মঙ্গলবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:০৪ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

কোভিড-১৯ ও শ্রমবাজারের চ্যালেঞ্জ

ড. সায়মা হক বিদিশা:

করোনা ভাইরাসের কারণে বর্তমানে লকডাউনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা। পরিস্থিতি বিবেচনায় লকডাউনের যৌক্তিকতা রয়েছে এবং সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জীবন বাঁচানোর বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করা প্রয়োজন। তবে সন্দেহ নেই যে, এই লকডাউনের ফলে আমাদের শ্রমবাজার ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে-বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের আয় এবং কর্মসংস্থানের উপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২০ সালের লকডাউন/সাধারণ ছুটির কারণে মানুষের আয় ও কর্মসংস্থান ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং সে পরিস্থিতিতে বিভিন্ন উপায়ে যেমন ধার করে কিংবা সঞ্চয় ভাঙ্গিয়ে মানুষ টিকে থাকার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে করোনার এই দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলা করাটা, বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষের জন্য অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। মনে রাখা দরকার যে, বেকারত্ব, তরুণ নিইইট [NEET (Not in Employment Education or Training)] (যারা শিক্ষা, কর্মসংস্থান কিংবা প্রশিক্ষণমূলক কাজ- কোনকিছুতেই নিয়োজিত নেই), শ্রমবাজারের চাহিদা আর জোগানের মধ্যকার সমন্বয়হীনতা, কাজের গুণগত মান ও শোভন কাজের অভাব ইত্যাদি চ্যালেঞ্জগুলো কোভিড সংক্রমণের আগেই আমাদের শ্রমবাজারে বিদ্যমান ছিল, কোভিড-১৯ এসব চ্যালেঞ্জগুলোকে আরও ঘনীভূত করেছে।

কোভিডের সাম্প্রতিক ঢেউ ও লকডাউনের প্রেক্ষিতে বর্তমানে সবচাইতে জরুরি হচ্ছে কাজ হারানো ও আয়/মুনাফার ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্তদেরকে চিহ্নিত করা। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম এর জানুয়ারি-ফেব্রয়ারি ২০২১ এ করা জরিপে দেখা গেছে যে, করোনার প্রথম ঢেউয়ে (মার্চ- ডিসেম্বর ২০২০ সময়ে), অর্থনীতির কিছু কিছু খাতের সাথে সংশ্লিষ্টরা অধিক হারে আয় হারিয়েছেন/মুনাফা বা উৎপাদনের সংকোচনের সম্মুখীন হয়েছেন, যেমন পরিবহন, নির্মাণ, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্টরা।তাই সাম্প্রতিক লকডাউনের ক্ষেত্রে এসব খাতের সাথে সংশ্লিষ্টদেরকে অতি দ্রুত সরকারের সহায়তা কার্যক্রমের মধ্যে আনা জরুরি।

আসন্ন বাজেটেও এ খাতগুলোকে ঘিরে বরাদ্দ ও নীতি সহায়তা প্রয়োজন। এছাড়া, ক্ষুদ্র ও মধ্যম আকারের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য গতবছরের প্রণোদনার ক্ষেত্রে ঋণের সময়সীমা বৃদ্ধিসহ নতুন প্রণোদনা প্যাকেজের প্রয়োজন রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে ক্ষুদ্র, অতি ক্ষুদ্র ও কটেজের জন্য দরকার ব্যাংকিং চ্যানেলের পরিবর্তে বিকল্প উপায়ে যেমন এনজিও, এমএফআই এর মাধ্যমে পৃথক ব্যবস্থায় স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা।

তৃণমূল পর্যায়ের কাজ হারানো মানুষ, পুরনো দরিদ্র, ও মহামারির কারণে নতুন দরিদ্রদেরকে খাত ভিত্তিক এবং এলাকাভিত্তিক পর্যায়ের প্রতিনিধি, এনজিওদের সাহায্যে চিহ্নিত করে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের অধীনে আনার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে সাম্প্রতিক সময়ের লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্তদেরকে প্রাথমিকভাবে জরুরি ভিত্তিতে খাদ্য সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি, স্বেচ্ছাসেবক, ব্যক্তিখাত ও এনজিওদের সহায়তায় একটি সমন্বিত উদ্যোগ গড়ে তোলা যেতে পারে।

শুধু আপত্কালীন জরুরি সহায়তা নয়, কাজ হারানো ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্য দ্রুতই বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এ প্রেক্ষিতে গ্রাম ছাড়াও শহর পর্যায়ে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতায় নামমাত্র সুদ, এমনকি এককালীন সহায়তার মাধ্যমে কর্মসংস্থান তৈরি কিংবা সরকারের স্বল্প আকারের নিজস্ব কর্ম সৃজন প্রকল্পের আওতা বাড়িয়ে কাজের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে।নিম্ন আয়ের কাজ হারানো মানুষদের (আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক উভয় খাতে) জন্য তিন মাসের জন্য বেকার ভাতার মতো বিশেষ ভাতা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে যা দারিদ্র দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সরকারি কর্মকর্তাদের মাসিক বেতনে ‘কোভিড কর’ এর মতো করারোপের মাধ্যমে কিংবা উৎসব ভাতা কাটছাঁট করার মাধ্যমে এ পরিপ্রেক্ষিতে অর্থায়নের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।

করোনা মহামারির কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক মন্দার কারণে পোশাক খাতের মতো শ্রমঘন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যার ফলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়টি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। সরকার গতবছর এই খাতের জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছে এবং সাম্প্রতিক লকডাউনের সময় এ খাতকে আওতার বাইরে রাখলেও নতুন করে ছাঁটাই কিংবা বেতন কাটছাঁটের আশঙ্কা রয়েছে। তাই বৃহৎ আকারে কর্মসংস্থান তৈরির দিকে নজর দিতে হবে এবং এ প্রেক্ষিতে ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিনিয়োগবান্ধব প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও কর কাঠামো, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা হ্রাস, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও ঋণের সুদের হারের বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিবেচনা করতে হবে।

আসন্ন বাজেটে এক্ষেত্রে নীতি সহায়তা কাম্য। তবে মনে রাখতে হবে যে, একদিকে সার্বিকভাবে আয় হ্রাস অপরদিকে সংক্রমণের আশঙ্কার কারণে সৃষ্ট চাহিদার সংকট সার্বিক উৎপাদন ব্যবস্থা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির অন্তরায়। তাই টিকাদান কর্মসূচির সম্প্রসারণ ও স্বাস্থ্যবিধি মানার মাধ্যমে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে চাহিদার সংকট কাটিয়ে শ্রমবাজারকে পুনরুজ্জীবিত করা সহজ হবে না।

ড. সায়মা হক বিদিশা , অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION