রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৪২ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

প্রচলিত ইসলামি বীমা প্রশ্নমুক্ত রাখতে করণীয়

মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
দেশে চলমান বীমা ব্যবস্থায় আলাদা শরিয়া কোনো আইন নেই। তবু নামের আগে ইসলামি যোগ করে অবাধে চলছে ব্যবসা। নতুন আইনের একটি খসড়া হলেও তা অনুমোদন হয়নি। আর ধর্মের ব্যবহারে বীমা ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় শরিয়া উইংয়ের প্রতি দেশি-বিদেশি বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রহ দিন দিন বেড়ে চলেছে। ইসলামি চিন্তাবিদ ও বীমা বিশ্লেষকদের মতে, এ দেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী মুসলিম এবং তারা ধর্মপ্রাণ। এটাকে পুঁজি করে ব্যবসারত কতিপয় বীমা কোম্পানি ইসলামি শরিয়া নামে বীমা গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করছে। শরিয়া বীমার নামে একদিকে যেমন মুনাফা কম দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। অন্যদিকে নানা ফাঁকফোকর দিয়ে সুকৌশলে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এমতাবস্থায় প্রশ্নের মুখে ইসলামি বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো।

তাহলে কীভাবে চলছে ইসলামি বীমা ব্যবসা? উত্তর, কিছুটা পৃথক নিয়মকানুন আছে। আর প্রত্যেক কোম্পানির নিজস্ব শরিয়া বোর্ড রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বোর্ডগুলো শরিয়া আইন মানার পরিবর্তে কোম্পানির স্বার্থকেই বেশি প্রাধান্য দেয়।

বাংলাদেশে ১৯৯৯ সাল থেকে প্রথমবার ইসলামি বীমার কার্যক্রম শুরু হয়। বাংলাদেশে পূর্ণ ও উইন্ডোসহ মোট বীমা কোম্পানির সংখ্যা ৭৬। তার মধ্যে ইসলামি বীমার সংখ্যা ২৬টি। তিনটি নন-লাইফ পূর্ণাঙ্গ ইসলামি বীমা কোম্পানি, আটটি লাইফ পূর্ণাঙ্গ ইসলামি বীমা কোম্পানি ও ১৫টি লাইফ ইসলামি বীমা উইং ইসলামি বীমা ব্যবসা পরিচালনা করছে। দিন দিন সংখ্যার বিচারে ইসলামি বীমা শিল্প বাংলাদেশে বেশ অগ্রসর ও উৎসাহব্যঞ্জক। বাংলাদেশে ইসলামি বীমার অগ্রযাত্রা আশাজাগানিয়া হলেও ইসলামি বীমা কোম্পানিগুলোর শরিয়া পরিপালনের বিষয়টি দুশ্চিন্তার কারণ। কারণ কোম্পানিগুলোর শরিয়া গুণগত মানে কতটুকু অগ্রসর হচ্ছে, তার কোনো ডকুমেন্ট খুঁজে পাওয়া যায় না। অনুসন্ধানে বরং ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। ইসলামি বীমার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক শরিয়া কোনো স্ট্যান্ডার্ড ও গভর্ন্যান্সও অনুসৃত হয় না। আমরা মনে করি, শরিয়া সম্পর্কে আলোচনা-পর্যালোচনা শরিয়া প্রতিপালনের ক্ষেত্রে ইসলামি বীমা কোম্পানিগুলোর কিছুটা হলেও সহায়ক হবে।

বাংলাদেশে বীমা প্রতিষ্ঠা, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন আছে। ১৯৩৮ সালের বীমা আইন, ১৯৫৮ সালের বীমা বিধিমালা ও ১৯৭৩ সালের বীমা করপোরেশন আইন দ্বারা বীমা ব্যবসা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু এর একটিও ইসলামি বীমার জন্য করা হয়নি। ইসলামি বীমার অনেক নীতি ও পদ্ধতি এসব আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

২০১০ সালের ১৮ মার্চে একটি গেজেটের মাধ্যমে ইসলামি বীমা ব্যবসাকে শুধু অনুমোদন দেওয়া হয়। এর আগ পর্যন্ত ১০ বছরের মতো কেবল মন্ত্রিসভার অনুমোদনে ইসলামি বীমা ব্যবসা পরিচালিত হয়েছে। আর নিবন্ধিত হতো ইন্স্যুরেন্স অ্যাক্ট, ১৯৩৮-এর অধীনে। ওই গেজেটে ইসলামি বীমা ব্যবসার কেবল অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তাতে বিস্তারিত কোনো নির্দেশনা নেই। অথচ ইসলামি বীমাকে বাস্তব অর্থে ইসলামিকরণের জন্য স্বতন্ত্র আইনের বিশদ রূপরেখা ছাড়া সম্ভব নয়। যদি তা না হয় তাহলে দুটি সমস্যা অনিবার্যভাবে দেখা দেবে। যথা- ক. পুরোপুরি ইসলামিকরণ সম্ভব হবে না। পদে পদে শরিয়া বাস্তবায়নে বাধার সম্মুখীন হবে। বর্তমানে হচ্ছেও তা-ই। খ. ইসলামের নামে সরলমনা মুসলিম জনগোষ্ঠী প্রতারণার শিকার হবে। দুঃখজনক হলেও বাংলাদেশে তাই হচ্ছে।

এ দেশে ইসলামি বীমা প্রতিষ্ঠার প্রায় দেড় যুগ পরও স্বতন্ত্র ‘ইসলামি বীমা আইন’ তৈরি হয়নি। এটি শুধু বাংলাদেশের ইসলামি বীমার চিত্র নয়; এ দেশে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের চিত্রও। সব চলে সুদি ও জেনারেল আইনের আওতায়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে এটি খুবই দুঃখজনক। বিশেষজ্ঞরা শুরু থেকেই বলছেন, ইসলামি বীমা পরিচালনার আগে এটি নিশ্চিত করা জরুরি, সেটা কোন মডেলে পরিচালিত হবে, তাবররু না ওয়াকফ মডেলে। দুটি মডেলের রূপরেখা স্বতন্ত্র। দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের দেশে ইসলামি বীমা শিল্পে শরিয়ার উন্নতি না হওয়ার একটি বড় কারণ হলো, ইসলামি বীমার শরিয়াসম্মত কোনো রূপরেখা আমাদের দেশে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের মতো সুস্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। বাংলায় মৌলিক এমন একটি বই পাওয়া যায় না, যাতে বাংলাদেশে প্রচলিত ইসলামি বীমার শরিয়াসম্মত রূপরেখা নিয়ে থিওরিক্যাল ও প্র্যাকটিক্যাল আলোচনা করা হয়েছে। এমনকি সরেজমিনে ইসলামি বীমার বিভিন্ন ব্রাঞ্চে ভিজিট করে এবং ব্রাঞ্চ প্রধানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের অনেকে ইসলামি বীমার কোনো মডেল আছে বলেও জানেন না। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামি বীমার রূপরেখা ও মডেল নিয়ে প্রাজ্ঞ মুফতি ও অর্থনীতিবিদদের সমন্বয়ে সিদ্ধান্তকৃত ইসলামি বীমার মডেলের বিস্তারিত রূপরেখা প্রণয়ন জরুরি।

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের ২০১৭-১৮ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী শুধু লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর এজেন্টের সংখ্যা (২০১৭ সালে) ৩ লাখ ৮১ হাজার ৮৩৯ জন এবং এমপ্লয়ারের সংখ্যা ২ লাখ ৯ হাজার ৮২৪ জন। আর বীমার আওতাভুক্ত জনসংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখ এবং ৪৯২টি উপজেলায় ৩২টি লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মোট অফিস রয়েছে ৬ হাজার ৫৫১টি। যেগুলোর মাধ্যমে সব নাগরিককে বীমার আওতাভুক্ত করার কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্য থেকে ইসলামি বীমা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জনবল সংখ্যা আলাদা করে বলা না হলেও তার একটি ধারণা পাওয়া যায়। অথচ এই বিশাল জনবলকে ইসলামি বীমা সম্পর্কে প্রশিক্ষিত করার কোনো উদ্যোগ কিংবা পরিকল্পনা দেখা যায় না।

ইসলামি বীমা শিল্পকে বাস্তব অর্থে ইসলামিকরণ করতে হলে ‘ইসলামিক ম্যান পাওয়ার’-এর বিকল্প নেই। দক্ষ জনবল ছাড়া কোনো কার্যই সিদ্ধ হয় না। এটি স্বীকার করতেই হবে, ইসলামি বীমা ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য বর্তমানে এ দেশে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও অভিজ্ঞ জনশক্তি নেই। এ জন্য ইসলামি বীমা শিল্পের স্বার্থে ইসলামিক ম্যান পাওয়ার ডেভেলপের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে অন্যদের পাশাপাশি গুণগত মানসম্পন্ন ফতোয়া বিভাগ থেকে পাস করা তরুণ আলেম ও মুফতিদের কাজে লাগানো যেতে পারে। কারণ তারা শরিয়াকে যতটা গভীরভাবে বুঝবেন এবং এর প্রতি আন্তরিক হবেন, স্বভাবতই সেটা অন্যদের থেকে আশা করা যায় না।

এক কথায়, বীমাকে ইসলামিকরণের জন্য মজবুত শরিয়া কাউন্সিল অবশ্যক। সাধারণ মুসলিমরা বীমাপত্রের গুণাগুণ পরীক্ষা না করে, ইসলামি বীমা কোম্পানির সঙ্গে আস্থাভাজন আলেমদের সংশ্লিষ্টতা দেখেই পলিসি গ্রহণ করেন। অথচ দুঃখজনকভাবে এ দেশে প্রচলিত ইসলামি বীমাগুলোর শরিয়া পর্যবেক্ষণ খুবই দুর্বল। তাই ইসলামি বীমা শিল্পকে শরিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে গুণগত মানে আরও অগ্রসর করতে হলে মজবুত শরিয়া তত্ত্বাবধানের কোনো বিকল্প নেই। তাই দেশের মূলধারার আলেমদের সঙ্গে মতবিনিময় এবং তাদের গঠনমূলক সমালোচনা ও পরামর্শকে গুরুত্ব দেওয়া। শরিয়া বোর্ডকে সুপারভাইজরি বোর্ডে উন্নীত করা। শরিয়া বিষয়ে তাদের পূর্ণক্ষমতা প্রদান করা। তাদের শরিয়াবিষয়ক সিদ্ধান্তকে বোর্ড অব ডিরেক্টরের সিদ্ধান্তের সমমর্যাদা প্রদান করা।

লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION