রবিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ০৬:৪৯ পূর্বাহ্ন
খালেদ মুহিউদ্দীন, ডয়চে ভেলে :
গণস্বাস্থ্য করোনা শনাক্ত করার কিট ‘আবিস্কার’ করেছে৷ সরকার সেটি এখন আর নিতে চাইছে না৷ সরকার দুর্নীতিপরায়ন ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে অসততা আছে- একথা মুখস্থ বলেই দেওয়া যায়৷
কিন্তু তাই বলে, বৈজ্ঞানিক পন্থা নেওয়া হয়নি জনস্বাস্থ্যের এমন উপকরণ নিয়ে হাজির হওয়াও খুব সুনীতির পরিচয় বহন করে না৷
দুঃসময় পার করছি আমরা সবাই৷ করোনায় মরব না অভাবে পিষ্ট হয় তাই জানি না ভালো করে৷ মনে করেছিলাম, এর চেয়ে অসময় আর নিশ্চয়ই আসবে না৷ আমরা নিশ্চয়ই সুড়ঙ্গের শেষে আলো দেখতে পাবো কিছুক্ষণের মধ্যেই৷ তবে কে জানি বলেছিল না, অভাগার জন্য টানেলের শেষে আলো মানে হলো উল্টা দিক থেকে অন্ধ গতিতে ধেয়ে আসা ট্রেন৷
আমাদের কপালেও মনে হয় আরো দুঃখ রয়েইছে৷ করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে এতদিন পর্যন্ত আমরা যেসব উদ্যোগ নিয়েছি, যত গল্প যত গুজব নিজেরা ছড়িয়েছি, যত কিছু গোপন করেছি বা যা কিছু প্রকাশ্যে দেখেছি তাতে অনেক সময়ই মনে হয়েছে আর কত! পরে বুঝেছি, আরো অনেক কিছু দেখার বাকি রয়ে গেছে৷
গল্পটি গ্রামবাংলার, এর নানারকম সংস্করণ রয়েছে৷ আমি যেটি শুনেছি তা অনেকটা এরকম৷ একজন নারী বাড়ির পিছনের মাঠে কাজ করতে গিয়ে একটা মাথার খুলি পেলেন৷ বিস্ময় নিয়ে লক্ষ্য করলেন এর কপালে স্পষ্ট লেখা যে আরো দুঃখ আছে৷ নারীটি ভাবলেন, এ রকম বেঘোরে প্রাণ দিয়েছে এ খুলির মালিক, সৎকার পর্যন্ত হয়নি, কেউ এসে একে মাটিতে কোন কবে পুঁতে রেখেছে৷ এর কপালে আর কী দুঃখ থাকতে পারে? কৌতূহল মেটাতে তিনি খুলিটি ঘরে নিয়ে আসেন, পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করে রেখে দেন তার কুলুঙ্গিতে৷ বলে রাখা ভালো, এ কথা তিনি তার কৃষক স্বামী অথবা ছেলেমেয়ে কাউকেই জানাননি৷ কী দরকার! ভয়-টয় পেলে কেলেংকারি! মাঝে মধ্যে খুলিটি হাতে নিয়ে তিনি আনমনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেন৷ এদিকে স্বামীটি হঠাৎ একদিন দেখে ফেলেন, তার স্ত্রী খুব যত্নে রাখা গোপন কিছুকে বের করে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছেন৷ চাষীর মনে কৌতূহল, মাথায় সন্দেহ৷ একদিন মওকা বুঝে কুলুঙ্গিতে রাখা খুলি আবিস্কার করেন তিনি৷ খুলিটি পেয়ে এক নিমেষেই যা বোঝার বুঝে যান তিনি৷ তাহলে এই কথা! পুরনো প্রেমিকের খুলি যত্ন করে রাখা হয় আর গোপনে আদর করা হয়৷ তিনি সেই মুহূর্তে খুলিটি আছড়ে ভাঙেন, লাঠি দিয়েও গুড়োগুড়ো করেন৷ স্ত্রী বুঝে যান, কপালে আর কী দুঃখ ছিল প্রাণহীন ওই বস্তুর৷
যাক, আজকের প্রসঙ্গে আসি, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র করোনা শনাক্ত করার কিট বানিয়েছে৷ সরকার তা নিতে, অনুমোদন দিতে টালবাহানা করছে বলে অভিযোগ৷ কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ বলেছেন, সরকার দুষ্ট, তাই তার কিট নিচ্ছেন না৷ আর সরকার বলছে, কেন্দ্রের বানানো কিট বৈজ্ঞানিক প্রটোকল মানেনি৷ সরকারবিরোধীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, বলছেন, সরকারের এটি রাজনৈতিক অপকৌশল, কারণ, এই সরকার জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসেনি৷
গত কয়েকদিনে এ সংক্রান্ত বেশ কিছু খবর পড়লাম, টেলিভিশনের টক শো দেখলাম, যেখানে ডা. জাফরুল্লাহ নিজে কথা বলেছেন৷ সব কিছু দেখে আমার মনে হয়েছে, এই কিট বানানোর ক্ষেত্রে গণস্বাস্থ্য যথাযথ বৈজ্ঞানিক প্রটোকল মানেনি৷ সরকারের অবস্থান এক্ষেত্রে ঠিক৷ তবে এই সময়ে কিট নিয়ে এরকম চাপানউতোর না হলেই মনে হয় ভালো হতো৷ আর নানা কারণে সরকারের উপর ভরসা নেই অনেকেরই৷ আমার আপনজন বলছেন, সরকার চাইলেই তো পরীক্ষা করে দেখতে পারে এই কিট কাজ করে কি করে না? সরকারের কাছে তো আর নমুনার অভাব নেই, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত বিভিন্ন স্টেজের ১০০ জন আর আক্রান্ত নন এরকম ১০০ জনের উপর পরীক্ষা করে কিটের কার্যকারিতা দেখা কি এতই কঠিন? এর জন্য এত পানি ঘোলা করার কী অর্থ?
সরকারের কাজ-কামের অর্থ আমি জানি না, তবে কী কারণে আমি মনে করছি ডা. জাফরুল্লাহর দাবি অযৌক্তিক তা বোঝাতে চেষ্টা করা যাক৷ এক্ষেত্রে আমি তিনজনের কথা উদ্ধৃত করি৷
প্রথমে সেরীন ফেরদৌসের কথা৷ আমরা দৈনিক প্রথম আলোতে একসঙ্গে কাজ করেছি৷ এখন ক্যানাডার টরন্টোতে বসবাসরত সেরীন একজন রেজিস্টার্ড প্র্যাক্টিক্যাল নার্স৷ কয়েক ঘণ্টা আগে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে ভাইরাস শনাক্তকরন পদ্ধতি বলেছেন৷ ‘‘ ভাইরাসের সংক্রমণের পর থেকেই একজন মানুষের শরীরে ভাইরাসের প্রবেশ ঘটেছে কিনা তা শনাক্ত করতে সোয়াবের মাধ্যমে (নাক-মুখের ভেতরের অংশের পিচ্ছিল তরল নিয়ে) পরীক্ষা চালানো হচ্ছে৷ করোনা ভাইরাসটি শরীরে ঢোকার সাথে সাথেই সোয়াব টেস্টের মাধ্যমে জানা সম্ভব যে, মানুষটি আক্রান্ত হয়েছে কিনা৷ এমনকি সিম্পটম (জ্বর, কাশি, হাঁচি, ক্লান্তি, ডায়রিয়া, মাংসপেশী ব্যাথা ইত্যাদি) শুরু হবার আগেই সেটা জানা সম্ভব৷ এখন পর্যন্ত সিংহভাগ দেশই এই পদ্ধতি অনুসরণ করছে৷ সম্প্রতি ক্যানাডা অতিদ্রুত, ঘন্টা দুয়েকের ভেতরই, সোয়াব পরীক্ষার পোর্টেবল ডিভাইস চালু করেছে৷
ভাইরাসের বিস্তারের সাথে সাথে বিভিন্ন দেশ এবং বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলো ‘র্যাপিড টেস্টে’র পদ্ধতি উদ্ভাবন করে, যা কণ্ঠের লালাজাতীয় পদার্থে নয়, রক্তে ভাইরাসের উপস্থিতি প্রমাণ করে৷ এই পদ্ধতিতে দ্রুত করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ পরীক্ষা করা যায় বলে কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৭০টিরও বেশি কোম্পানি তড়িঘড়ি করে র্যাপিড টেস্টের কিট প্রস্তুত শুরু করলে মার্কিন নিয়ন্ত্রক সংস্থা এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে৷ তারা অননুমোদিত টেস্টিং কিটের ব্যবহারের ব্যাপারে সতর্কতা জারি করে৷”
রক্ত থেকে করোনা টেস্টের পরীক্ষা নিয়ে সেরীন বলছেন, ‘‘ভাইরাসটি (এন্টিজেন) একজন মানুষের নাক-মুখ-গলায় প্রবেশের আরো অনেক অনেক পরে রক্তে যায়৷ ভাইরাসের সংক্রমণের পর আমাদের শরীরে এন্টিবডি (যোদ্ধা প্র্রোটিন) তৈরি হতেও গড়ে দু-এক সপ্তাহ সময় নেয়৷ বলা বাহুল্য, এন্টিবডি রক্তেরই একটি উপাদান মাত্র৷ এন্টিবডি তৈরি হতে কার কতদিন সময় লাগবে এবং কী পরিমাণে তৈরি হবে, তা নির্ভর করে রোগীর বয়স এবং শরীরের সামর্থ্যর উপর৷ কারো কারো কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে৷ উল্লেখ্য, করোনা ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার পরপরই রক্তে এন্টিজেন ও এন্টিবডি, এই দুই বান্দার কাউকেই পাওয়া যায় না!
ভাইরাসটির রক্তে পৌঁছাতে পৌঁছাতে যেটুকু সময় লাগে, সে পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর যদি কারো পরীক্ষা করা হয়, দেখা যাবে ততদিনে রোগী নানারকম সিম্পটম ভোগ করছে অথবা রোগীর অসতর্ক থাকার সম্ভাবনা থাকছে এবং এমনকি গুরুত্ব কম দেবার কারণে মৃত্যুও ঘটতে পারে! এই সময়ে সে আরো মানুষকে সংক্রমিতও করে ফেলতে পারে৷ এই জন্যই সোয়াব টেস্টকে বলা হয় সরাসরি পদ্ধতি আর রক্ত পরীক্ষাকে বলা হয় পরোক্ষ পদ্ধতি৷
আরও কথা আছে৷ যেহেতু এন্টিবডি তৈরি হতে সময় লাগে এবং রোগী ভালো হয়ে যাবার পরও এন্টিবডি রক্তে থেকেই যায়, তাই শুধু এন্টিবডি পরীক্ষা করে কাউকে ‘রোগী’ সাব্যাস্ত করা ১০০% ঠিক বলা যায় না৷ আবার করোনা ভাইরাস ছাড়াও অন্য কোনো কারণে (সাধারণ ফ্লু) শরীরে আগে থেকেই বেশি এন্টিবডি তৈরি হয়ে থাকতে পারে৷ সেক্ষেত্রেও রক্তে এন্টিবডির পরিমানের উপর নির্ভর করে করোনা-আক্রান্ত নয় এমন কাউকেও ভুলক্রমে করোনা-আক্রান্ত বলে নির্বাচন করা হতে পারে৷
লোকাল ইনফেকশন থাকা অবস্থায় শরীরের ইমিউন সিস্টেম এন্টিবডি তৈরিতে মনোযোগ দেয়৷ কখনো কখনো তা কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত লেগে যেতে পারে৷ রক্তের মাধ্যমে যে পরীক্ষা পদ্ধতি, তাতে কোনো ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত কিনা তা নিশ্চিত হ্ওয়ার জন্য ভাইরাসটি ফুসফুসকে ক্ষতিগ্রস্থ করে রক্ত পর্যন্ত যেতে হবে৷ ভাইরাসটি রক্তে যাবার পরই এই ধরনের পরীক্ষায় ভাইরাস সংক্রমিত হ্ওয়ার প্রমাণ পা্ওয়া যাবে৷
বিশ্বস্বাস্থ্য স্বাস্থ্য সংস্থা চিকিৎসাকেন্দ্রে বা চিকিৎসার জন্য করোনা পরীক্ষায় এই ধরনের এন্টিবডি বা রক্তের মাধ্যমে পরীক্ষাকে সমর্থন দিচ্ছে না৷ গত ৮ এপ্রিল তারা এক বিবৃতিতে বলে দিয়েছে, তারা এন্টিজেন চিহ্নিত করার মাধ্যমে র্যাপিড টেস্টকে সুপারিশ করে না৷ তবে গবেষণা বা এই টেস্টের কার্যকারিতা বৃদ্ধি বা মানোন্নয়নের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে৷”
কিন্তু প্রশ্ন আসে, এ বিষয়টি তো হঠাৎ আবিস্কার হয়নি বা আজকে জানা যায়নি৷ র্যাপিড টেস্টের জন্য এই কিট তৈরির অনুমতি সরকারই দিয়েছিল৷ এখন কেন সরকার ‘আমি কিছু জানি না’ টাইপ একটা ভাণ করছেন৷
‘‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র করোনাভাইরাস শনাক্ত করার জন্য একটি কিট আবিষ্কার করেছে এবং আজকে (২৫ এপ্রিল) তারা প্রেস কনফারেন্স করেছেন৷ সেখানে সরকারের কেউ যাননি৷ একজন স্বাস্থ্যবিজ্ঞানী হিসেবে এবং দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে আমার কাছে মনে হয়েছে সরকার ঠিক কাজটি করেছে৷ কেন?
একটি ডায়াগনস্টিক কিট আবিষ্কার করে জনসাধারণের ব্যবহার করার জন্য আসুন দেখি বিজ্ঞানের মাঠে কী কী স্টেপ (পদক্ষেপ) নিতে হয়-
১. আপনার গবেষণা দল ভাইরোলজি, ইমিউনোলজি এবং ল্যাব সায়েন্সের ভিত্তির ওপর নির্ভর করে একটি কিটের প্রোটোটাইপ আবিষ্কার করবে৷
২. তারা এই কিটটির কার্যকারিতা কীভাবে পরীক্ষা করা যায় সেটি নিয়ে একটি প্রটোকল লিখবেন এবং সেটি নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেবেন (বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল-বিএমআরসি)৷
৩. সেই প্রটোকলটি অ্যাপ্রুভড হলে তারা বা থার্ড পার্টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কিটটির কার্যকারিতা নিয়ে একটি এপিডেমিওলজিক্যাল গবেষণা করবে৷
৪. আপনি আপনার গবেষণার সকল তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের (ডিজিডিএ) কাছে জমা দেবেন এবং সম্ভব হলে ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে পাবলিশ করবেন৷
৫. ডিজিডিএ সকল তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করে আপনাকে পারমিশন (অনুমতি) দেবে সেই কিটটি উৎপাদন এবং বাজারজাত করার৷
এবার আসুন দেখি ডায়াগনস্টিক কিট আবিষ্কারের রাজনৈতিক ধাপগুলো কী কী-
১. আপনি শুরু থেকে সরাসরি দাবি করে বসবেন যে, আপনার টেস্ট কিট শতভাগ কার্যকর৷ এটিকে কিনে নেয়ার জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষজন ঝাঁপিয়ে পড়ছে৷
২. কেউ যদি আপনার দাবি নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে, তাহলে বলুন যে, তারা নিজেরা পরীক্ষা করে দেখুক, আমি সত্যি বলছি কিনা৷
৩, জনমতকে আপনার ফেভারে কাজে লাগান৷ সন্দেহ নেই যে, দেশে কিটের অভাব রয়েছে, সেটি নিয়ে বেশি বেশি কথা বলুন৷ মানুষের আবেগ, দেশপ্রেম এগুলো কাজে লাগান (যেমন: সাম্প্রতিক একটি ইন্টারভিউতে ‘বাংলাদেশি রক্ত’ কথাটি প্রায় ৫-৬ বার উল্লেখ করা হয়েছে৷)
৪. আপনি সরকারের সিস্টেমের ‘ভিকটিম’ হিসেবে দাবি করুন৷ সরকার আপনাকে পদে পদে বাধা দিচ্ছেন সেটি বলতে থাকুন৷
৫. যে-কোনো প্রকার আলোচনায় বা প্রেস কনফারেন্সে আপনার চিফ সায়েন্টিফিক অফিসারকে না পাঠিয়ে আপনি নিজে যান৷ বৈজ্ঞানিক আলোচনা পরিহার করুন৷ মানুষজনকে বলুন এটি খুব সহজ একটি পরীক্ষা- অনেকটা প্রেগনেন্সি বা ডায়াবেটিসের টেস্টের মতো৷
সরকার কি আসলেই গণস্বাস্থ্যের র্যাপিড কিট আবিষ্কারের শত্রু? না৷ গণস্বাস্থ্যের কিটের প্রধান সমস্যাগুলো কী আসুন তা বোঝার চেষ্টা করি-
১, র্যাপিড কিটের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ‘ফলস নেগেটিভ’৷ অর্থাৎ, একজন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিকে আপনি শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছেন৷ এর ফলাফল ভয়াবহ, কারণ, আপনি তখন তাকে অন্যদের মাঝে ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করছেন৷
২. এখন পর্যন্ত পৃথিবীর কোথাও এই ধরনের র্যাপিড কিট কার্যকর হয়নি৷ এইটাই বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা৷ অনেক চাইনিজ কোম্পানি দাবি করেছিল এবং সেগুলি কিনে যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডসের মতো দেশ ধরা খেয়েছে৷ একটু গুগল করে দেখুন, নিজেই বুঝতে পারবেন৷
৩, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র কিছু কিছু ব্যাপার দাবি করেছে, যেগুলো মারাত্মক ধরনের সায়েন্টিফিক মিসকন্ডাক্ট বা রিসার্চ এথিক্সকে ভায়োলেট করে৷ যেমন- তারা বলেছেন তারা বিদেশ থেকে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর রক্ত পরীক্ষা করেছেন৷ যদি এটি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে এই পারমিশন তারা কোথায় পেয়েছেন? আবার তারা প্রাথমিক আবেদনপত্রে বলেছেন, অ্যান্টিবডি টেস্ট করবেন, এখন তারা বলছেন যে অ্যান্টিজেন টেস্ট বের করেছেন৷ এই ধরনের অস্বচ্ছতা কিন্তু সায়েন্টিফিক মিসকন্ডাক্ট৷
৪. যেহেতু র্যাপিড কিট দিয়ে নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয় যে কারো করোনাভাইরাস আছে কিনা, তাই পিসিআর টেস্ট করতে হবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য৷ গণস্বাস্থ্য যেহেতু এটি বাণিজ্যিক লাভের জন্য করছে, তাহলে র্যাপিড কিট এবং পিসিআর টেস্ট দুটি করার অতিরিক্ত খরচ কে বহন করবে?
দেখুন, আমি আশাবাদী মানুষ৷ আমি আমার বাজির দান গণস্বাস্থ্যের কিটের পক্ষেই রাখতাম যদি না তারা সঠিকভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করতো৷ কিন্তু তারা বিজ্ঞানের মাঠে না খেলে রাজনীতির মাঠে খেলছে এবং সেখানে সরকার রাজনীতির সঠিক চালটিই দিয়েছে৷ কারণ, সরকারের কেউ আজ থাকলে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র বলত যে, আমরা তাদেরকে দিয়েছি এবং তারা সেটি আটকে দিয়েছেন৷ অর্থাৎ, দোষ সরকারের ঘাড়েই আসতো৷
আসুন এই ক্রান্তিকালে রাজনীতি বাদ দিয়ে সঠিকভাবে বিজ্ঞানকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করি৷
আর সবশেষে আমার অনেকদিনের সহকর্মী জনাব সঞ্জয় দে কে উদ্ধৃত করি৷
গণস্বাস্থ্যের কিট ক্লিনিকাল ট্রায়াল ছাড়াই দ্রুত অনুমোদন দেয়া উচিত৷ অথবা এর মান পরীক্ষার দায়িত্ব উৎপাদনকারী নয়, সরকারকেই নিতে হবে৷ এ ধরনের দাবির পক্ষে যেসব যুক্তি এখন পর্যন্ত পাচ্ছি-
দেশে গণমুখী স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার পেছনে গণস্বাস্থ্যের ভূমিকা ব্যাপক৷
ডা. জাফরুল্লা চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন৷
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সরকারবিরোধী অবস্থানের কারণে নিপীড়িত (তার বিরুদ্ধে মাছ চুরির মামলাও দেয়া হয়েছিল)৷
ড. বিজন কুমার শীল ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাস শনাক্তকরণ কিট আবিষ্কার দলের সদস্য ছিলেন৷
দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে এগিয়ে আসা বিজ্ঞানীদের উৎসাহিত করা দরকার৷
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা যত বেশি সম্ভব পরীক্ষা করতে বলেছে (৫৫ জন নাগরিকের বিবৃতিতেও এটা আছে, তবে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা অন্যদিকে রাপিড কিট দিয়ে রোগী শনাক্ত না করার সুষ্পষ্ট পরামর্শও যে দিয়েছে সেটি সম্ভবত বিবৃতিদাতাদের নজরে আসেনি)৷
এই কিটের দাম পড়বে মাত্র ২৫০-৩০০ টাকা৷
সরকার বাইরে থেকে কিট আমদানি করে কমিশন খেতে চায়৷
পশ্চিমা দেশসহ পাশের দেশ ভারত র্যাপিড কিটে আস্থা হারালেও গণস্বাস্থ্যের র্যাপিড কিট নিয়ে প্রশ্ন তোলা উদ্দেশ্যমূলক৷
আরে ভাই, ভারতে বাতিল করা র্যাপিড কিট বানিয়েছে চীন, আমাদেরটা তো চীনের নয়৷ (যদিও চীন ছাড়াও জাপানসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠানের র্যাপিড কিটও একই প্রশ্নে পড়েছে)৷
কই নিম্নমানের পিপিইর সময়ে তো স্বাস্থ্য বিভাগকে এত তৎপর দেখলাম না!
সমস্যা পেলে পরে আর নিয়েন না, তবে আগে নিতে হবে৷
আরে ভাই, এটা তো কোনো ওষুধ না যে খেয়ে মরে যাবে! একটা ভাইরাস পরীক্ষার একটি সামান্য কিট মাত্র৷
এই কিটে ৩০-৪০ শতাংশ ভুল ফল আসলে আসুক, বাকিরা তো শনাক্ত হবে৷
তাহলে কাচামাল আনার অনুমতি দিলো কেন?
সারা পৃথিবীতে এ ধরনের পণ্যের উৎপাদকের জন্য তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা চালানোর বাধ্যবাধকতা আছে জানি৷ তবে গণস্বাস্থ্যেরটি সরকারকেই পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে৷
যারা ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চান তারা হয় সরকারের দালাল, নয়তো আওয়ামী লীগের টাকা খান, নয়ত আমলা মানসিকতার৷
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অনেক বড় বড় দুর্নীতি হয়৷ এই কয়দিন আগেই তো হাজার কোটি কাটার দুর্নীতির খবর বের হলো৷
কেন, সরকারের মন্ত্রী আমলারা যে ফেব্রুয়ারিতে সদলবলে বিমানবন্দরে গিয়ে কোরিয়ান কিট গ্রহণের ছবি তুললেন!! সরকারি দলের কয়েক নেতা যে বিদেশ থেকে নিজ উদ্যোগে র্যাপিড কিট নিয়ে এলেন!!!
আরে বহু দেশে টিকা পরীক্ষাপদ্ধতিরও ধাপ কমিয়েছে (ধাপ কমানো মানে যদিও ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা বাতিল করা নয়, অথবা কাজটি সরকার করে দিচ্ছে তা-ও নয়)৷
ধুর এত বিতর্ক ভাল্লাগে না, অনুমোদন দিয়ে দিলেই তো হয়৷
নিয়মের বাইরে গিয়ে স্বাস্থ্যগত পরীক্ষার একটি কিট অনুমোদন করানোর পক্ষে কোনো যুক্তি কি মিস করেছি? ধরিয়ে দিয়ে সাহায্য করতে পারেন…
সূত্র : ডয়েচে ভেলে।