মঙ্গলবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৪৩ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

পর্যটনে নারী : বাংলাদেশ ও বিশ্বমানচিত্র

সৈয়দ আখতারুজ্জামান:
এক দশক আগে বাংলাদেশে ট্রাভেল এজেন্সির সংখ্যা ছিল পনের শ’। বর্তমানে সেই সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। তারপরেও নারীর অংশগ্রহণ কাগজে-কলমে সত্তর জনের নিচে, প্রকৃত সংখ্যা বিশের নিচে। বর্তমানে ট্যুর অপারেটরদের অ্যাসোসিয়েশন টোয়াবের সদস্য সংখ্যা ৬৭২ জন।

তার মধ্যে নারী সদস্য ২০/২৫ জন। এতদসত্ত্বেও এ কথা বলতেই হবে যে, সংখ্যাটি আগের চেয়ে বেড়েছে এবং এই বৃদ্ধির গতিও বাড়ছে। সুতরাং কোনো সন্দেহ নেই যে আমরা এগিয়ে চলছি। একই সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নারী কর্মজীবীর সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। যদিও সারা বিশে^র তুলনায় এটা যে কত কম সেটা তথ্য-উপাত্ত দেখলেই বোঝা যাবে। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্যি, বাংলাদেশে পর্যটন খাতের নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই। একযুগ ধরে পর্যটন খাতে সংশ্লিষ্ট থাকার কারণে যতটুকু নিজ চোখে দেখেছি, বিজ্ঞজনের মুখ থেকে শুনেছি আর বাজারে প্রাপ্ত হাতেগোনা কিছু বই পড়েছি সেটুকুই সম্বল।

পর্যটনে নারী প্রসঙ্গ তুলে ধরার আগে, পর্যটন প্রসঙ্গ আলাপ করে নেওয়া কিঞ্চিত জরুরি বলে মনে করি। পর্যটন খাতের বিস্তৃতি অনেক ব্যাপক।

আন্তর্জাতিকভাবে মোটাদাগে মোট ১২টি খাতকে পর্যটন খাত বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। ফলে এই ১২টি খাতে কর্মরত সংশ্লিষ্ট সব নারীকেই পর্যটন খাতে নিয়োজিত ধরে নিতে হবে। খাতগুলো হচ্ছে: ১. সব পর্যটন আবাসন (হোটেল, মোটেল, গেস্ট হাউজ, রিসোর্ট, হোম-স্টে ইত্যাদি সব), ২. খাদ্য ও পানীয় খাতের সব পণ্য সংক্রান্ত সব সেবা ৩. রেলওয়ে সংক্রান্ত সব পর্যটনসেবা ৪. সড়ক পরিবহন সংক্রান্ত সব পর্যটনসেবা ৫. নৌপরিবহন সংক্রান্ত সব পর্যটনসেবা ৬. বিমান পরিবহন সংক্রান্ত সব পর্যটনসেবা ৭. সব পর্যটন পরিবহন ও যন্ত্রপাতি ভাড়া সংক্রান্ত সব সেবা ৮. ট্রাভেল এজেন্সি, ট্যুর অপারেটর ও অন্যান্য রিজার্ভেশন সংক্রান্ত সব প্রতিষ্ঠান ৯. সাংস্কৃতিক সেবা ১০. ক্রীড়া ও বিনোদন সেবা ১১. দেশভিত্তিক অনান্য পর্যটন পণ্য (যা একেক দেশে একেক রকম হতে পারে) ১২. দেশভিত্তিক অনান্য পর্যটন সেবা। সুতরাং এসব খাত মিলেও বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে নারীর অংশগ্রহণ বর্তমানের তুলনায় আরও বৃদ্ধি পাওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রশ্ন হতে পারে, নারীর অংশগ্রহণ কেন বৃদ্ধি পাওয়া উচিত? আর যতটুকু বৃদ্ধি পেয়েছে সেটাই-বা কেন পেয়েছে? পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে মোট ছয়টি কারণ যা দৃশ্যপট পাল্টে দিচ্ছে এবং দেবে। এক. দেশের সামগ্রিক জনশক্তিতে নারী ও পুরুষের আনুপাতিক হারের ব্যবধান দিন দিন কমছে। কর্মজীবী নারীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। দুই. দেশে পর্যটকের সংখ্যা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বেড়েছে কর্মসংস্থানের সুযোগ। গত এক দশকে দেশে হোটেল, মোটেল, গেস্ট হাউজ ও রিসোর্টের সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ। ট্যুর অপারেটরের সংখ্যা বেড়েছে অন্তত প্রায় আড়াই গুণ। ট্রাভেল এজেন্সির সংখ্যা বেড়েছে তিন গুণ। সামগ্রিক চিত্রে সংখ্যায় কম হলেও এসব প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে নারী কর্মজীবীর সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে ট্রাভেল এজেন্সি ও ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠানে। তিন. পর্যটন ক্ষেত্রের দক্ষ জনশক্তিতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও প্রতিযোগিতায় ঠাঁই করে নিয়েছেন। দেশে বিদ্যমান পেশা খাতে সম্ভবত গার্মেন্টস শিল্পের পরেই শিক্ষকতা পেশা খাতে নারীদের অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি। এর পরপরই ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স, এনজিও এবং পর্যটন শিল্পে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের অংশগ্রহণ অনেক বেড়েছে। চার. পর্যটন একটি সেবানির্ভর শিল্প খাত হওয়ায় সেবা প্রদানে নারীর সক্ষমতা অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষের চেয়ে বেশি। বিশেষ করে যেসব পদে সরাসরি ক্রেতাদের সঙ্গে সংযোগ করতে হয়। যেমন ফ্রন্ট ডেস্ক, কাস্টমার সার্ভিস, বুকিং ও রিজার্ভেশন ইত্যাদি বিভাগে নারীর অংশগ্রহণ এখন বেশি। তাছাড়া পর্যটন খাতে নারী উদ্যোক্তাদের সুযোগ অন্যান্য সেক্টরের তুলনায় বেশি। পঁাঁচ. পুরুষের তুলনায় নারী কর্মজীবীরা একই কর্মস্থলে বেশি দিন কাজ করেন। ফলে পর্যটনে দক্ষ নারী কর্মজীবীর চাহিদাও বেশি। আমাদের দেশের পর্যটন খাতের একটি বড় সমস্যা দক্ষ জনশক্তির অভাব। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে অদক্ষ জনশক্তি কিছু দিন কাজ করে দক্ষ হওয়ার পর নিজেই উদ্যোক্তা হয়ে ব্যবসা শুরু করার প্রবণতা লক্ষণীয়। ফলে প্রতিষ্ঠানের জনশক্তির অভাব থেকেই যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই সমস্যায় নারী কর্মজীবীরা কম ঝুঁকিপূর্ণ। ছয়. সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের কারণেও পর্যটনে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। এক সময় পুরুষ সাহচর্য ছাড়া নারীদের ভ্রমণ বলতে গেলে ছিলই না। কিন্তু বর্তমানে সে দৃশ্য পাল্টাতে শুরু করেছে। কোনো পুরুষ ছাড়াই অনেক নারী একসঙ্গে মিলে ভ্রমণ করছেন, নারী-পুরুষ মিলেও গ্রুপ ট্যুর করছেন। সামাজিক মাধ্যমগুলোর ভূমিকায়, বিশেষত তরুণদের মধ্যে এই সংখ্যা এখন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে পর্যটন খাতে নারীদের অংশগ্রহণে সামাজিক বাধা আগের চেয়ে কমতে শুরু করেছে।

এবার দেখা যাক বিশ^মানচিত্রের পরিস্থিতি। সারা বিশ্বে পর্যটনের শ্রমশক্তির কত অংশ নারী তার প্রকৃত পরিসংখ্যান না পাওয়া গেলেও পর্যটনে নারীর অংশগ্রহণ যে পুরুষের চেয়ে বেশি তাতে কোনো সংশয় নেই জাতিসংঘের বিশ^ পর্যটন সংস্থার। কিন্তু আইএলও’র মতে, এই সংখ্যা পুরুষের চেয়ে বেশি না হলেও অন্তত সমান সমান যে হবে সেটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। বর্তমানে সারা বিশে^ প্রায় ৩শ মিলিয়ন মানুষ পর্যটন পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে। ইউরোপের পর্যটন খাতে ৫৮ শতাংশই নারী কর্মজীবী। যার মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগই পর্যটন আবাসন (হোটেল, গেস্ট হাউজ, রিসোর্ট ইত্যাদি)-এ কাজ করছেন। ইতালিতে প্রতি তিন জন পর্যটন ব্যবসায়ীর মধ্যে একজন নারী। পানামা ও নিকারাগুয়ার ৭০ শতাংশ পর্যটন ব্যবসায়ী নারী। বুলগেরিয়ার পর্যটন খাতের ব্যবস্থাপক ও প্রশাসকদের ৭১ শতাংশই নারী যেটা তাদের অন্যান্য সেক্টরে মাত্র ২৯ শতাংশ। পরিসংখ্যান মতে, পর্যটন খাতে নারীর অংশগ্রহণে মধ্যপ্রাচ্য, তুরস্ক আর ভারতের আরও এগিয়ে আসার সুযোগ রয়েছে।

বিশ্ব পর্যটনে নারীর অংশগ্রহণ এত প্রবল থাকার পরেও বিশ্ব ইকোনমিক ফোরাম দুশ্চিন্তা প্রকাশ করে বলেছে পর্যটনসংশ্লিষ্ট এই নারীরা পুরুষের তুলনায় অন্তত ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কম বেতন পান। যার একটা সুরাহা হওয়া প্রয়োজন। এই বিশাল পর্যটন খাতে যত নারী কাজ করেন তাদের মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই কাজ করেন হোটেল, ক্যাটারিং আর ট্রাভেল এজেন্সিতে। যাদের অন্তত অর্ধেকের বয়স ২৫ বছরের নিচে। এরা অধিকাংশই মানসম্পন্ন কর্মশক্তি নন। কারণ তারা হয়তো খ-কালীন নয়তো অস্থায়ীভাবে কাজ করেন, প্রকৃত পেশাজীবী হিসেবে কাজ করেন না। জাতিসংঘসহ বিশে^র নানা সংস্থা পর্যটন খাতে নারীদের বেতন, নিরাপত্তা ও অন্য সমস্যাগুলো দূর করে তাদের মানসম্পন্ন অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে। ফলে আশা করা যায় পরিস্থিতি আরও দ্রুতগতিতে টেকসই সমাধানের পথ খুঁজে পাবে। আর আমাদের বাংলাদেশের বেলায় কী হবে? পর্যটন খাতে নারীর অংশগ্রহণের এই দুরবস্থা কি আসলেই কাটবে? আশা করি আমাদের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডসহ সব পর্যটনসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও পেশাজীবীরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের অবস্থান থেকে এ বিষয়ে ভূমিকা রাখতে এগিয়ে আসবেন।

লেখক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিয়ন্ড অ্যাডভেঞ্চার অ্যান্ড ট্যুরিজম

akhter.bst@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION