বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ০১:৫৯ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

প্রতারকের স্থান জাহান্নাম

জুমার দিন, ফাইল ছবি

শাহীন হাসনাত:

ধোঁকা ও প্রতারণা মুমিনের কাজ নয়। কোনো মুমিন কোনো অবস্থায়ই এমন জঘন্য পাপের কাজে লিপ্ত হতে পারে না। কারণ আল্লাহতায়ালা ধোঁকাবাজ ও প্রতারকদের পছন্দ করেন না। ধোঁকাবাজদের মূল অস্ত্র হলো মিথ্যা। তারা সাধারণত এর মাধ্যমে মানুষকে প্রতারিত করে, মানুষের হক নষ্ট করে। পবিত্র কোরআনে মানুষের এই বদ অভ্যাস সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ ও মুমিনদের তারা প্রতারিত করে, বস্তুত তারা নিজেদেরই নিজেরা প্রতারিত করছে, অথচ তারা তা বুঝে না।’ -সুরা বাকারা : ৯

কোরআন-হাদিসের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও দুনিয়াতে কিছু মানুষ মানুষকে ধোঁকা দেয়। অথচ যারা ধোঁকা ও প্রতারণায় লিপ্ত হবে নবী করিম (সা.) তাদের উম্মতের তালিকা থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছেন। বর্ণিত হয়েছে, ‘যে প্রতারণা করে, সে আমার দলভুক্ত নয়।’ -সহিহ মুসলিম : ১০২

সম্প্রতি এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান মুফতি রাগীব আহসান নামের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি সুদবিহীন বিনিয়োগের কথা বলে ১৭ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তিনি শরিয়তসম্মত বিনিয়োগের বিষয়টি ব্যাপক প্রচারণা করে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতেন। লোভ কিংবা টাকার কাছে যে মানুষ অসহায়, ধর্মীয় লেবাসে সাধারণ মানুষের অর্থ-সম্পত্তি লোপাটের ঘটনায় ফের তার প্রমাণ মিলল। আলোচিত এহসান গ্রুপ অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় এমএলএমের সেই পুরনো ফাঁদ পেতে অতি মুনাফার লোভ দেখিয়ে গ্রাহকদের প্রতারিত করেছে। তবে তার শেষ রক্ষা হয়নি। গ্রেপ্তার হতে হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে।

এর আগে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আলেম-উলামাদের নেতৃত্বে পরিচালিত সেবক, সৌরভ, এহসান এস বাংলাদেশ, ফ্রেশ, খেদমতে খালক, আল হেলাল, আল আমানাহ, পরশ, আল আকসা ইসলামি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, তামাদ্দুন মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি, ফারইস্ট ইসলামি কো-অপারেটিভ সোসাইটি ও ইসলামি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটিসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গ্রাহক এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের টাকা লোপাট করেছে। এসব প্রতারণার ঘটনায় একথা বলা অত্যুক্তি হবে না, আমাদের সামাজিক অধঃপতন মারাত্মক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে; যেখানে বিপুলসংখ্যক মানুষ রাতারাতি ধনী হওয়ার বাসনায় অসুস্থ প্রতিযোগিতায় আচ্ছন্ন, লোভে কাতর। বাস্তবে বিপুল অর্থ নিজের কব্জায় নিতে অনেকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ছে।

বলা অসংগত নয়, আত্মশুদ্ধিহীন জীবন ও ভোগবাদে মাত্রাতিরিক্ত আসক্তিতেই এমন অধঃপতন। ফলে অভিনব কায়দায় ফাঁদ পেতে বিপুলসংখ্যক মানুষের সম্পদ হাতিয়ে নেওয়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। এই তালিকায় আলেম-উলামাদের আগে সেভাবে দেখা যেত না, কিন্তু প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থাপনার চেয়ে বেশি মুনাফা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি এবং সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে প্রতারণার সেই পথটিও এবার উন্মুক্ত করলেন মুফতি রাগীব ও তার সহযোগীরা। এখানে একটি বিষয়ে দারুণ মিল রয়েছে। আলেম কিংবা সাধারণ শিক্ষিত যারাই প্রতারক হোন না কেন তাদের নিশানায় থাকে একেবারে সাধারণ শ্রেণির মানুষ। নিরীহ মানুষদের সহজ শিকারে পরিণত করার মনস্তাত্ত্বিক কারণ হলো প্রতারিতরা থাকেন দুর্বল। তারা সংঘবদ্ধ নন, সহজে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম নন।

রাগীব আহসান দেশের নানা প্রান্তের বিশেষ করে, দক্ষিণাঞ্চলে ধর্মপ্রাণ মানুষ, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যুক্ত ব্যক্তি, মসজিদের ইমাম ও অন্যদের নিশানা করে প্রতারণার ফাঁদ তৈরি করেছেন। ব্যাপকভাবে আলেম-উলামা ও সাধারণ মানুষদের স্বাবলম্বী করার প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে গ্রাহক আকৃষ্ট করেছেন। বিনিয়োগকারীদের মাত্রাতিরিক্ত লাভের প্রলোভন দেখাতেন। জালিয়াতি করতে ধর্মীয় আবরণে মুড়ে রাখতেন নিজেকে। ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করে দেশের নামিদামি বক্তাদের দিয়ে নিজের পক্ষে ও এহসানে বিনিয়োগের সুফল প্রসঙ্গে কথা বলাতেন। বক্তারা আপ্যায়িত হয়ে রাগীব ও এহসানের হয়ে গলা ফাটিয়েছেন, ইসলাম রক্ষার কথা বলে তার ওখানে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করেছেন; বিরুদ্ধবাদীদের গালি দিয়ে জাহান্নামের ভয় দেখিয়েছেন। সংগত কারণে বক্তারা এখন সমালোচনার শিকার হচ্ছেন। এক্ষেত্রে আমরা মনে করি, বক্তাদের ব্যক্তি বন্দনা, দুনিয়ার স্বার্থ আর ধর্মের মতলবি ব্যাখ্যা ছেড়ে সত্যিকারের ধর্মের কথা বলা প্রয়োজন।

মাঝে-মধ্যেই বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের আমানত কিংবা বিনিয়োগ নিয়ে সটকে যায়। তবে এবার এহসানের অর্থ লোপাটের ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। কারণ, পুরো বিষয়ের সঙ্গে ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে আলেমদের নাম, প্রভাব ও প্রচারণা জড়িত। কিন্তু উদ্যোক্তাদের মাত্রাতিরিক্ত লোভ, অনভিজ্ঞতা, কার্যকরভাবে শরিয়ত পরিপালন না করাসহ নানাবিধ কারণে এহসান গ্রুপ পথে বসেছে আর দায়ভার নিতে হচ্ছে আলেম সমাজের। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

নিজ নিজ পেশাদারিত্বে ইসলামের সৌন্দর্য প্রমাণ করা নৈতিক দায়িত্ব। এটাকে তুচ্ছ ভেবে শুধু বাহ্যিক লেবাসে ইসলামকে প্রাধান্য দিলে চলবে না। তাতে সমাজে এমন অনেক রাগীবের জন্ম হবে। একজন অফিসার যতই পরহেজগার কিংবা দাড়ি টুপিওয়ালা হোক, যদি সে তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করে লেবাস-সুরতে শুধু ইসলাম মান্যতাকে উপস্থাপন করে- কাজে ফাঁকি দিতে চায়, অবৈধভাবে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করে- তাহলে তাকে দিয়ে ইসলামের বিন্দু পরিমাণ উপকার হবে না।

আমরা জানি, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো চলে সাধারণ মানুষের বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে। এসব প্রতিষ্ঠানের মূল পুঁজিই হচ্ছে- সাধারণ মানুষের বিশ্বাস। সেখানে যদি আবার ধর্মীয় আবরণ, শরিয়ত মোতাবেক পথচলার কথা এবং ধর্মীয় বক্তাদের প্রচারণা থাকে তাহলে সেটা তো সোনায় সোহাগা। এটাকে পুঁজি করে ২০০৮ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এহসান গ্রুপ আর্থিক প্রতারণা করে গেছে। শুরুতে কিছু মুনাফা পেয়ে গ্রাহকরা প্রলুব্ধ হয়েছেন বটে, তবে সময় যত গড়িয়েছে, মানুষ ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মানুষ বিনিয়োগের সময় সচেতন হলে এ ধরনের ঘটনা এড়ানো যেত। এক্ষেত্রে মানুষকে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি মাল্টিপারপাস সোসাইটি, সংগঠন এবং সমিতির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর নিবন্ধন ব্যবস্থা ও নিবন্ধন-পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নজরদারি জারি রাখা দরকার।

আরেকটি কথা, দেশে ইসলামি কো-অপারেটিভ, ফাইন্যান্স ও মাইক্রোক্রেডিট ইত্যাদি নামে নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত লাখ লাখ সমিতি ব্যবসা করছে। এসব সমিতি তাদের কোম্পানি কিংবা প্রতিষ্ঠানের নামের আগে ইসলাম ও শরিয়া মোতাবেক পরিচালিত শব্দ লাগিয়ে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে আকৃষ্ট করে। আদতেই সেগুলো কতটা শরিয়ত মেনে পরিচালিত হয়, তাও বিচার-বিবেচনার দাবি রাখে।

লেখক : মুফতি ও ইসলামবিষয়ক লেখক

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION