেল ও এনজাইম, যা শরীরের ক্ষতিকর ফ্রি র্যাডিকেলের বিরুদ্ধে লড়াই করে শরীরের কোষগুলোকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচিয়ে জীবাণু সংক্রমণ ঝুঁকি প্রতিরোধ করতে সক্ষম। উদ্ভিজ্জ খাবার হলো অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের সবচেয়ে উত্তম উৎস। প্রধান প্রধান অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হলো বিটা ক্যারোটিন, ভিটামিন-এ, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-ই ও লাইকোপেন। ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে যে খাবারগুলো বেশি করে খাওয়া দরকার, সেগুলো হলো ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ গাজর, পালং শাক, মিষ্টি আলু, মিষ্টি কুমড়া, জাম্বুরা, ডিম, কলিজা ও দুধজাতীয় খাদ্য। ভিটামিন-ই সমৃদ্ধ কাঠবাদাম, চীনাবাদাম, পেস্তাবাদাম, বাদাম তেল, বিচিজাতীয় ও ভেজিটেবল অয়েল, জলপাইয়ের আচার ও সবুজ শাকসবজি। ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ আমলকী, লেবু, কমলা, কাঁচা মরিচ, করলা ইত্যাদি। পেঁপেতে প্রচুর পেপেইন এনজাইম আছে, যা মানুষের পাকস্থলীতে আমিষ হজমে সহায়তা করে। আরও আছে পটাশিয়াম, সোডিয়াম ও ভিটামিন-এ, বি, ও সি এবং টমেটোতে রয়েছে প্রচুর লাইকোপেন।
তাহলে কথা হলো অ্যান্টি-অক্সিডেন্টযুক্ত প্রতিটি শাকসবজির দাম যদি ভোক্তা সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে থাকে, তারা যদি তা পরিমাণ মতো খেতে না পারে, তাহলে মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি হবে কীভাবে? আর কীভাবেই করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ হবে এটাই এখন জাতীয় জীবনে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ সবজির ব্যবহার বাড়াতে হলে আমাদের বসতবাড়ির আশপাশে, ছাদবাগানের টবে, বস্তায়, হাফ ড্রামে কিংবা স্থায়ী বীজতলায় এসব সবজির আবাদ করতে হবে। এখনই এসব শাকসবজি লাগানোর উপযুক্ত সময়। এ ব্যাপারে সরকারের কৃষি বিভাগকে শাকসবজির উন্নত ও উচ্চ ফলনশীল জাত, চাষপদ্ধতি, পরিচর্যা, সমন্বিত পদ্ধতিতে রোগ ও পোকা দমন প্রভৃতি বিষয়ে বসতবাড়ি ও ছাদের সবজিচাষিদের প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়ার কাজ আরও জোরদার ও গতিশীল করতে হবে। বসতবাড়ি ও ছাদবাগানে উৎপাদিত বিষমুক্ত সবজি বিক্রির জন্য প্রতিটি উপজেলা ও জেলা শহরে আলাদা কৃষক সবজি বাজার সৃষ্টি করতে হবে, যেখানে উৎপাদনকারীরা তাদের বিষমুক্ত সবজি ন্যায্য দামে সরাসরি ভোক্তার কাছে বিক্রি করার সুযোগ পান। কারণ দেখা গেছে, সবজির খুচরা দাম যেভাবে বেড়েছে, সেভাবে কিন্তু কৃষকের কাছ থেকে সবজি কেনা হচ্ছে না। পাইকারি ব্যবসায়ী, আড়তদার ও খুচরা ব্যবসায়ীরাই সবজির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি থেকে বেশি লাভবান হচ্ছেন। এ ছাড়া সবজি সংরক্ষণের জন্য দেশের সবজি উৎপাদন এলাকাগুলোতে হিমাগার স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। উৎপাদিত সবজি ও ফল থেকে জুস, জ্যাম, জেলি, কাট সবজি, সবজির আচার তৈরির জন্য সবজি উৎপাদনকারী নারীদের নিজ বাড়িতে স্বল্পমূল্যে সবজি প্রক্রিয়াকরণ পণ্য উৎপাদন ও বিপণনে প্রশিক্ষণ এবং ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ ক্রয়ে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে একদিকে দারিদ্র্যবিমোচন, কর্মসংস্থান, পুষ্টি নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিশ্চিত করা অনেকাংশে সম্ভব হবে। সম্ভব হবে করোনাভাইরাসের মতো সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ করা।
লেখক সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি), নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস লিমিটেড, নাটোর
netairoy18@yahoo.com