মঙ্গলবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৪৭ অপরাহ্ন
ভয়েস নিউজ ডেস্ক:
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম হু-হু করে বাড়ছে। চাল, ডাল, আটা, তেল, চিনি, মাছ, মুরগি, ডিম থেকে শুরু করে শাকসবজি, তরিতরকারিসহ বহু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। একশ্রেণির ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে নিজেদের মতো করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য দিনে দিনে বাড়িয়েই চলেছে। সরকারের নানামুখী নজরদারি কিংবা কঠোর হুঁশিয়ারি কোনো প্রচেষ্টাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না নিত্যপণ্যের মূল্য। বরং প্রতিদিনই বাজারে বাড়ছে এসবের মূল্য।
ইসলাম ব্যবসায়-বাণিজ্যকে উৎসাহিত করেছে। কিন্তু খাদ্যসামগ্রী ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আটকে রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে অধিক মুনাফা অর্জনের মানসিকতাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। দুনিয়া ও আখেরাতে মজুদদারির ভয়াবহ শাস্তির কথা কোরআন মাজিদে বর্ণনা করা হয়েছে। মজুদদারি সম্পর্কে মহান আল্লাহ রাব্বুল বলেন, ‘যারা সোনা-রুপা (ধন-সম্পদ) জমা করে এবং আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না তাদের জন্য আপনি যন্ত্রণাদায়ক আজাবের সংবাদ দিন। সেদিন এসব ধন-সম্পদ আগুনে গরম করা হবে। অতঃপর তা দিয়ে তাদের কপাল, পাঁজর আর পিঠে দাগ দেওয়া হবে। (বলা হবে), তোমরা যা কিছু নিজেদের জন্য জমা করে রেখেছিলে এগুলো তো সেসব ধন-সম্পদ। সুতরাং তোমরা যা কিছু জমা করে রেখেছিলে, এখন তার স্বাদ আস্বাদন করো।’ সুরা তাওবা : ৩৪-৩৫
মজুদদারি পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে কখনো কখনো পণ্যদ্রব্যের দাম তাদের ইচ্ছামতো বাড়িয়ে দেন। এ সম্পর্কে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কেউ যদি মুসলমানদের থেকে নিজেদের খাদ্যশস্য আটকে রাখে, তবে আল্লাহতায়ালা তার ওপর মহামারি ও দারিদ্র্য চাপিয়ে দেন।’ ইবনে মাজা ও বায়হাকি
ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগতভাবে অতি মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী মজুদ করে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকে কষ্ট দেওয়া ইসলামের দৃষ্টিতে জঘন্য অপরাধ। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পণ্য মজুদ করাকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যে লোক চল্লিশ দিন খাদ্যশস্য মজুদ করে রাখল, সে আল্লাহ থেকে নিঃসম্পর্ক হয়ে গেল এবং আল্লাহও নিঃসম্পর্ক হয়ে গেলেন তার থেকে।’ মুসনাদে আহমাদ
অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য পণ্যদ্রব্য মজুদ করা থেকে বিরত থাকতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দিয়েছেন। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘অধিক মূল্যে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে খাদ্যদ্রব্য আটক করে রাখতে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন।’ যে ব্যক্তি খাদ্যদ্রব্য মজুদ করে রাখে সে চরম অপরাধী। এ প্রসঙ্গে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘অপরাধী ব্যক্তি ছাড়া কেউ পণ্য মজুদ করে রাখে না।’ সহিহ মুসলিম
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রা.) ব্যবসায়ীদের পণ্য মজুদকরণ সম্পর্কে ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমাদের বাজারে কেউ যেন পণ্য মজুদ করে না রাখে। যাদের হাতে অতিরিক্ত অর্থ আছে তারা যেন বহিরাগত ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সমস্ত খাদ্যশস্য কিনে তা মজুদ করে না রাখে। যে ব্যক্তি শীত-গ্রীষ্মের কষ্ট সহ্য করে আমাদের দেশে খাদ্যশস্য নিয়ে আসে সে উমরের মেহমান। অতএব সে তার আমদানির খাদ্যশস্য যে পরিমাণে ইচ্ছা বিক্রি করতে পারবে, আর যে পরিমাণে ইচ্ছা রেখে দিতে পারবে।’ মুয়াত্তা ইমাম মালিক
তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান (রা.) তার খেলাফতকালে পণ্য মজুদ নিষিদ্ধ করেছিলেন। চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.) মজুদদারির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। তিনি তার খেলাফাতকালে মজুদ করা খাদ্যদ্রব্য আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন।
যেহেতু মজুদদারি জনসাধারণের স্বার্থের পরিপন্থী তাই ইসলামে তা নিষিদ্ধ। বর্তমানে নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম যেভাবে লাগামহীনভাবে বেড়ে চলেছে বাজারের এ নিয়ন্ত্রণহীন আচরণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের সীমিত আয়ের গরিব মানুষ। করোনা সংকটকালে সাধারণ মানুষের জীবিকা নির্বাহ যেখানে কঠিন হয়ে পড়ছে, সেখানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আরও ভাবনায় ফেলছে। পেঁয়াজের পাশাপাশি চাল, ভোজ্য তেল ও সবজির দামও বাড়ছে, যা সীমিত আয়ের মানুষের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাই দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরতে শুধু অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙলেই চলবে না, প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য দেশে উৎপাদনেরও ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে মধ্যস্বত্বভোগীদের চিরতরে বিতাড়িত করতে হবে। তবেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য জনগণের নাগালের মধ্যে আনা সম্ভব। জনমনে স্বস্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পণ্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই।
ইসলামের দৃষ্টিতে দ্রব্যমূল্য বাজারে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চাহিদা ও জোগানের আলোকে নির্ধারিত হবে। তবে বাজার-প্রক্রিয়াকে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যেন ব্যাহত করতে না পারে, সেজন্য সরকার তদারকির ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে পারবে। ইসলামি আইনবিদদের মতে, সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও নির্ধারণে হস্তক্ষেপ করতে পারবে। সরকার কর্র্তৃক ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ-প্রক্রিয়াকে আরবিতে ‘তাসয়ির’ বলা হয়। এ ক্ষেত্রে ভোক্তা ও উৎপাদক কোনো শ্রেণিরই ক্ষতি করা যাবে না, উভয় শ্রেণির স্বার্থ সংরক্ষণ করতে হবে। ইসলামের এ ব্যবস্থা থেকে ধারণা নিয়ে সরকার পাইকারি ও খুচরা বাজারে দ্রব্যমূল্যের তালিকা ঝোলানো বাধ্যতামূলক করতে পারে।
ভয়েস/আআ