মুফতি আবু দারদা:

দুনিয়া মানুষের পরীক্ষাকেন্দ্র। আল্লাহ তাকে দুভাবে পরীক্ষা করেন। বিপদ দিয়ে এবং নেয়ামত দিয়ে। নেয়ামতের পরীক্ষা বিপদের পরীক্ষার চেয়ে কঠিন। বিপদের সময় মানুষ আল্লাহর স্মরণ করে। তার সাহায্য প্রার্থনা করে। প্রাচুর্যের সরোবরে ডুব দিয়ে খুব কম লোকই আল্লাহর কথা মনে রাখে এবং তার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়। তাই নেয়ামতের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

পরীক্ষার এই দুটি ধরনের কথা উল্লেখ করে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি তাদের ভালো ও মন্দ অবস্থা দ্বারা পরীক্ষা করি, যাতে তারা ফিরে আসে। (সুরা আরাফ, আয়াত : ১৬৮) আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে জারির তবারি বলেন, ‘আয়াতে ভালো অবস্থা দ্বারা উদ্দেশ্য সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম-আয়েশ ও সচ্ছলতা। আর মন্দ অবস্থা দ্বারা উদ্দেশ্য দুঃখ-কষ্ট, বালা-মসিবত ও অভাব-অনটন।’ (তাফসিরে তবারি, খ- ১৩, পৃষ্ঠা ২০৮-২০৯)

আল্লাহর অসংখ্য নেয়ামতের ভেতর আমরা ডুবে আছি। পৃথিবীর যত প্রাচুর্য-ঐশ^র্য ও সৌন্দর্য সবই মানুষের জন্য আল্লাহর একান্ত অনুগ্রহ। এসব অনুগ্রহ ভোগ করে মানুষ কি আল্লাহর আনুগত্য করে, না তাকে ভুলে যায় সেটা পরীক্ষা করার জন্য তা সৃজন করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ভূ-পৃষ্ঠে যা কিছু আছে আমি তার জন্য তা শোভাকর বানিয়েছি কে ভালো কাজ করে তা পরীক্ষা করার জন্য। (সুরা কাহফ, আয়াত : ৭)

মানবদেহের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আল্লাহর বিশেষ দান। তাই এগুলোর সদ্ব্যবহার করা তার দায়িত্ব। আল্লাহর অবাধ্যতায় যেন এসবের ব্যবহার না হয়, সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। আল্লাহ তার নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আমি কি তাকে দিইনি দুটি চোখ? এবং একটি জিহ্বা ও দুটি ঠোঁট। (সুরা বালাদ, আয়াত : ৮-৯)

মানুষের বিবেক-বুদ্ধি, অর্থ-সম্মান, সন্তানসন্ততি আল্লাহর নেয়ামত। এসবের মোহে আল্লাহকে ভুলে যাওয়া অকৃজ্ঞতা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘জেনে রেখো, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তানসন্ততি তোমাদের জন্য পরীক্ষা। আর আল্লাহরই কাছে রয়েছে মহা পুরস্কার। (সুরা আনফাল, আয়াত : ২৮)

বান্দা যখন আল্লাহর মুখোমুখি হবেন, তখন আল্লাহ প্রদত্ত প্রাচুর্যের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর সেদিন তোমাদের নেয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।’ (সুরা তাকাসুর, আয়াত : ৮) সেদিন আল্লাহতায়ালা বলবেন, ‘হে অমুক, আমি কি তোমাকে সম্মানিত করিনি? আমি কি তোমাকে নেতা বানাইনি? আমি কি তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করিনি? আমি কি উট-ঘোড়া তোমার বশীভূত করিনি? আমি কি তোমাকে নেতৃত্বের সুযোগ দিইনি? যুদ্ধলব্ধ সম্পদের এক-চতুর্থাংশ গ্রহণ করে প্রাচুর্যের মধ্যে জীবনযাপন করার সুযোগ দিইনি? (সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৯৬৮)

দেহের প্রতিটি অঙ্গের জন্য সেদিন আলাদাভাবে জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই কান, চোখ ও অন্তর সবকটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ৩৬)

যার প্রাচুর্য যত বেশি, তার দায়িত্ব তত বেশি। তাকে জবাবও দিতে হবে বেশি। তাই অর্থ-বিত্তে উল্লসিত হওয়ার সুযোগ নেই। আলি (রা.) বলেন, ‘হে আদমসন্তান, ধন-ঐশ^র্যে খুশি হয়ো না। দারিদ্র্যে হতাশ হয়ো না। বিপদ-আপদে পেরেশান হয়ো না। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে উন্মত্ত হয়ো না। স্বর্ণ কিন্তু আগুন দিয়েই পরখ করা হয়। (রিসালাতুল মুসতারশিদিন, পৃষ্ঠা ৮৫)

অপ্রাপ্তির পরীক্ষার চেয়ে প্রাপ্তির পরীক্ষা কঠিন। আরাম-আয়েশ ভুলিয়ে দেয় পালনকর্তাকে। নেয়ামতের সাগরে ডুব দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা বেশ কঠিন। এ কথারই আশঙ্কা প্রকাশ করে রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের দারিদ্র্য নিয়ে আমি আশঙ্কা করি না। বরং আমার আশঙ্কা হয়, তোমরা দুনিয়ার প্রাচুর্যের অধিকারী হবে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীরা হয়েছিল আর তোমরা প্রতিযোগিতা শুরু করবে যেমন তারা করেছিল, তখন দুনিয়া তোমাদের ধ্বংস করবে যেমন তাদের করেছিল।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩১৫৮) এ কথারই সত্যতা নিশ্চিত করে ওমর (রা.) বলেন, ‘বিপদ দিয়ে আমাদের পরীক্ষা করা হয়, আমরা ধৈর্য ধারণ করি। প্রাচুর্য দিয়ে আমাদের পরীক্ষা করা হয়, আমরা অধৈর্য হয়ে পড়ি।’ (বাসাইরু জাবিত তামইজ ফি লাতাইফিল কিতাবিল আজিজ, খ- ২, পৃষ্ঠা ২৭৪-২৭৫)

মুমিন কখনো পরকাল সম্পর্কে উদাসীন হয়ে ভোগ-বিলাসে মত্ত হতে পারে না। মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.)-কে ইয়েমেনের গভর্নর নিযুক্ত করে প্রেরণের সময় রাসুল (সা.) বলেন, ‘খবরদার! বিলাসিতার ধারেকাছেও যাবে না। আল্লাহর বান্দারা কখনো বিলাসী হতে পারে না।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২২১০৫)

দুনিয়ার প্রাচুর্যে মত্ত হয়ে আল্লাহকে অস্বীকার করে বসা কঠিন অপরাধ। ক্ষণিকের ক্ষমতা হাতের মুঠোয় পেয়ে মৃত্যু ও পুনরুত্থানের অস্বীকৃতি জ্ঞাপন কুফরি। আল্লাহ এসব অপরাধীকে কঠিন সাজা দেবেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ইতিপূর্বে তারা ছিল আরাম-আয়েশের ভেতর। অতি বড় পাপের ওপর তারা অনড় থাকত এবং বলত, আমরা যখন মরে যাব এবং মাটি ও অস্থিতে পরিণত হবে, তখনো কি আমাদের পুনরায় জীবিত করা হবে? এবং আমাদের বাপ-দাদাদেরও, যারা পূর্বে গত হয়ে গেছে?’ (সুরা ওয়াকিয়া, আয়াত : ৪৫-৪৮)

মুমিন বিপদেও আল্লাহর আনুগত্য করে, প্রাচুর্যেও আল্লাহর আনুগত্য করে। কোনো অবস্থাতেই তার পথ থেকে বিচ্যুত হয় না। তাই তার জন্য বিপদও যেমন কল্যাণকর, নেয়ামতও কল্যাণকর। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘মুমিনের ব্যাপারটি কী চমৎকার! সবকিছুই তার জন্য কল্যাণকর। এটি মুমিনেরই বৈশিষ্ট্য। যদি সে সুখ-সচ্ছলতা পায় তাহলে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হয়, ফলে তা তার জন্য কল্যাণকর। আর যদি দুঃখ-অনটনের শিকার হয় তাহলে সে ধৈর্য ধারণ করে, ফলে তাও তার জন্য কল্যাণকর।’ (সহীহ মুসলিম, হাদিস : ২৯৯৯)

পরকালের অফুরন্ত নেয়ামতের তুলনায় দুনিয়ার নেয়ামত নস্যি! তাই ক্ষণিকের জীবনের মোহে পরকাল ভুলে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বরং আল্লাহর দেওয়া প্রাচুর্য-ঐশ^র্য তারই নির্দেশিত পথে ব্যবহার করে তার সন্তুষ্টি অর্জন করা প্রতিটি মুমিনের কর্তব্য।

ভয়েস/আআ