মঙ্গলবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৩৭ অপরাহ্ন
মাওলানা ওয়ালী উল্লাহ:
কোরআনে কারিমে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তুমি একনিষ্ঠভাবে নিজেকে দ্বীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত করো। আল্লাহর (প্রদত্ত) প্রকৃতির অনুসরণ করো, যে প্রকৃতি অনুযায়ী তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন, আল্লাহর সৃষ্টির কোনো পরিবর্তন নেই। এটা সহজ-সরল দ্বীন, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না। বিশুদ্ধ চিত্তে তার অভিমুখী হয়ে তারই তাকওয়া অবলম্বন করো, তোমরা নামাজ প্রতিষ্ঠা করো এবং মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।’ সুরা আর রুম : ৩০-৩১
বর্ণিত আয়াতে আল্লাহর সৃষ্টি তথা প্রকৃতি বলে ইসলাম ও তাওহিদকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ মানুষকে দ্বীনে ইসলামের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, যে দ্বীন মানুষের প্রকৃতিগত, সেটাই হচ্ছে সরল ও সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীন। আর মহান আল্লাহ সৃষ্টিগতভাবে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে স্রষ্টাকে চেনার ও তাকে মেনে চলার যোগ্যতা নিহিত রেখেছেন। এর ফলে মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে যদি সে যোগ্যতাকে কাজে লাগায়।
কিন্তু মানুষ তার সংকীর্ণ বিবেক ও কু-প্রবৃত্তির কারণে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করে, বিভ্রান্ত হয়ে নানা পথ ও পন্থা অবলম্বন করে। যা কখনো কাম্য নয়। মনে রাখতে হবে, আল্লাহ মানুষকে বুদ্ধি-বিবেক দিয়েছেন; সেটাকে কাজে লাগাতে হবে। যে ধর্মের বিষয়ে আল্লাহ-রাসুলের বিধানের বিপরীতে নিজের মর্জিকে প্রাধান্য দেবে, সে সঠিক রাস্তা থেকে সরে যাবে। আল্লাহতায়ালা এমন কিছু গুণাবলি নির্ধারণ করেছেন, যেগুলোর মাধ্যমে প্রকৃত মুমিন-মুসলমানকে সহজেই অন্যদের থেকে পৃথক করা যায়। এসব গুণাবলি অন্যতম হলো
আকিদা ও বিশ্বাসে দৃঢ়তা : মুসলিম সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে রব, ইসলামকে দ্বীন ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নবী ও রাসুল হিসেবে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসসহ অন্য শর্তগুলো মেনে চলে। ইমানের ভিত্তির ওপর জীবন পরিচালিত করে, যা তাকে আচার-ব্যবহার, চলাফেরা, উদ্দেশ্য-লক্ষ্য ও লেনদেন সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেয়। ইসলামের বিধানমতে প্রতিষ্ঠিত হয় তার জীবন-জীবিকা ও সময়। নির্ধারিত হয় তার দৃষ্টিভঙ্গি, কাজকর্ম। যাতে কোনো প্রকার পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও বিভ্রান্তি নেই। ইসলাম এ বিষয়টির ওপর বিশেষ জোর দিয়েছে; কেননা জীবনে মানুষের চলার সূচনা কী হবে সেটা একমাত্র ইসলামই নির্ধারণ করতে পারে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সুতরাং তুমি জেনে রাখো, আল্লাহ ছাড়া (প্রকৃত) কোনো মাবুদ নেই, ক্ষমা প্রার্থনা করো তোমার এবং মুমিন নর-নারীদের ত্রুটির জন্য।’ সুরা মুহাম্মদ : ১৯
ইবাদতে সংকল্প : আল্লাহতায়ালার ইবাদত-বন্দেগি করাই হলো মুসলমানের জীবনের লক্ষ্য। তাই তাদের কাজকর্মগুলো পরিচালিত হয় নীতিবদ্ধতা, শৃঙ্খলা ও ভারসাম্যের ওপর। মুমিন ইবাদত-বন্দেগির প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ, যাতে জীবনের সবদিক অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমার ইবাদত করার জন্যই আমি মানব ও জিন জাতি সৃষ্টি করেছি।’ সুরা আয যারিয়াত : ৫৬
এর ওপর ভিত্তি করে একজিন মুসলিম একনিষ্ঠভাবে মহান আল্লাহর ইবাদত করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদের এছাড়া কোনো নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে।’ সুরা বাইয়্যেনা : ৫
তবে মুমিন-মুসলমানদের ইবাদত-বন্দেগিতে হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ-অনুকরণ থাকতে হবে। যেমন হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এমন আমল করল, যাতে আমার কোনো নির্দেশ নেই তা প্রত্যাখ্যাত।’ সহিহ্ মুসলিম : ৩২৪৩
উত্তম চরিত্রের অধিকারী : একজন মুমিন ব্যক্তির গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো উত্তম আখলাক ও সুন্দর ব্যবহার। এ ক্ষেত্রে একমাত্র অনুসরণ করবে প্রথম আদর্শ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের। যার প্রশংসা করেছেন স্বয়ং আল্লাহ। তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় আপনি উত্তম চরিত্রের অধিকারী।’ সুরা আল কলম : ৪
হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-কে নবী কারিম (সা.)-এর চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘কোরআনই ছিল তার (নবীর) চরিত্র।’ মুসনাদে আহমদ : ২৩৪৬০
মনে রাখতে হবে, ইসলাম ইবাদতের সঙ্গে আখলাককে মিলিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ একজন প্রকৃত ইবাদতকারীকে ইবাদতের মাধ্যমে তার চরিত্র সংশোধন করে নিতে হবে, সেই সঙ্গে উত্তম ব্যবহারের অধিকারী হতে হবে।
জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী : প্রকৃত মুসলিম ইলম ও প্রজ্ঞার অধিকারী হবেন এবং এর ওপর জীবন অতিবাহিত করবেন। তিনি অন্যদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করবেন যেমন ব্যবহার অন্যদের থেকে আশা করেন। অন্যদের ভালোবাসবেন, তাদের কল্যাণ কামনা করবেন, তাদের জন্য কল্যাণের দোয়ার পাশাপাশি এমন কাজের প্রতি আহ্বান করবেন যা তাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণ বয়ে আনে।
মুসলিম কখনো স্বার্থপর হবে না, সে শুধু নিজের কল্যাণ কামনা করবে না। অন্যের নেয়ামত কুক্ষিগত করবে না, কখনো অন্যের অমঙ্গল কামনা করবে না। হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার দাওয়াতের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে একজন প্রকৃত মুসলিম মানুষকে হেদায়েত ও দিকনির্দেশনা দেবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি। তোমাদের মানুষের কল্যাণের জন্য বের করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজে বাধা প্রদান করবে। আর আল্লাহর ওপর ইমান রাখবে।’ সুরা আলে ইমরান : ১১০
আল্লাহতায়ালা ভালো কাজের উৎসাহ প্রদানে বলেন, ‘ওই ব্যক্তির চেয়ে উত্তম কথা আর কার হতে পারে, যে মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করে এবং নিজেও নেকআমল করে, আর বলে আমি মুসলিমদের একজন।’ সুরা ফুসসিলাত : ৩৩
উপরোক্ত গুণাবলির অর্জিত হলে, সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা পাবে। অধিকার হরণের ঘটনা কমে যাবে। অর্থাৎ মানুষের মধ্যে মানসিক শান্তি নেমে আসবে। আমরা জানি, অন্তরের প্রশান্তি ও অস্থিরতার ফলে পার্থিব জীবনে মানুষ সুখ-দুঃখের সম্মুখীন হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা মুমিন এবং যাদের অন্তর আল্লাহর জিকিরে প্রশান্তি লাভ করে। শোনো, আল্লাহর জিকিরেই অন্তরসমূহ প্রশান্তি লাভ করে থাকে।’ সুরা রাদ : ২৮
এর ফলে আল্লাহর পথে চলার মাধ্যমে নিরাপত্তা ও স্থিরতা অর্জিত হয়। এরই মাধ্যমে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়। আর বিপরীত পথে উল্টো ক্ষতি হয়।
ভয়েস/আআ