রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:০০ অপরাহ্ন
মো. মিকাইল আহমেদ:
ফরজ নামাজ আদায় না করা মারাত্মক অপরাধের শামিল। আগের নবীদের যুগেও নামাজের বিধান ছিল যদিও পদ্ধতিগতভাবে পার্থক্য ছিলো। কিন্তু তাঁদের পরবর্তী লোকেরা নামাজের ব্যাপারে অবহেলা করে অার নামাজে অবহেলার পরিণতি হলো জাহান্নাম। আল্লাহ তাআলা কুরঅানে বলেন, ‘নবী ও হিদায়াতপ্রাপ্তদের পর এলো এমন এক অপদার্থ বংশধর, যারা নামাজ বিনষ্ট করল এবং প্রবৃত্তির পূজারি হলো। সুতরাং তারা ‘গাই’ নামক জাহান্নামের শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে। তবে যারা এরপর তাওবা করে নিয়েছে, ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে তারাই তো জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি কোনো ধরনের জুলুম করা হবে না।’ (মারইয়াম, আয়াত : ৫৯-৬০)
নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ অাদায় করা কত গুরুত্বপূর্ণ তা অামরা অনেকেই অনুধাবন করিনা। নামাজ না পড়লে পরকালে কি কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে অামাদের অনেকেরই হয়তো জানা নেই। শুধুই কি পরকালের শাস্তি? ইহকালেও তো রয়েছে নামাজে অবহেলার করার ভয়াবহ অাযাব। ইহকালেও বহু ক্ষতি সাধিত হয় নামাজ না পড়লে। বুরাইদা (রা.) বলেন, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু অালাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি আসরের নামাজ পরিত্যাগ করল তার সব আমল বরবাদ হয়ে গেল।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৫৩, ৫৯৪)
অপর এক হাদিসে এসেছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সাল্লাল্লাহু অালাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তির আসরের নামাজ ছুটে গেল তার পরিবারবর্গ ও ধন-সম্পদের যেন বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৫২; মুসলিম, হাদিস : ৬২৬)
নামাজ না পড়ার দরুন এমনকি কাফির হয়ে যাবার কথাও বলা হয়েছে। রাসুল (সাল্লাল্লাহু অালাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেন, ‘কোনো ব্যক্তি এবং কুফর ও শিরকের মধ্যে ব্যবধান শুধু নামাজ না পড়ারই। যে নামাজ ছেড়ে দিল সে কাফির হয়ে গেল (কাফিরের মতো কাজ করল)।’ (মুসলিম, হাদিস : ৮২; তিরমিজি, হাদিস : ২৬১৯)
কুরঅানুল কারীমের এক আয়াতে এসেছে, কিয়ামতের দিন জাহান্নামীদের জিজ্ঞাসা করা হবে—‘কেন তোমরা সাকার নামক জাহান্নামে এলে? তারা বলবে, আমরা তো নামাজি ছিলাম না এবং আমরা মিসকিনদেরও খাবার দিতাম না; বরং আমরা সমালোচনাকারীদের সঙ্গে সমালোচনায় নিমগ্ন থাকতাম। এমনকি আমরা প্রতিদান দিবসকে অস্বীকার করতাম। আর এভাবেই হঠাৎ আমাদের মৃত্যু এসে গেল।’ (সুরা মুদ্দাসসির, আয়াত : ৩৮-৪৭)
মহান আল্লাহ ওই ব্যক্তির ওপর থেকে তাঁর জিম্মাদারি বা রক্ষণাবেক্ষণ তুলে নেন যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ফরজ নামাজ ছেড়ে দেয়। মুআজ (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) আমাকে দশটি নসিহত করেন, তার মধ্যে বিশেষ একটি এটাও যে তুমি ইচ্ছাকৃত ফরজ নামাজ ত্যাগ করো না। কারণ যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত ফরজ নামাজ ত্যাগ করল তার ওপর আল্লাহ তাআলার কোনো জিম্মাদারি থাকল না।’ (মুসনাদ আহমাদ : ৫/২৩৮)
নিয়মিত নামাজ পড়া মুসলিমদের একটি বাহ্যিক নিদর্শন। তাই হযরত উমর (রা.) বলতেন, ‘নামাজ ত্যাগকারী নির্ঘাত কাফির।’ (বায়হাকি, হাদিস : ১৫৫৯, ৬২৯১) হযরত আলি (রা.) বলেন, ‘যে নামাজ পড়ে না সে কাফির।’ (বায়হাকি, হাদিস : ৬২৯১) হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) বলেন, ‘যে নামাজ পড়ে না সে মুসলমান নয়।’ (বায়হাকি, হাদিস : ৬২৯১)
অর্থাৎ এ কথা প্রতীয়মান হয় যে নামাজ পরিত্যাগ করা কাফিরদের কাজ। যে মুসলমান হয়েও নামাজ পড়ল না সে যেন কাফিরের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ কাজ করল।
মানুষের দ্বারা যেসব গোনাহ সংঘটিত হয় তা দুইভাগে বিভক্ত যার কিছু কবিরা গোনাহ বা বড় গোনাহ আর কিছু সগিরা গোনাহ বা ছোট গোনাহ। অামাদের মধ্যে অনেকে অাছে যারা এসব গোনাহ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নেই। তাই নিজের অজান্তেও মানুষ কখনো কখনো বড় বড় গোনাহ করে বসে।
অনেক বড় বড় গোনাহের কথা আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে উল্লেখ করেছেন যা মানুষের অন্তরের সঙ্গে সম্পর্কিত। আর তা হলো কুফর বা আল্লাহকে অস্বীকার করা; শিরক বা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার স্থাপন করা; অংহকার করা বা মুনাফেকি করা; রিয়া বা লোক দেখানো ইবাদাত করা; জাদু করা বা কোন কিছুকে অশুভ লক্ষণ হিসেবে বিশ্বাসকরা।
উল্লেখিত কাজগুলো অনেক বড় গোনাহ যা থেকে প্রত্যেককে বিরত থাকা জরুরি। এ বিষয়গুলো সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো কুফর করা, শুধু আল্লাহকে অবিশ্বাসই কুফর নয়, বরং কুরআনুল কারিমে উঠে এসেছে অনেকগুলো বিষয় যেগুলোকে অস্বীকার করার মাধ্যমে কুফর সংঘটিত হয়। কুফুরি করলে মানুষ যেমন ঈমানহারা হয় তেমনি এটা গোনাহের তালিকায় কবিরাহ বা বড় গোনাহ হিসেবে গণ্য।
কুরআনুল কারিমের তাদের ব্যাপারে কঠোর শাস্তির কথা ঘোষণা করা হয়েছে যারা কুফর করে বা আল্লাহকে অস্বীকার করে। কুফর সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কুরঅানে একাধিক আয়াতে ঘোষণা করেন, ‘নিশ্চয় যারা কুফরি করে এবং কাফের অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করে, সে সব লোকের প্রতি আল্লাহর অভিশাপ, ফেরেশতাদের অভিশাপ এবং সব মানুষের অভিশাপ। এরা চিরকাল এ অভিশাপের মাঝেই থাকবে। তাদের উপর থেকে আজাব কখনও হালকা করা হবে না বরং এরা বিরামও পাবে না।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৬১-১৬২)
অন্য এক অায়াতে এরশাদ হয়েছে, ‘যার উপর জবরদস্তি করা হয় এবং তার অন্তর বিশ্বাসে অটল থাকে সে ব্যতিত যে কেউ বিশ্বাসী হওয়ার পর আল্লাহতে অবিশ্বাসী হয় এবং কুফরীর জন্য মন উম্মুক্ত করে দেয় তাদের উপর আপতিত হবে আল্লাহর গজব এবং তাদের জন্যে রয়েছে শাস্তি।’ (সুরা নাহল : আয়াত ১০৬)
অাল্লাহ তাঅালা বলছেন, ‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন কর এবং বিশ্বাস স্থাপন কর তাঁর রাসুল ও তাঁর কিতাবের উপর, যা তিনি নাজিল করেছেন স্বীয় রাসুলের উপর এবং সেসমস্ত কিতাবের উপর, যেগুলো নাজিল করা হয়েছিল ইতিপূর্বে। যে আল্লাহর উপর, তাঁর ফেরেশতাদের উপর, তাঁর কিতাব সমূহের উপর এবং রসূলগণের উপর ও কিয়ামতদিনের উপর বিশ্বাস করবে না, সে পথভ্রষ্ট হয়ে বহু দূরে গিয়ে পড়বে।’ (সুরা নিসা : আয়াত ১৩৬)
কুফুরি যারা করে তাদের জন্য অপমানজনক শাস্তির কথা উল্লেখ করে অাল্লাহ বলছেন, ‘যারা আল্লাহ ও তার রাসুলকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি বিশ্বাসে তারতম্য করতে চায় আর বলে যে, আমরা কিছু বিষয় বিশ্বাস করি এবং কিছু বিষয় অস্বীকার করি আর এরই মধ্যবর্তী কোনো পথ অবলম্বন করতে চায়। প্রকৃতপক্ষে এরাই সত্য প্রত্যাখ্যাকারী। আর যারা সত্য প্রত্যাখ্যানকারী (আল্লাহ বলেন) তাদের জন্য তৈরি করে রেখেছি অপমানজনক আজাব।’ (সুরা নিসা : আয়াত ১৫০-১৫১)
আল্লাহকে অবিশ্বাস করা কুফর ও কবিরা গোনাহ। কুফরের মতো জঘন্য গোনাহকারীদের জন্য রয়েছে সবচেয়ে বড় যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি এমনকি যারা কুফর করে তাদের ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্তুতিও হাশরের ময়দানে আল্লাহর সামনে কোনো কাজে আসবে না। অার তারা হবে জাহান্নামি। আল্লাহ তাআলা কুরঅানের সূরা অাল ইমরানে বলেন, ‘যারা কুফরি করে, তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি আল্লাহর সামনে কখনও কোনো কাজে আসবে না। আর তারাই হচ্ছে দোযখের ইন্ধন।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১০)
যাদের ইহকালের সব অর্জন দুনিয়াতেই বিনষ্ট হয়ে যায় এমন লোকদের প্রসঙ্গে অাল্লাহ তাঅালা বলেন, ‘যারা আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে অস্বীকার করে এবং অন্যায়ভাবে পয়গম্বরগণকে হত্যা করে আর সেসব লোককে হত্যা করে যারা ন্যায়পরায়ণতার নির্দেশ দেয় তাদেরকে বেদনাদায়ক শাস্তির সংবাদ দিন। এরাই হলো সেসব লোক যাদের সব আমল দুনিয়া ও আখেরাত দুটিই বিনষ্ট হয়ে গেছে। পক্ষান্তরে তাদের কোনো সাহায্যকারীও নেই।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ২১-২২)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহসহ বনি আদমকে কুরআনে বর্ণিত যাবতীয় কুফর থেকে ও ভয়াবহ শাস্তি থেকে হেফাজত করুন। অামাদের সকলকে পরিপূর্ণ ঈমানদার হিসেবে কবুল করুন। আমিন।
লেখক: মো. মিকাইল আহমেদ, শিক্ষার্থী, আইসিএমএবি, ঢাকা।
ইমেইল: mekailahmed117@gmail.com