বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:২০ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

করোনাকালে আম্পানের খাঁড়ায় নিরানন্দের ঈদ

কাজী জাহিদুল হক:

মুসলমানদের জন্য প্রতি বছর অনন্ত খুশির বার্তা নিয়ে হাজির হয় তাঁদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর। ঈদ আসে অফুরন্ত আনন্দের বন্যা নিয়ে। এমনকি আমাদের দেশে অন্যান্য ধর্মের মানুষকেও ঈদের আনন্দ স্পর্শ করে অনেকখানি। ধার্মিকতা এবং সামাজিকতার অপূর্ব সমন্বয় এই ঈদ উৎসব।

বর্তমানে বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের বিস্তারে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের জনগণকেও আত্মরক্ষার্থে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দীর্ঘদিন গৃহবন্দি থাকতে হচ্ছে। ফলে কর্মহীন হয়ে পড়েছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিপুলসংখ্যক মানুষ। তাঁদের জন্যে প্রয়োজন হচ্ছে খাদ্য ও অন্যান্য সহায়তা।

করোনাভাইরাসের মতো বৈশ্বিক মহামারির মধ্যেই সুপার সাইক্লোন আম্ফান নামের আঞ্চলিক দুর্যোগে নতুন করে বিপর্যস্ত দেশ। করোনা মানুষকে কর্মহীন করেছে কিন্তু আম্ফানের তাণ্ডব সেই কর্মহীন মানুষের দুর্দশা বহুগুনে বাড়িয়ে দিয়েছে। অনেকেই আবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। প্রাথমিক হিসাবে আম্ফানে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ এগারোশ’ কোটি টাকা। সময়ের আবর্তে এই মহামারির মধ্যেই এসেছে ঈদ। বাংলার আকাশে আবার শাওয়ালের চাঁদ উঠেছে, যাকে আমরা ঈদের চাঁদ বলি। এই চাঁদে কত আলো আর আনন্দের প্রত্যাশা থাকে! কিন্তু সেই আলো আর আনন্দ এবার অনুপস্থিত। শাওয়ালের চাঁদ এবার এসেছে আলো আর আনন্দের সব পশরা দূরে রেখে। আতঙ্কিত মানুষের ছবি বুকে নিয়ে। কিন্তু বাঙালির জীবনে ঈদে এই আতঙ্ক, এই নিরানন্দ কি এবারই প্রথম? এমন ঈদ কি অতীতে আর কখনো এসেছে বাঙালির জীবনে? একটু পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, ঠিক এবারের মতো না হলেও নিরানন্দের ঈদ বাঙালির জীবনে এর আগেও এসেছিল।

১৯৭০ সালে ঈদের আগে বারোই নভেম্বরের কাল-রাত্রিতে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের দশ লাখ বাঙালি নিশ্চিহ্ন হয়েছিল প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে। এই দুর্যোগ মোকাবিলায় তৎকালীন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ঔদাসীন্য বাঙালি জনমনে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে। সেবার ঈদে সারা বাংলা কেঁদেছে। কেউ গায়নি প্রাণভরে- ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ। সেবার ঈদের জামাত হয়েছে— জানাজার জামাত। তখন বাংলার মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল তারই আর্তি ক্ষোভ—
“বাঁচতে চাইলে বাঁচবে এমন কথা তো নেই
প্রমাণ পেলে তো হাতে হাতে
দশ লাখ শিশু নারী ও যুবক আজকে নেই
মরে গেছে তারা এক রাতে ॥”

১৯৭০-এ ঈদের ঠিক আগ মুহূর্তে প্রকৃতির হাতে মারা পড়েছে লক্ষ লক্ষ অসহায় বাঙালি। সেই মৃত্যুদীর্ণ বাংলার বুকে ১৯৭১-এ আঘাত হানতে দ্বিধা করেনি রক্তপিপাসু নরপশু ইয়াহিয়া। এ বছর শহিদ হয়েছে ত্রিশ লক্ষ মানুষ। এক কোটি মানুষকে হতে হয়েছিল দেশছাড়া। এমন পরিস্থিতিতে অবরুদ্ধ বাংলায় ভীতসন্ত্রস্ত বাঙালির ঘরে ঈদের বার্তা নিয়ে ১৯৭১ সালের ১৯শে নভেম্বর বাংলার আকাশে ঈদের চাঁদ উদিত হয়। বাংলার দামাল ছেলেরা তখন দেশমাতৃকার মুক্তির সংগ্রামে রণাঙ্গনে লড়ছে। মাথায় টুপির বদলে হেলমেট, নয়তো গামছা বাঁধা। সারাক্ষণ ব্যস্ত শত্রুর মোকাবিলায়, সময় কোথায় ঈদ করার? তাইতো ক্ষুদ্ধ শব্দ সৈনিক শহীদুল ইসলাম ঈদের চাঁদকে ফিরে যেতে বললেন। তিনি লিখলেন—
“চাঁদ তুমি ফিরে যাও ফিরে যাও,
দেখো, মানুষের খুনে খুনে রক্তিম বাংলা,
রূপসী আঁচল কোথায় রাখবো বলো?”

প্রখ্যাত গণসঙ্গীত শিল্পী সুরকার অজিত রায় সুর সংযোজন করলেন এ গানে। সিদ্ধান্ত হলো- ঈদের চাঁদ উঠলে এই গানটি প্রচারিত হবে। হলোও তাই। উঠলো ঈদের চাঁদ আকাশে। স্বাধীন বাংলা বেতারে বেজে উঠলো সমবেত কণ্ঠে সেই অজিত বিক্রমের গান- ‘চাঁদ তুমি ফিরে যাও ফিরে যাও’।

১৯৭০ ও ১৯৭১-এর চেয়ে এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। করোনাভাইরাস হঠাৎ করেই আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা পাল্টে দিয়েছে। আমরা এ বছর মহান স্বাধীনতা দিবস এবং বাংলা নববর্ষ বরণ উৎসব পালন থেকে বিরত থেকেছি। করোনার প্রভাব পড়েছে এবারের রমজান ও ঈদে। করোনার কারণে বেশিরভাগ মসজিদে এবার খতম তারাবি অনুষ্ঠিত হয়নি। বিগত কয়েক বছর ধরে রমজানের অন্যতম আকর্ষণ ইফতার পার্টি আয়োজন থেকে বিরত থাকতে হয়েছে। ধনি-দরিদ্র নির্বিশেষে বাঙালি নতুন কাপড় ছাড়া ঈদের কথা কি কল্পনা করেছে? ঈদ উপলক্ষ্যে সারাদেশে যে হাজার কোটি টাকার কেনাবেচা হয় তা এবার সম্ভব হয়নি। বহু বছর পরে পত্রিকাগুলো এবার ঈদসংখ্যা বের করা থেকে বিরত থাকল। মুক্তি পাচ্ছে না নতুন চলচ্চিত্র। টেলিভিশনের জন্যে নির্মিত হচ্ছে না নতুন নতুন অনুষ্ঠান। তবে রচিত হচ্ছে নতুন নতুন কবিতা, গান ও গল্প। এগুলোকে কি বলা হবে? করোনাকালীন সাহিত্য? জাতীয়ভাবে ঈদকেন্দ্রীক যে অনুষ্ঠানগুলো হয়ে থাকে সরকার এবার সেগুলো পালন থেকে বিরত। ঈদের নামাজ ঈদগাহ-এর পরিবর্তে স্বাস্থ্যবিধি মেনে মসজিদে আদায় করতে বলা হয়েছে। ঈদের নামাজ শেষে ঈদের কোলাকুলি থেকে বিরত থাকতে হবে। এমন ঈদ কি আমরা কখনো কল্পনা করতে পেরেছি? এগুলো ছিল আমাদের চিন্তার বাইরে। করোনাভাইরাস মানবজাতিকে অনেক কিছু নতুন করে ভাবতে ও করতে বাধ্য করেছে।

এবারের ঈদ শুধু বাংলাদেশই নয় বিশ্ববাসির জন্যে এক নতুন অভিজ্ঞতা। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে ঈদ উপলক্ষ্যে একস্থান থেকে অন্যস্থানে গমনাগমন নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। চেষ্টা করা হয়েছে মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করার। কিন্তু তারপরও মানুষের গমনাগমন থেমে থাকেনি। ঈদ বলে কথা! ‘আরে কিছু হবে না, কিংবা যা হবার হবে’- এই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ থাকার পরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলেছে কিছু মানুষের ঈদযাত্রা। সব বাধা পেরিয়ে যে প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদ করার জন্যে মানুষ ছুটে চলেছে সেই প্রিয়জনদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথাও তারা বিবেচনায় আনেনি অথবা গুরুত্ব দেয়নি। যদিও হাদিসে আছে, রাসুল (সা.) মহামারির সংক্রমণ রোধে আক্রান্ত অঞ্চলে যাতায়াত নিষিদ্ধ করেছেন। মুমিন ইমান ও ইখলাসের সঙ্গে ধৈর্য ধারণ করবে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘কোথাও মহামারিী দেখা দিলে এবং সেখানে তোমরা অবস্থানরত থাকলে সে জায়গা ছেড়ে চলে এসো না। আবার কোনো এলাকায় এটা দেখা দিলে এবং সেখানে তোমরা অবস্থান না করে থাকলে, সে জায়গায় গমন করো না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১০৬৫)। তবে এই করোনা মহামারির সময়ে ধর্মীয় উৎসব ঈদ উদ্যাপনের ক্ষেত্রে উল্লিখিত হাদিস কতটুকু অনুসরণ করা হলো সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
করোনার ভয়ে ভীত এবং আম্ফানের আঘাতে বিপর্যস্ত বাঙালির সব বাধা পেরিয়ে এবারের ঈদযাত্রায় সামিল হওয়া দেখে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘আমরা’ কবিতার কথা মনে করা যেতে পারে। যেখানে কবি লিখেছেন—

‘মন্বন্তরে মরিনি আমরা মারী নিয়ে ঘর করি।
বাঁচিয়া গিয়েছি বিধির আশিষে অমৃতের টীকা পরি।’

ঈদ আমাদের সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও একাত্মবোধের মাধ্যমে আনন্দ উপভোগ এবং পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা সম্প্রসারণের শিক্ষা দেয়। সমাজের গরিব অভাবী মানুষও যাতে এই মহাআনন্দে শামিল হতে পারে, সেজন্য ইসলাম নির্দেশনা দিয়েছে। ধনীর পক্ষ থেকে গরিবের প্রতি ঈদগায় যাওয়ার পূর্বেই ফিতরা ও যাকাত প্রদানের বিধান রয়েছে। সকল মানুষের সমান অধিকার এ স্লোগানের উপাদান ঈদ-উল-ফিতরে বিদ্যমান। জাতীয় কবির কাজী নজরুল ইসলামের কণ্ঠে তা বিবৃত হয়েছে এভাবে—

‘ইসলাম বলে, সকলের তরে মোরা সবাই,
সুখ-দুখ সম-ভাগ করে নেব সকলে ভাই,
নাই অধিকার সঞ্চয়ের!
কারো আঁখি-জলে কারো ঝাড়ে কি রে জ্বলিবে দীপ?
দু’জনার হবে বুলন্দ-নসীব, লাখে লাখে হবে বদ-নসীব?
এ নহে বিধান ইসলামের ॥

ঈদ-অল-ফিতর আনিয়াছে তাই নববিধান,
ওগো সঞ্চয়ী, উদ্বৃত্ত যা করিবে দান,
ক্ষুধার অন্ন হোক তোমার!
ভোগের পেয়ালা উপচায়ে পড়ে তব হাতে,
তৃষ্ণাতুরের হিসসা আছে ও-পেয়ালাতে,
দিয়া ভোগ কর, বীর দেদার ॥’
[ঈদ মোবারক, — কাজী নজরুল ইনলাম]

আজ সময় এসেছে ঈদের মূল শিক্ষা ও চেতনা উজ্জীবিত হয়ে যার যার সামর্থ অনুযায়ী দুর্গত-নিরন্ন মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর। ইতোমধ্যে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, এনজিও, রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, সামাজিক সংগঠন এবং ব্যক্তি পর্যায়ে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সচ্ছল মানুষ করোনাভাইরাসের কারণে কর্মহীন ও ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র-অসহায় মানুষকে খাদ্যসহায়তা প্রদান করে আসছে। বর্তমানে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। তাই বিপন্ন মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। তাদের জন্য দরকার বাড়তি সহায়তা। তাছাড়া দীর্ঘদিন কর্মহীন থাকায় মধ্যবিত্তও আর পেরে উঠছে না। তাদেরও সহায়তা দরকার। চাইলে আপনি আমিও সামর্থ অনুযায়ী সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে পারি। আমাদের দেশে সামর্থবান মানুষের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। সামর্থবানরা চাইলেই ঈদে উদ্যাপনে যে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল তা দিয়েই এই মহামারি চলাকালীন দুই-একটি করে পরিবারকে সহায়তা করতে পারেন। জানি অনেকেই তা করছেন। অপরের জন্যে কিছু করতে পারার মধ্যে এক ধরনের প্রশান্তি আছে। এবারের ঈদটা আমাদের জন্যে প্রশান্তির ঈদ হোক। নিরাপদ হোক।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION