বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:৫৫ পূর্বাহ্ন
বদরুল হাসান:
ধর্ষণের বিরুদ্ধে আমাদের সমাজে আগে থেকেই বেশ জোরালো জনমত ছিল। কিন্তু নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে স্বামীকে বেঁধে এক মহিলাকে পাশবিকভাবে ধর্ষণ ও অমানবিকভাবে তার বস্ত্রহরণ করে ভিডিওচিত্র ধারণ এবং পরিশেষে সেটা সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ এক সামাজিক আন্দোলনের জন্ম দেয়। সেখানে ধর্ষণ প্রতিরোধে সর্বোচ্চ শাস্তি বিধানের দাবি ওঠে। সরকারও ত্বরিতগতিতে সে দাবি মেনে নিয়ে আইন সংশোধন করে ফেলে; নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ (সংশোধন) অর্ডিন্যান্স, ২০২০ জারি করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের স্থলে মৃত্যুদণ্ড প্রবর্তন করে। ইতিমধ্যে এ আইনের আওতায় বিচার ও রায় প্রদান শুরু হয়ে গেছে; দাবি দ্রুত পূরণ হওয়ায় আন্দোলনও ফিকে হয়ে পড়েছে। এখন প্রশ্ন হলো এই আইন সমাজের এই জঘন্য ব্যাধি ও তার কালিমা প্রতিরোধে কতটুকু কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে?
ভারতের বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা তপন সিংহ ‘গ্যাং রেইপ’ বা ‘দলবদ্ধ ধর্ষণ’ নিয়ে একটি সিনেমা তৈরি করেছিলেন। তার নির্মিত ও পুরস্কারপ্রাপ্ত অনেক সিনেমার মধ্যে ১৯৮২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘আদালত ও একটি মেয়ে’ যারা দেখেছেন, তারা এক ঘণ্টা বাহান্ন মিনিটে সমাজের এই কর্কটসম রোগের বিভীষিকা কিছুটা উপলব্ধি করেছেন। ধর্ষণ একটি নিগৃহীত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা যার শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক দাগ মারাত্মক, কিন্তু এর সামাজিক অভিঘাত অপরিমেয়। ঐ ছবিতে ধর্ষণের শিকার তনুজার বাবা সামাজিক গ্লানির ভয়ে প্রথমে মেয়েকে আদালতে দাঁড় করাতেই চাননি। কিন্তু পোড়-খাওয়া সৎ তদন্তকারী পুলিশ অফিসারের অনড় মনোভাব এবং ধর্ষিতার দৃঢ়তার জন্য এ অপরাধের বিচার এবং পরিশেষে শাস্তি হয় ঠিকই, কিন্তু ভুক্তভোগী আদালতের কাঠগড়ায় প্রতিপক্ষের আইনজীবীর শাণিত ও তির্যক জেরায় দ্বিতীয় বার যেন ধর্ষণের শিকার হন। শুধু তাই না, বিনা দোষে সমাজে তিনি হয়ে পড়েন অপাঙ্ক্তেয় এবং কর্মস্থলে হয়ে পড়েন চাকরিচ্যুত। পিতার অবস্থাও হয় তথৈবচ; সমাজের সর্বত্র তার নতুন পরিচিতি লাভ হয় ধর্ষিতার পিতা হিসেবে; কর্মস্থলে সহকর্মীরা নির্যাতিত কন্যার জন্য তার প্রতি অযাচিত সহমর্মিতার অতিশয়োক্তিতে মেতে ওঠেন। শেষ পর্যন্ত তিনি তার টেবিলে একটি প্ল্যাকার্ডে ‘আমার ধর্ষিত কন্যা ভালো আছেন’ লিখে রেখে এই অতিরঞ্জনের জ্বালা থেকে মুক্তিলাভের চেষ্টা করেন। প্রায় চল্লিশ বছর পর আমাদের সমাজে এই চিত্র এখনো অবিকল রয়ে গেছে।
আসলে ধর্ষণের জন্য শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদন্ড কম কিছু ছিল না। তারপরও মৃত্যুদন্ডের দাবি এত জোরালো হওয়ার কারণ সমাজে প্রতিনিয়ত এর ক্রমবর্ধমান আঘাত এবং তার কল্পনাতীত বীভৎসতা। তাছাড়া, সাক্ষীপ্রমাণ ও দলিলের অভাবে এ অপরাধের বিচারে শাস্তির হার খুব কম। এখন যে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড করা হয়েছে এবং কিছু কিছু জায়গায় সে শাস্তি প্রদান করে রায় ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে কি এ অপরাধের মাত্রা বাঞ্ছিত পর্যায়ে নেমে আসবে? আমার কিন্তু তা মনে হয় না। এখনো প্রতি দিনই সংবাদপত্রে ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে এর খবর ছাপা হচ্ছে; লাঘবের কোনো লেশমাত্র দেখা যাচ্ছে না। বরং অনেকে মনে করছেন যে, বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন না করা হলে কঠোর এই আইনের অপব্যবহারের আশঙ্কা রয়েছে। অন্তত অতীতের কিছু অভিজ্ঞতা সে কথারই সমর্থন দেয়।
ধর্ষণের কারণ সম্পর্কে নানাজন নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নানা তত্ত্ব ও ব্যাখ্যা উপস্থাপনের চেষ্টা করে থাকেন। রক্ষণশীলদের মতে, সমাজে ছেলে-মেয়েদের অবাধ মেলামেশা, পর্নোগ্রাফির ছড়াছড়ি, শারীরিক আকর্ষণ বাড়াতে মেয়েদের আঁটসাঁট বা ঢিলেঢালা পোশাক পরিধান, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অভাব, সন্তানদের ওপর বাবা-মার নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির অভাব প্রভৃতি এই সামাজিক অপরাধটির আগ্রাসী হয়ে ওঠার পেছনে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। আবার প্রগতিশীলরা মনে করেন যে, রক্ষণশীল সমাজে প্রাপ্তবয়স্কদের স্বাভাবিক যৌনক্ষুধা মেটানোর সুযোগের অভাবই প্রধানত ধর্ষণকে উৎসাহিত করে। নারীবাদীরা বলেন যে, ধর্ষণ ও জবরদস্তি যৌনাচার সমাজের পুরুষতান্ত্রিক কর্র্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার প্রতিফলন। এসব মতবাদের মধ্যেই অল্পবিস্তর সত্যতা থাকলেও ধর্ষণকে কোনো একটি তত্ত্ব দিয়ে পরিপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। এর পেছনে রয়েছে এক জটিল আর্থ-সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক ও শারীরিক কারণ।
আমি বড় হয়ে উঠেছি এক রক্ষণশীল সমাজে। কিন্তু সেখানে এই ব্যামোর কোনো কমতি লক্ষ্য করিনি; জবরদস্তি যৌনাচার সেখানে ছিল এন্তার। কিন্তু তার প্রকাশ ছিল থোড়াই। অধিকন্তু পায়ুকামের নির্যাতন এবং পশুকামও সেখানে অবিদিত ছিল না। এইসব ক্ষেত্রে যৌন সুড়সুড়ির কোনো বালাই নেই। শহরাঞ্চলেও এখন দেখছি যে, ষাট বছরের বৃদ্ধ বিনা শারীরিক আবেদনে ছয় বছরের শিশুকে বলাৎকার করছে। ধর্মীয় শিক্ষায় আলোকপ্রাপ্তরাও এই পাপাচার থেকে মুক্ত নন। পশ্চিমা বিশ্বে এবং আমাদের শহরাঞ্চলগুলোতে এখন নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশায় আর তেমন কোনো বাধা নেই। কিন্তু এ ব্যাধির গতি সেখানেও অবারিত।
তবে পুরুষতান্ত্রিক কর্র্তৃত্ববাদ যে ধর্ষণকে বহুলাংশে লালন করছে, তা বলাই বাহুল্য। এ সমাজে নারীই ধর্ষিত হয়; পুরুষ খুব কম। তাছাড়া, এ কলঙ্কের কালিমা একতরফাভাবে নারীর গায়ে লেপিত হয়; ধর্ষক পুরুষ থাকে নিষ্কলঙ্ক। বরং অনেক ক্ষেত্রে সে যে শৌর্যবীর্যের অধিকারী, তা আস্ফালন করে প্রচার করা হয়। আর নারী প্রতিকার চাইতে গেলে সমাজে, আদালতে, কর্মক্ষেত্রে, পরিবারে সে প্রতীকী অর্থে দ্বিতীয়বার, তৃতীয়বার ধর্ষণের শিকার হন। কাজেই ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে আনতে এই ক্ষেত্রগুলোতে সামাজিক পরিবেশ নারীর অনুকূলে আনার ব্যবস্থা নিতে নীতিনির্ধারক রাজনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের অনেক কাজ করতে হবে। তবে পরিস্থিতির দ্রুত উন্নয়নে স্বল্পমেয়াদেও কিছু কাজ করা জরুরআমাদের সমাজে যত ধর্ষণ বা বলাৎকার হয়, স্বাভাবিক কারণেই তার একটি যৎসামান্য অংশ প্রকাশিত হয়। আর আইন-আদালত পর্যন্ত গড়ায় তার একটা ভগ্নাংশ মাত্র। কারণ, এখানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, আদালত, চিকিৎসাসেবা প্রতিটি স্তরে পুরুষের প্রাধান্য
স্বীকৃত। নারী সেখানে কোথাও স্বস্তিবোধ করেন না, প্রতিপক্ষও নারীর মনের এই অবস্থা এবং পরিস্থিতির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে থাকে। ধর্ষণের শিকার অধিকাংশ নারীর পক্ষে কোনো পুরুষ পুলিশ কর্মকর্তার কাছে তার বিরুদ্ধে কৃত যৌন অপরাধের বিস্তারিত বিবরণ উপস্থাপন করা সম্ভব হয় না। একইভাবে প্রকাশ্য আদালতে যখন এর বিচার শুরু হয়, তখন পুরুষ বিচারক, পক্ষ-বিপক্ষের পুরুষ আইনজীবী ও আদালতে উপস্থিত অসংখ্য পুরুষ দর্শকের সামনে যেভাবে আলামত উপস্থাপন, সাক্ষ্যগ্রহণ, জেরা, যুক্তিতর্ক, জবাব ও সওয়াল জবাব চলে, তা যে ধর্ষিত নারীর জন্য কী ধরনের বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, অধিকাংশ স্বপক্ষীয় পুরুষেরও সেটা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। সে কারণে এই অপরাধের মামলা যেমন কম হয়, তেমনি কম হয় এসব মামলায় শাস্তি। কিছু ক্ষেত্রে শাস্তি হলেও মামলার দীর্ঘসূত্রতা সে সব সাফল্যকে মøান করে দেয়; ‘জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনাইড’ তত্ত্ব যেটা নির্দেশ করে। মামলায় শাস্তির হার বাড়ানো এবং দ্রুততম সময়ে অপরাধীকে শাস্তি দিতে পারলে সাফল্যের সম্ভাবনা বেশি থাকে।
এ জন্য ধর্ষণের অপরাধের তদন্ত ও বিচারকাজের পরিবেশ নারীর অনুকূলে নিয়ে আসতে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। ধর্ষণের তদন্ত কোনো নারী পুলিশ কর্মকর্তা করলে ধর্ষিতা যেভাবে সহযোগিতা করতে পারবে, কোনো পুরুষ হলে নিশ্চয়ই তার পক্ষে সেভাবে সহযোগিতা করা সম্ভব হবে না। ফলে শাস্তির হার নিম্নগামী হতে বাধ্য এবং ভবিষ্যৎ প্রতিরোধক হিসেবে তা তেমন একটা ভূমিকা পালন করতে পারে না। এর প্রতিষেধক হিসেবে এসব অপরাধের তদন্তে পর্যাপ্ত নারী তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করার ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। একইভাবে ধর্ষণের বিচারে আদালতের তিনটি পক্ষ বিচারক, পক্ষ ও প্রতিপক্ষের আইনজীবী সবাই যদি মহিলা হন এবং দর্শকদের যদি শুধু নারীর মধ্যে সীমিত রাখা যায়, তবে পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হতে পারে। ধর্ষণের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে পর্যাপ্ত বিচারক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। পরিস্থিতির উন্নতি ঘটলে তখন প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থার সংস্কার করা যেতে পারে।
আমাদের সংবিধান অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বিশেষ বিধান প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে নিয়েছে। এই কর্কট রোগ আমাদের জনগোষ্ঠীর অর্ধাংশের ভাগ্যোন্নয়নে যে পর্বত-প্রমাণ বাধার সৃষ্টি করছে, তা অপসারণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থার প্রবর্তন একান্তভাবেই কাম্য।
লেখক খাদ্য অধিপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক
rulhanpasha@gmail.com