মঙ্গলবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৪৪ অপরাহ্ন
চিররঞ্জন সরকার:
অবশেষে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভাসানচরে স্থানান্তর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বলা যায় জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আপত্তিকে উপেক্ষা করে সরকার অনেকটা একক সিদ্ধান্তেই এই স্থানান্তর প্রক্রিয়া শুরু করেছে। স্বেচ্ছায় যেতে আগ্রহী প্রায় দেড় হাজার রোহিঙ্গার প্রথম দল ইতিমধ্যেই ভাসানচর পৌঁছেছে। এতকাল ধরে তারা কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থান করছিলেন।
কক্সবাজার ও তার বাইরে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে নিয়ে নানা সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির কারণে দুই বছর আগে সরকার তাদের একটি অংশকে ভাসানচরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের জন্য ২০১৭ সালে ‘আশ্রয়ণ-৩’ নামে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়।
সরকারিভাবে আপাতত এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এজন্য প্রায় ১৩ হাজার একরের ভাসানচরকে প্রস্তুত করা হয়েছে। ১ লাখ ৩ হাজার ২০০ জনের বসবাসের জন্য ১২০টি গুচ্ছগ্রামে এক হাজার ৪৪০টি ব্যারাক হাউজ ও ১২০টি শেল্টার স্টেশন নির্মাণ, উপাসনালয় নির্মাণ, দ্বীপটির নিরাপত্তার জন্য নৌবাহিনীর অফিস ভবন ও বাসভবন, অভ্যন্তরীণ সড়ক, পানি নিষ্কাশন অবকাঠামো, নলকূপ ও পানি সরবরাহ অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সেখানে আধুনিক বর্জ্য ও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাপনা, বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট ও সৌরবিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পেরিমিটার ফেন্সিং ও ওয়াচ টাওয়ার, বিভিন্ন যানবাহনের ব্যবস্থা, গুদামঘর, জ্বালানি ট্যাঙ্ক, হেলিপ্যাড, চ্যানেল মার্কিং ও মুরিং বয়, বোট ল্যান্ডিং সাইট, মোবাইল টাওয়ার, রাডার স্টেশন, সিসি টিভি, সোলার প্যানেল, জেনারেটর ও বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন ইত্যাদি নির্মাণেরও প্রক্রিয়া চলছে।
চলতি বছরের শুরু থেকেই সরকারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের ব্যাপারে উদ্যোগ-আয়োজন শুরু হয়। কিন্তু জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর আপত্তির কারণে তা থমকে যায়। সাগরের মাঝে বিচ্ছিন্ন ওই দ্বীপে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে রোহিঙ্গারা কতটা নিরাপত্তা পাবে, তা নিয়ে তাদের উদ্বেগ। যদিও আবহাওয়ার ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ১৭৬ বছরের মধ্যে কোনো ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্র এই দ্বীপের ওপর দিয়ে অতিক্রম করেনি।
রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর নিয়ে শুরু থেকেই জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সরকারের মতভেদ দেখা দেয়। এই মতভেদ ক্রমেই তীব্র হয়ে ওঠে। গত ২২ মে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘তাদের বিরোধিতা করার একটি কারণ হলো ভাসানচরে কোনো বিলাসবহুল হোটেল সুবিধা নেই।… কুতুপালংয়ে থাকলে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে কক্সবাজারের নামিদামি হোটলে তারা থাকতে পারেন। দায়িত্ব পালন শেষে সেখান থেকে বিকাল ৩টায় কক্সবাজারে চলে এসে বাকি সময় তারা আড্ডা এবং ঘুমিয়ে কাটাতে পারেন।’
ক্ষুব্ধ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘অন্য দেশগুলোরও দায়িত্ব আছে। রোহিঙ্গারা শুধু আমাদের একারই সমস্যা না, এটা সারা বিশ্বের সমস্যা। সমুদ্র তীরবর্তী অন্য দেশগুলো তাদের নিতে পারে। কিংবা যারা আমাদের আদেশ-উপদেশ দেন তারাও নিতে পারেন। তাদের জায়গার কোনো অভাব নেই। আমাদের দেশের মাথাপিছু বার্ষিক আয় হলো ২,০০০ ডলার এবং প্রতি বর্গমাইলে ১,২০০ লোক বসবাস করে। যেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বার্ষিক আয় হলো ৫৬ হাজার ডলার এবং সেখানে প্রতি বর্গমাইলে বাস করে মাত্র ১৫ জন। তারা তাদের (রোহিঙ্গা) নিচ্ছেন না কেন? রোহিঙ্গাদের ভালো জীবন দিতে চাইলে আপনারা তাদের নিয়ে যান। রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।’
আসলে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা মোটেও সন্তোষজনক নয়। তারা রোহিঙ্গাদের স্বার্থ ও মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে নানাভাবে বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। কিন্তু যে দেশের শাসকদের কারণে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হয়েছে, সেই মিয়ানমারের বিরুদ্ধে তেমন কোনো শক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত যৌক্তিক ও মানবিক একটি সিদ্ধান্ত। সেখানে রোহিঙ্গাদের জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা, উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন, সন্তানদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা এবং জীবিকারও সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। কক্সবাজারে ক্যাম্পে গাদাগাদি করে রোহিঙ্গারা যে কষ্টকর জীবনযাপন করছেন, তার থেকে অনেক উন্নত ব্যবস্থা করা হয়েছে ভাসানচরে।
কিন্তু জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা অযৌক্তিকভাবে এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে। গত তিন বছরে শুধু মানবিক সহায়তা কার্যক্রম ছাড়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে জাতিসংঘের কার্যকর ভূমিকা দেখা যায়নি। অবশ্য বিশ্বে যতগুলো শরণার্থী সমস্যা আছে তার কোনোটিই জাতিসংঘ সমাধান করতে পারেনি। এমনকি বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের ওপর যতটা চাপ দেওয়া দরকার তা দেয়নি। বরং রোহিঙ্গা সংকটকে পুঁজি করে তারা নিজেদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা করছে। কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরের মতো জায়গায় স্থানান্তর করলে রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে এই স্বার্থ উদ্ধারের রাজনীতি সংকুচিত হয়ে পড়বে বলেই কি তাদের এই বিরোধিতা?
একথা ঠিক যে, রোহিঙ্গাদের মধ্যে একটি বিশেষ গ্রুপ ভাসানচরে যেতে চান না। এই গ্রুপটি স্থানীয় একটি সুবিধাভোগী পক্ষের সহযোগিতায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে মাদক ব্যবসা, অস্ত্র চোরাচালান, নারী পাচারের মতো কর্মকাণ্ড করে লাভবান হচ্ছে। ক্যাম্পের ভেতরে দীর্ঘদিন ধরেই এ ব্যবসা চলছে বলে তথ্য এসেছে। এখন পরিস্থিতি অনেক বেশি খারাপ পর্যায়ে চলে গেছে। তার প্রমাণ ক্যাম্পের ভেতরে ধারাবাহিক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের ব্যবসা নিয়েই সংঘর্ষ হচ্ছে বলে খবর আসছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, কক্সবাজারে ক্যাম্পের ভেতরে রাতে পুলিশ পর্যন্ত ঢুকতে বাধা পায়। রাতে ক্যাম্পের ভেতরে কী হচ্ছে কেউ জানতে পারছে না। এ অবস্থা সার্বিক নিরাপত্তার ব্যাপারে যথেষ্ট উদ্বেগ তৈরি করেছে। এ পরিস্থিতিতে কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে চাপ কমাতে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর সরকারের সময়োপযোগী ও ইতিবাচক পদক্ষেপ।
এ কথা ঠিক যে, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনই রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান। যতদিন তা হচ্ছে না, ততদিন কক্সবাজারের ওপর থেকে চাপ কমানোরও বিকল্প নেই। কিন্তু জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ভূমিকা দেখে সন্দেহ হয়, তারা আদৌ এ সমস্যার সমাধান চায়, না সমস্যাকে জিইয়ে রাখতে চায়? গত ২২ অক্টোবর ২০২০ অনুষ্ঠিত দাতাদের এক ভার্চুয়াল আন্তর্জাতিক সম্মেলনে রোহিঙ্গাদের জন্য ৬০০ মিলিয়ন ডলার বা ৬০ কোটি ডলারের মানবিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ দাতাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অন্তত ১০ বছরের জন্য রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার নিশ্চয়তা বিধান করা দরকার।
প্রশ্ন হলো, দাতাদের মাথায় ১০ বছরের সহায়তার চিন্তা ঘুরপাক খাওয়ার অর্থ কী হতে পারে? তারা কি ধরেই নিয়েছে যে, আগামী ১০ বছর বা তার বেশি সময় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশেই থাকবে, আর তারা (দাতাগোষ্ঠী) খোরপোষের ব্যবস্থা করবে? কিন্তু কেন তারা রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে দ্রুত পুনর্বাসিত করার পরিকল্পনার পরিবর্তে আগামী ১০ বছর বাংলাদেশের আশ্রয় শিবিরেই রাখার কথা ভাবছে? দাতারা কি প্রত্যাশা করে না যে, রোহিঙ্গারা তাদের নাগরিক এবং মানবাধিকার নিয়ে নিজ বাসভূমিতে স্বাধীনভাবে বসবাস করুক? নাকি দাতারা শুধু খোরপোষের মধ্যেই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করার কথা ভাবছে? পেছনের কারণ যাইহোক, দাতাদের এই অবস্থানটি রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশের জন্য খুবই হতাশার।
যেখানে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তর শুরু থেকেই বলে আসছে, রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র সমাধান তাদের স্বদেশে-স্বভূমিতে ফিরে যাওয়ার নিশ্চয়তার মধ্যেই নিহিত, সেখানে দাতাগোষ্ঠী মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে কার্যকর চাপ না দিয়ে শুধু অর্থ সহায়তার মধ্যেই তাদের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ রাখতে চাচ্ছে কেন?
রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার এবং নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দায় কি জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এড়াতে পারে? গত তিন বছরে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে জাতিসংঘ কী পদক্ষেপ নিয়েছে? কতজন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে পেরেছে? রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার-বাংলাদেশ চুক্তি বাস্তবায়নে কী উদ্যোগ নিয়েছে? বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোই বা কতটুকু দায়িত্ব পালন করেছে? কয়টি রাষ্ট্র রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে? প্রায় ১৫ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার চরমভাবে পদদলিত করার পরও কয়টি রাষ্ট্র মিয়ানমার সরকারের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে? তাদের হুঁশিয়ার করেছে? আর এত বড় বড় দেশ, এত বিপুল ক্ষমতা যাদের, তারা কেন রোহিঙ্গাদের দায়িত্ব নিচ্ছে না?
বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের জন্য যেভাবে মানবিক দায়িত্ব নিয়েছে, তার উদাহরণ বিশ্বে বিরল। ভাসানচরে স্থানান্তর নিয়ে কথা না বলে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার বরং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের রাখাইনে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির দিকে নজর দেওয়া উচিত।
লেখক লেখক ও কলামনিস্ট
chiros234@gmail.com