বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:৫৯ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

মরণ রে তুঁহু মম শ্যামসমান

তুরিন আফরোজ:

আনন্দের বহিঃপ্রকাশে আমরা অনেকেই মরণকে কামনা করি। মরণেও জীবনের সুখ খুঁজে পাওয়া যায়। ‘মরণ রে, তুঁহু মম শ্যামসমান’। ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীতে ‘মরণ’ কবিতায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের প্রথম প্রভাতে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে অমৃতের স্বরূপ বলেই আহ্বান করেছিলেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুচিন্তায় নান্দনিকতা আমাদের বেশ আকৃষ্ট করে বটে। কবির আকুতিতে প্রকাশ পায়, ‘জীবনকে সত্য বলে জানতে গেলে মৃত্যুর মধ্য দিয়েই তার পরিচয় পেতে হবে। যে মানুষ ভয় পেয়ে মৃত্যুকে এড়িয়ে জীবনকে আঁকড়ে রয়েছে, জীবনের পরে তার যথার্থ শ্রদ্ধা নেই বলে জীবনকে সে পায়নি। যে লোক নিজে এগিয়ে গিয়ে মৃত্যুকে বন্দি করতে ছুটেছে, সে দেখতে পায়, যাকে সে ধরেছে সে মৃত্যুই নয়, সে জীবন’ (ফাল্গুনী, ১৩২২)। আর তাই কি, সামনের ঈদের আনন্দকে অমৃতসম উপভোগ করতে আমরা মৃত্যুর জয়গান গেয়ে কেনাকাটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি?

ত্রয়োদশ শতকের ফারসি কবি, ধর্মতাত্ত্বিক এবং সুফি মওলানা জালালউদ্দিন রুমিও কিন্তু মৃত্যুকে ভালোবেসে অমর হয়ে আছেন। প্রেম ও আশাবাদের কবি মওলানা জালালউদ্দিন রুমি তার অসাধারণ সৃষ্টি ‘যখন আমার মৃত্যু আসবে’ কবিতায় মৃত্যুর মাঝে জীবনের ছন্দ খুঁজে পেয়েছেন। তার ভাষায়

‘যখন দেখবে আমার মৃতদেহ নিয়ে যাচ্ছে, তুমি কেঁদো না

আমি কোথাও যাচ্ছি না, আমি কেবল পৌঁছে যাচ্ছি অনন্ত প্রেমে।’

মৃত্যুর মাঝে অনন্ত প্রেমকে খুঁজে পেতে রুমি যেভাবে দিশেহারা-দিওয়ানা, ঠিক একইরকম ভাবে আজকের এই করোনাকালে আমরা ছুটে চলেছি বাজারে-বিপণিতে। সামাজিক সঙ্গনিরোধ উপেক্ষা করে, জমায়েত করে আসন্ন ঈদে করোনা আক্রান্ত হয়ে উপভোগ করব বলে। আহা, এ তো জীবন থেকে ছুটি নেওয়া নয়, যেন ‘অনন্ত প্রেম’-এর কাছে ধাবিত হওয়া! মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ুক, কিন্তু জাতির অনন্ত প্রেমপ্রাপ্তি ঠেকায় কার সাধ্যি?

বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স, যমুনা ফিউচার পার্ক, নিউ মার্কেট, গাউছিয়া মার্কেট, চাঁদনী চক শপিং কমপ্লেক্সসহ রাজধানীর অনেক মার্কেট ও বিপণি-বিতানই বন্ধ থাকলেও খুলে গেছে বেশ কিছু মার্কেট ও দোকান। এদিকে আবার, নির্দেশনা অনুসারে স্বাস্থ্যবিধি মেনে এরই মধ্যে নিজেদের বেশিরভাগ আউটলেট খোলার ঘোষণা দিয়েছে দেশীয় ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড আড়ং ও বাংলাদেশের জুতা তৈরিকারক প্রতিষ্ঠান এপেক্স ও বাটা। প্রায় দুই মাস পর মার্কেট খোলায় নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে উৎসাহী ক্রেতারাও আসছেন বাজার-বিপণিতে। জমে উঠেছে ঈদের বাজার। ক্রেতাদের রঙিন স্বপ্নে অর্থনীতির চাকা একটু একটু করে ঘুরতে শুরু করল বলে।

কিন্তু অন্যদিকে, বাজার খোলার ক্রান্তিলগ্নে দেশের করোনা পরিস্থিতিটাও জেনে রাখা দরকার। বাজার খুলে দেয়ার ঠিক এক দিন পরে (১১ মে তারিখে), স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিন অনুসারে, ২৪ ঘণ্টায় দেশে ভয়াবহ করোনাভাইরাসে (শনাক্ত) হয়েছেন ১০৩৪ জন। ১২ মে তারিখে করোনাভাইরাসে (শনাক্ত) হয়েছেন ৯৬৯ জন, ১৩ মে তারিখে (শনাক্ত) হয়েছেন ১১৬২ জন, ১৪ মে তারিখে (শনাক্ত) হয়েছেন ১০৪১ জন এবং ১৫ মে তারিখে (শনাক্ত) হয়েছেন ১২০২ জন। করোনা-আক্রান্ত পরিস্থিতির এই ঊর্ধ্বগামী রেখার পথ ধরে দেশ যখন মৃত্যুর ‘ধূসর ঘোড়া’য় সওয়ার, ঠিক তখনই ঈদকে সামনে রেখে, বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এবং স্বাস্থ্যবিধি মানার শর্তে গত রোববার (১০ মে) থেকে দোকানপাট ও শপিংমল খোলার অনুমতি দিয়েছে সরকার।

ভাবছেন, দোকান-বাজার খুলে খুলুক, সরকার-ই তো খুলে দিতে বলেছে। আমরা গেলেই যত দোষ তাই না? কে মরল কে বাঁচল তাতে আমাদের কী যায় আসে? আমরা তো আর সরকার না, অতসব হিসাব আমাদের না করলেও চলে। একটি বিষয় ভুলে গেলে চলবে না, সরকার অর্থনীতি চাঙ্গা রাখতে অনেক পদক্ষেপ নিতেই বাধ্য হবে। সরকারকে অনেক হিসাব-নিকাশ কষতে হয়। ক্ষমতার গদি টিকিয়ে রাখার রাজনীতিও যে কোনো সরকারের জন্য অত্যন্ত জরুরি। আর তাই ভারসাম্যের খেলায় না নেমে সরকারের উপায় থাকে না।

কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, আমরা কেন বেঁচে থাকার লড়াইটা করব না? নিজেদের জন্য, নিজেদের আপনজনদের জন্য? আমরা মোটেই সে পথে হাঁটছি না। বাজার খুলে দেওয়ার পর ক্রেতাদের লম্বা লাইন দেখে মনে হচ্ছে যে আসন্ন ঈদ যেন আমাদের ‘শত জনমের ঈদ’। ঈদের কেনাকাটা না করলে যে আমাদের এই মানবজীবনই বৃথা! একবারও কি ভাবছি, এই করোনাকালে ঈদের বাজার করে আমরা নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছি?

মৃত্যুর মাঝে হয়তো নান্দনিকতা রয়েছে। জীবনবাদী কবি জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কবিতা ‘মানুষের মৃত্যু হ’লে’ আমাদের শেখায় মানুষ তার মৃত্যুতে মানুষই থাকে। সে তার দায়িত্ববোধ থেকে মুক্তি নেয় না।

‘মানুষের মৃত্যু হ’লে তবুও মানব থেকে যায়; অতীতের থেকে উঠে আজকের মানুষের কাছে আরো ভালো আরো স্থির দিকনির্ণয়ের মতো চেতনার পরিমাপে নিয়ন্ত্রিত কাজ কতো দূর অগ্রসর হ’য়ে গেল জেনে নিতে আসে।’

মৃত্যুকে আমি ভয় করি না তবে সেটা যদি কোনো মহৎ উদ্দেশে হয়। কিন্তু ঈদের কেনাকাটা করতে গিয়ে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করাকে আমার কাছে হঠকারী পদক্ষেপই মনে হয়। একটা ঈদ যদি সাদাসিধে ভাবে পালন করতে হয় তাতে আসলে ক্ষতিটা কতটুকু? আর ঈদ মানে কি জৌলুশের বাহার দেখানো? একজন প্রকৃত মুসলমানের ইমান কি এতটাই নড়বড়ে যে মহামারীকালে অসংখ্য লোকের মৃত্যুর মিছিল উপেক্ষা করে দামামা না বাজালে চলে না? বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম গেয়েছেন

‘নাই হল মা বসন ভূষণ এই ঈদে আমার।

আল্লা আমার মাথার মুকুট, রসুল গলার হার।।

নামাজ রোজার ওড়না শাড়ি

ওতেই আমায় মানায় ভারী

কলমা আমার কপালে টিপ, নাই তুলনা তার।।’

তাই আমি মনে করি, এই যে বাজার খুলে যাওয়াতে আমাদের সদাই-পাতি খরিদ করার যে হিড়িক তা কিন্তু আত্মহননমূলক। এখন অনেকেই কু-তর্ক দিতে পারেন, ‘ভাই, আমি আত্মহত্যা করলে আপনার কী যায় আসে? আত্মহত্যা করাটাও একটা মানবাধিকার। আমি মরতে চাই, আমাকে মরতে দিন।’ এরকম বলার লোকেরও কিন্তু অভাব নেই। আত্মহত্যার দর্শনে বিশ্বাসী অনেক বড় বড় দার্শনিক এরকম কথাই অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন।

যেমন গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর মতে আত্মহত্যা করা সব সময়ে অনৈতিক নয়। কেউ যদি দুর্ভাগ্যবশত জীবন ধারণে অপারগ হন, অথবা অপমানে জর্জরিত হন, তখন তিনি আত্মহত্যা করতেই পারেন। আবার অনেক দার্শনিকের মতে, আত্মহত্যা সবসময় অযৌক্তিক নয়, কখনো কখনো বাস্তব সমস্যার সঠিক সমাধান। শোপেনহাওয়ার তাই আত্মহত্যাকে অনৈতিক বলে মনে করেন না, আত্মহত্যাকে একজন ব্যক্তির অধিকার বলে মনে করেন। ওদিকে আত্মহত্যার অধিকারকে আইনানুগ স্বীকৃতির জন্য ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো আন্দোলন করেছিলেন। মিশেল ফুকোর উদ্যোগে একবার নাকি ফ্রান্সের প্যারিস শহরে ‘আত্মহত্যা উৎসব’-এর আয়োজনও করা হয়েছিল। ক্ষণজন্মা কবি ফালগুনী রায় স্বেচ্ছামৃত্যুর জয়গান গেয়েছেন

‘তোমাদের পৃথিবীর পাশে আমার এই স্বমারণোৎসব

আমার স্বেচ্ছামৃত্যুর এই গান

আমায় দিয়েছে এনে নির্বাণের মহাসম্মান।’

এত কিছু বলার উদ্দেশ্য হলো, করোনাভাইরাস যখন আমাদের দেশে ডাল-পালা বিস্তার করে তার রাজত্ব কায়েম করে চলেছে, ঠিক তখনই আমাদের ঈদের কেনাকাটা নিয়ে উদ্ভ্রান্ত হওয়া “স্বমারণোৎসব”-ই তো বটে। এই স্বেচ্ছামৃত্যুর মাধ্যমে আমরা কী অর্জন করতে চলেছি? মৃত্যুর প্রতি ভালোবাসাকে অমরত্ব দান করতে চাইছি? কোনটির সংক্রমণ বেশি ভয়ংকর ভালোবাসার নাকি ভাইরাসের? শেক্সপিয়ারের “টুয়েল্ফথ নাইট” নাটকটিতে অলিভিয়ার এক সময় মনে হয়েছে, ভালোবাসা তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়াটা যেন প্লেগের সংক্রমণের মতোই। অলিভিয়া বলে ওঠে, ‘এরকম দ্রুতই হয়তো কেউ প্লেগে আক্রান্ত হয়।’ সাহিত্যে অনেক কিছুই সম্ভব লেখা অথবা বলা; বাস্তবতা অনেক নিষ্ঠুর।

আর তাই, মৃত্যুকে ভালোবেসে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার মাঝে আমি কোনো নান্দনিকতাই খুঁজে পাই না। এই অর্থহীন মৃত্যু-অভিসার বন্ধ হোক!

লেখক-আইনজীবী ও আইনের শিক্ষক

Barrister_Tureen@hotmail.com

সুত্র:দেশ রূপান্তর।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION