বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:৫৯ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

লকডাউনের এপারে কারা আর ওপারে কারা?

সীমিত পরিসরে বলা হলেও কিছুই সীমিত থাকছে না। বগুড়া, খুলনাসহ দেশের কয়েকটি জেলা শহরের নিউমার্কেট অতিরিক্ত ভিড়ের জন্য আবার বন্ধ করে দিতে হয়েছে।

ফারুক ওয়াসিফ

সীমিত পরিসরে বলা হলেও কিছুই সীমিত থাকছে না। বগুড়া, খুলনাসহ দেশের কয়েকটি জেলা শহরের নিউমার্কেট অতিরিক্ত ভিড়ের জন্য আবার বন্ধ করে দিতে হয়েছে।
সীমিত পরিসরে বলা হলেও কিছুই সীমিত থাকছে না। বগুড়া, খুলনাসহ দেশের কয়েকটি জেলা শহরের নিউমার্কেট অতিরিক্ত ভিড়ের জন্য আবার বন্ধ করে দিতে হয়েছে।

লকডাউন বিষয়ে একবার ফেসবুকের ওয়ালে তাকাই, একবার তাকাই বাইরের রাস্তার দিকে। দুই বিপরীত দৃশ্য। যা হয় আরকি, মধ্য ও উচ্চ মধ্যবিত্তে ভরা আমার ফ্রেন্ডলিস্টের একজনও পেলাম না, যিনি করোনা উপদ্রুত দেশে লকডাউন শিথিল করার পক্ষে। আবার শ্রমজীবী ও ক্রেতাদের বাইরে থাকা নিজেই তো লকডাউন মানতে না পারার বিবৃতি। যাঁদের মাসকাবারি আয় আছে তাঁরা লকডাউন আরও কঠোর করতে চান। যাঁদের সেটা নেই, তাঁরা নীরবে হাত-পা সম্বল করে কাজের বা ত্রাণের খোঁজে বাইরে যাচ্ছেন। ব্যবসায়ীরাও চাইছেন বাজার চালু হয়ে যাক। তাঁদের হিসাবটা ভিন্ন, বাজার চালু হলেও অনেকে কর্মচারী দিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারবেন, সে ক্ষেত্রেও বেশি ঝুঁকি সেলসম্যান ও মাঠকর্মীদের—মালিকের ততটা না।

লকডাউনে সমাজ নেই কিন্তু বাজার আছে। টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ঘটনার পরে জর্জ বুশ জুনিয়র মার্কিন নাগরিকদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাবার জন্য বলেছিলেন ‘গো শপিং’। যেন শপিং-ই হলো জীবনের লক্ষ্য, সৌন্দর্য ও স্বাভাবিকতা। দুই মাস সাধারণ ছুটি নামক আংশিক লকডাউন খোলায় বাংলাদেশের প্রথম পদক্ষেপও সেটাই ছিল, ‘সীমিত পরিসরে’ দোকানপাট খোলা।’

সরকারও মনে হয় চায় বাজার চালু হোক। সীমিত পরিসরে বলা হলেও কিছুই সীমিত থাকছে না। বগুড়া, খুলনাসহ দেশের কয়েকটি জেলা শহরের নিউমার্কেট অতিরিক্ত ভিড়ের জন্য আবার বন্ধ করে দিতে হয়েছে। ঢাকায় আড়ংয়ের দোকানো ক্রেতাদের ভীড় দেখা গেছে। ফল হয়েছে মারাত্মক। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা ধুম করে বেড়ে গেছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ গণহারে ছড়াতে যতটা সময় দরকার, ততটা সময়ই তো অনেকে বাইরে থাকছেন। আমাদের রাজস্ব আয় কম, সবাই তা দেয়ও না। ভ্যাটই হলো সরকারের সরাসরি ‘ইনকাম’। কেনাকাটা না চললে, বাজারকেন্দ্রিক অর্থনীতি চলতে পারে না, ভ্যাটও আদায় হয় না, সরকারের তহবিলে টাকাও জমে না।

অবস্থা দেখে মনে হয়, দারিদ্র্যসীমার নিচে পড়ে যাওয়া মানুষের কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়াকে মার্কেট খোলার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। মানুষ বেরিয়ে পড়ছে, কারণ করোনার সময়ে রাষ্ট্র ভালোভাবে পাশে থাকতে পারেনি। জনগণের দোহাই দিয়ে লকডাউন শিথিল করার ইঙ্গিত স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সাম্প্রতিক একটি কথায়ও আছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ‘মানুষের জীবিকার তাগিদে সরকারকেও সীমিত পরিসরে কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা খুলে দিতে হয়েছে। এসব কারণে আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা বাড়ছে। হয়তো আরও কিছু বাড়তেও পারে। তবে এই বৃদ্ধি খুব বেশি ক্ষতিকর কিছু হবে না।’

কত বেশি মৃত্যুকে, স্বাস্থ্যব্যবস্থার কতটা ভেঙে পড়াকে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে ‘ক্ষতি’ বলে মনে হবে?

একটা ভিডিও দেখেছিলাম অনলাইনে। ইংরেজিভাষী এক যুবক মত দিচ্ছিলেন, কিছু ক্ষতি হলেও অর্থনীতির স্বার্থে লকডাউন তুলে নেওয়া দরকার। কিছু ক্ষতি বলতে তিনি কতজনের মৃত্যু মেনে নিতে প্রস্তুত? জানতে চাওয়া হলো। বললেন, এই ধরেন ৭০-৮০ জন। তখন ৭০-৮০ জনের একটা জমায়েত তাঁকে দেখানো হলো। আস্ত একটা ভিড়। ওমা! খেয়াল করে দেখেন, ওই ভিড়ের মধ্যে তাঁর পরিবারও আছে, তাঁর শিশুটিও আছে, আছে তাঁর শিক্ষক, পরিচিত কয়েকজন এবং কয়েক বন্ধুও। সেটা দেখে তিনি অনুতপ্ত হলেন, মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন।

মৃতের সংখ্যা কিছু নিষ্প্রাণ-শুষ্ক অক্ষর মাত্র। কিন্তু যার যায় তার জন্য সেটা এক আস্ত জীবন। সেই জীবন তার আপনজনদের জন্যও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক লাভালাভের জায়গা থেকে মানুষের জীবনকে ‘খরচযোগ্য’ বিনিয়োগ ভাবা শুধু নিষ্ঠুরতাই না, তা আরেকটা সত্যের খবর দেয়। যে অর্থনীতি চালানোর জন্য বিপুল মানুষকে চরম কষ্ট পেয়ে মরে যেতে হয়, সেই অর্থনীতি চালু থাকলেও কি মানুষের খবর রাখে? যদি রাখত, তাহলে তো সেই অর্থনীতি সবার আগে মানুষকে বাঁচানোর জন্য পর্যাপ্ত চিকিৎসা ও খাদ্যসহায়তার ব্যবস্থা করত।
সরকারের আয়ের জন্য দেশটাকে গণসংক্রমণের মুখে ফেলে দেওয়া নিয়ে তাই প্রশ্ন উঠেছে।

লকডাউন হয়ে গেছে আমাদের দেশের মে দিবসের ছুটির মতো, অশ্রমিকেরা এই দিনের ছুটি পুরো ভোগ করেন, কিন্তু মেহনতি শ্রমিকদের সবার সেই উপায় থাকে না। সেটাও তাঁদের কাজের দিন। শ্রমিকদের জন্য লকডাউন মানা না-মানার বিষয় না, ত্রাণ পেলে তাঁরা এটা মেনে খুশি থাকবেন, না পেলে ঘরের বাইরে বের হবেনই। লকডাউন মানানোর এই দায়টা তাই সরকারের। এবং সেই সব মানুষেরও, যাঁদের জন্য লকডাউন বাস্তব ও সহনীয় ব্যবস্থা।

তাঁরা যদি এক হয়ে জোরালোভাবে অনাহারের ঝুঁকিতে পড়া সবার জন্য তিন মাসের ত্রাণের ব্যবস্থা করার জন্য সরকারকে বলতে পারতেন, সেটা আদায় করে নিতে পারতেন, তাহলে লকডাউন নিয়ে দুই শ্রেণির চালচলন দুরকম হতো না।

ঘরে থাকার জরুরত বেশির ভাগ মানুষই বোঝেন। কিন্তু ঘরে থাকার মানে সবার কাছে এক না। নগরে ঘর মানে আরাম-আয়েশের জায়গা না বেশির ভাগ মানুষের কাছে। বদ্ধ পরিবেশে এক ঘরে একটি পরিবারের ৪-৬ জনের থাকাথাকি তেমন উপভোগের বিষয় লাগার কথা না। ঘরে যখন খাবারের অভাব, তখন সেই ঘর থেকে শান্তিও ঘুলঘুলি দিয়ে পালায়।

মানুষ যে বেরিয়ে পড়ছে এর দায় মানুষের নয়। মানুষ কোনো ভরসা পাচ্ছে না। অনবরত সিদ্ধান্ত বদল, তথ্যগোপন, চিকিৎসায় ভজঘট এবং ভবিষ্যতের সুরক্ষার কোনো পরিকল্পনা না দেখতে পেলে তো নিয়তির হাতে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। যদি ব্যাপক রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড দেখা যেত মানুষকে খাওয়ানোর ও বাঁচানোর, তাহলে সাধারণ মানুষও দায়িত্ব বোধ করত, সরকারের পাশে থেকে নিজের দায়িত্বটুকুও পালন করত। কিন্তু কথায় বলে, আগার হাল যেদিকে যায়, পিছের হালও সেদিকে যায়।

সীমিত পরিসরে লকডাউন ভাঙার অজুহাত যদি হয় বহুল কথিত হার্ড ইমিউনিটি বা দলবদ্ধ প্রতিরোধক্ষমতা জন্মানোর জন্য করোনা ভাইরাসের কাছে দেহটা এগিয়ে দেওয়া, তাহলে একে গণমৃত্যুর আয়োজন ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।

সরকার যা চাইবে তা-ই হবে। আধুনিক সময়ে রাষ্ট্র্ই জীবন-মৃত্যুর মূল ম্যানেজার। অবহেলা বা অব্যবস্থাপনার দায়টাও তাদের।

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক।
faruk.wasif@prothomalo.com। সূত্র: প্রথম  আলো অনলাইন।

ভয়েস/জেইউ।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION