মঙ্গলবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ০১:৫৭ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

বউ গেলে সরকার বউ দেবে না বলে…

সারফুদ্দিন আহমেদ

‘আমার দেশের বাড়ি কুড়িগ্রামে। আমার যাইতেই লাগব দুই দিন। আমি আসব কেমনে? আবার ডিউটি করব কেমনে? তার উপর নতুন বিয়া করছি। বউ চইলা গেলে বউ পামু কই? বউ কি সরকারে দিব নাকি?’ এই কথা এক যুবকের। ঢাকা থেকে দেশের বাড়ি ফেরার সময় তিনি এই কথা বলছিলেন। নববিবাহিত ওই যুবকের ঈদে বাড়ি ফেরাবিষয়ক এই অতিজরুরি দাম্পত্য জীবনঘনিষ্ঠ জরুরতের জবানি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে।
সামনে যেহেতু ঈদ, সেহেতু পেছনে যতই করোনাভাইরাস ধাওয়া করুক, কিছু আসে-যায় না। কুড়িগ্রামের যুবকের মতো কেউ নারীর টানে, কেউ নাড়ির টানে, কেউ বাড়ির টানে ছুটছে। রাস্তায় আন্তজেলার বাস নেই তো কী? মাইক্রোবাস, ইজিবাইক, অটোরিকশা, আলমসাধু আছে। তা–ও না থাকলে নিদেনপক্ষে পা আছে।
যমুনা সেতুর সুবাদে উত্তরবঙ্গে যেতে এখন আর ‘গাঙ ঝাঁপাতে’ হয় না। এ কারণে নামীদামি পরিবহন না পেলেও বাড়িগামীরা ‘আল্লার নামে চলিলাম’ লেখা ইটবাহী ট্রাকে চড়ে চলে যাচ্ছে।

সামান্য সমস্যা হচ্ছে দক্ষিণবঙ্গযাত্রায়। দক্ষিণে যেতে বিগতযৌবনা পদ্মা পার হতে হয়। অথচ লঞ্চ বন্ধ। শরীরে কুলোলে ঝাঁপ মেরেই অনেকে গাঙ পার হতো। পদ্মাসেতুর কাঠামো দাঁড়ালেও সেই কাঠামো ধরে ঝুলে ঝুলে যাওয়ার কায়দা এখনো রপ্ত না করতে পারায় আপাতত যাত্রীদের পরপার কিংবা পারাপারের একমাত্র ভরসা ফেরি। খাঁচায় ভরে যেভাবে পোলট্রি মুরগি ট্রাকে করে আনা-নেওয়া হয়, অনেকটা সেই আদলে সবাই গাদাগাদি করে ফেরিতে ফিরছে। একেকটি ফেরিতে হাজারের বেশি যাত্রী উঠছে।

ফেরিতে তাঁদের জায়গা দখলমুখর পাড়াপাড়ি, মারামারি, ঠাসাঠাসি ও ঘষাঘষিতে করোনার বরিশাল ভ্যারিয়েন্টের সঙ্গে খুলনা ভ্যারিয়েন্টের; ফরিদপুর ভ্যারিয়েন্টের সঙ্গে পিরোজপুর ভ্যারিয়েন্টের করোনাভাইরাসের গাপচা-গাপচি, গুঁতোগুঁতি হচ্ছে। ঘাটে ভেড়ার পর ফেরি যখন পন্টুনে বাঁধা হচ্ছে, তখন সেই ধাতব রশি দুই হাত ও দুই পা দিয়ে কেঁচকি মেরে ধরে চার হাত-পায়ে বেয়ে বেয়ে যাত্রীরা মাদারির প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বানরের মতো ঘাটে এসে নামছে। সেই দড়াবাজিকরদের কসরতের ভিডিওচিত্রও যথেষ্ট ফেসবুকপ্রিয়তা পেয়েছে। এসব ভিডিওচিত্রে গাট্টি–বোঁচকা নিয়ে বাড়ির পথে মরিয়া হয়ে ছুটে চলা মানুষের মধ্যে করোনা সংক্রমণসংক্রান্ত ভীতি কিংবা স্বাস্থ্যনীতি মানার প্রতি কোনো প্রীতি দেখা যাচ্ছে না।
ছুটির সঙ্গে ছোটাছুটির সম্পর্ক যেহেতু অতি নিবিড়, হয়তো সেহেতু মরার ভয়ডর ঝেড়ে ফেলে মরিয়া হয়ে মানুষের এই মারাত্মক স্বদেশযাত্রা। যেন তারা বুঝে গেছে, ঈদের ছুটিতে গ্রামে বেড়াতে গেলে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়বে, তখন করোনা কাবু করতে পারবে না।

ছুটিতে যে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ে, তা কিন্তু কথার কথা না। লন্ডনের কয়েকজন গবেষক সম্প্রতি এটি প্রমাণও করেছেন। এই গবেষণা অবশ্য তাঁরা মানুষের ওপর চালাননি। ইঁদুরের ওপর চালিয়েছেন। তাঁরা কয়েকটি ইঁদুরকে নিত্যকার ছোট খাঁচা থেকে বের করে দুই সপ্তাহের জন্য এমন খাঁচায় রেখেছেন, যা আয়তনে বিশাল, বর্ণময় এবং যার মধ্যে অনেকগুলো খেলনা, দোলনা, দৌড়ানোর চমৎকার চাকা রয়েছে। অর্থাৎ, একজন মানুষকে ঈদের ছুটি কাটানোর জন্য দেশের বাড়িতে পাঠালে যা হয়, সেটি তারই সমতুল্য বন্দোবস্ত। দুই সপ্তাহ পরে দেখা গেছে, ইঁদুরগুলোকে কোনো ওষুধ দেওয়া হয়নি, অথচ তাদের রোগ-প্রতিরোধক্ষমতা প্রবলভাবে বেড়েছে।
এই গবেষণার কথা আমরা সবাই না জানলেও এটুকু জানি, ছুটিতে গেলেই অধিকাংশের শরীর ভালো থাকে। হাঁটুর ব্যথার নালিশ কমে আসে, হাঁপানিও তেমন থাবা বসায় না। এ কারণে করোনার ভয় দেখিয়ে আমাদের ঘরে আটকে রাখা কঠিন হয়। বিশেষ করে বউ চলে গেলে সরকারি তরফে বউ ফেরত দেওয়ার নিশ্চয়তা না পাওয়া নববিবাহিত যুবকের মতো দাম্পত্য-দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের অভিযাত্রা রুখে দেওয়ার চেষ্টা করা নিতান্ত অমানবিক।

বোঝা যাচ্ছে, বাড়িমুখী ছুটিখোর জনতা বিলাতি সাহেবদের ইঁদুরের অবকাশসংক্রান্ত গবেষণাটি শিরোধার্য করেছে। ঈদের ছুটি ভোগ এবং উপভোগের মধ্য দিয়ে তারা রোগ প্রতিরোধক্ষমতা এতটাই অর্জন করতে চায়, যা করোনা থেকে তাদের নিশ্চিন্ত নিরাপত্তা দিতে পারবে। এ কারণেই হয়তো ঈদযাত্রার আনন্দপর্বটি তারা কষ্টেসৃষ্টে শেষ করছে।
‘আসি যাই মাহিনা পাই’ ভিত্তিতে যে সরকারি কর্মচারী জীবন চালায়, তাদের কাছে করোনার ছুটি ঈদের ছুটির আনন্দকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই আনন্দে তারা গ্রামে দৌড়াচ্ছে। এর বাইরে যারা গ্রামে ছুটছে, তাদের বড় অংশ হলো পরিযায়ী শ্রমিক বা চাকরিজীবী। তারা গ্রাম থেকে ঢাকা যাওয়া মানুষ।
শত বছর ধরে গরিব মানুষ জীবিকার সন্ধানে গ্রাম আর শহরের মধ্যে ঘুরেফিরে থেকেছে। লকডাউনের মতো বিপর্যয়ে শহরে যখন কাজ থাকে না, তখন উপার্জন না হওয়ায় তাদের গ্রামে যেতে বাধ্য হতে হয়। গ্রামের দারিদ্র্য আবার তাদের ঠেলে শহরে পাঠিয়ে দেয়।

বহুবার প্রশ্ন উঠেছে, কার ধাক্কা কে সামলায়? গ্রামের ধাক্কা শহর সামলায়, নাকি শহরের ধাক্কা গ্রাম? আসলে, কোনোটাই না। গ্রাম আর শহরকে আমরা যে বৈপরীত্যের বিভাজিকা দিয়ে ভাবতে অভ্যস্ত, গরিব মানুষের কাছে সেই দর্শন অস্তিত্বহীন।
গ্রাম থেকে পাকাপাকিভাবে শহরে চলে আসার জন্য যা দরকার, শহরগুলো গরিব মানুষকে তা সংস্থানের জন্য যথেষ্ট আয় দিতে পারেনি। বাসস্থান বা নিরাপত্তাও দিতে পারেনি। ফলে তারা পাকাপাকিভাবে পরিযায়ী থেকে গেছে। গ্রাম থেকে শহরে, এক শহর থেকে আরেক শহরে পরিযানেই তার জীবন। সচ্ছলতা ছাড়া এই জীবনের ছুটে চলাকে কেউ আটকাতে পারবে না। এমনকি করোনাও না।

সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
ইমেইল: sarfuddin 2003 @gmail. com

সূত্র:প্রথম আলো।

ভয়েস/জেইউ।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION