রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:৫৮ অপরাহ্ন
মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ঋণ দেওয়ার পর তার ওপর একটি নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে অতিরিক্ত কিছু অর্থ আদায় করলে এ অতিরিক্ত অর্থকে ইসলামে সুদ বলে। তদ্রƒপ একই জাতীয় সামগ্রী কিংবা দ্রব্য কম পরিমাণের বিনিময়ে বেশি পরিমাণ নিলে এ বেশিটুকু সুদ। অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে কাউকে অর্থ বা পণ্য ধার দেওয়ার পর তার মধ্যে অতিরিক্ত কিছু দাবি করা কিংবা আদায় করা হলে অতিরিক্ত অর্থ বা পণ্যকে সুদ বলা হয়। এটা আর্থিক সুদ, যা ইসলামে নিষিদ্ধ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা সুদ খায় তাদের অবস্থা হয় ঠিক সেই লোকটির মতো যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল করে দিয়েছে। তাদের এ অবস্থায় উপনীত হওয়ার কারণ হচ্ছে এই যে, তারা বলে- ব্যবসা তো সুদের মতোই। অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করে দিয়েছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।’ -সুরা বাকারা : ২৭৫
আর্থিক সুদের অপকারিতা, ভয়াবহতা এবং ইসলামে এর বিধান প্রসঙ্গে প্রায় সবাই কমবেশি অবগত হলেও, অনেকেই অনার্থিক সুদ সম্পর্কে জানেন না। ফলে এ জাতীয় সুদ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারছেন না। অনার্থিক সুদ শব্দটি নতুন মনে হলেও এই প্রকার সুদের প্রসার সমাজে দিন দিন বাড়ছে। এর ভয়াবহতা সম্পর্কে আলোচনা না থাকায় মানুষ এটা থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারছে না।
নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ঋণ দেওয়ার পর, কোনো খাতে দান করার পর- এর বিনিময়ে সুনাম-সুখ্যাতি লাভ, অতিরিক্ত সম্মান এবং ভবিষ্যৎ কোনো স্বার্থ লাভের আশা করা হলে তা অতিরিক্ত কিছু অর্থ বা পণ্য আদায় করার মতোই অনার্থিক সুদ হিসেবে গণ্য হবে। এ জাতীয় সুদে পকেট ভারী হয় না, তবে পকেট ভারী হওয়ায় উপকরণ জোগায়। যেটাকে ব্যবহার করে আরও নানাবিধ সুবিধা হাসিলের সুযোগ ঘটে। এটাকেই অনার্থিক সুদ হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। এটিও ইসলাম নিষিদ্ধ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘(আর আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন না) যারা শুধু লোক দেখানোর উদ্দেশে স্বীয় ধনসম্পদ ব্যয় করে থাকে আর আল্লাহ এবং পরকালের প্রতি ইমান রাখে না। শয়তান তাদের সাথী, তার ভাগ্যে খুব বড় দুষ্ট বন্ধুই মিলেছে।’ -সুরা নিসা : ৩৮
একজন মুসলমানকে দানশীল, উদার হৃদয়, সহানুভূতিশীল ও মানবদরদি হতে হবে। স্বার্থসিদ্ধির প্রবণতা পরিহার করে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে প্রতিটি সৎকাজে, ইসলাম ও সমাজের বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণের জন্য ব্যয় করতে হবে। এটাই ইসলামের চাওয়া। সেখানে দান কিংবা ঋণের পেছনে যদি কোনো উদ্দেশ্য থাকে, সেটা বর্জনীয়।
ইসলাম ব্যক্তিগত প্রয়োজনে পরস্পরকে নিঃস্বার্থভাবে ঋণ দেওয়াকে অপরিহার্য কর্তব্যরূপে চিহ্নিত করে। এ ধরনের কর্তব্যবোধ সমাজের সম্প্রীতি ও সুস্থতার পরিচায়ক। যদি কোনো সমাজে এর অনুপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়, তবে বুঝতে হবে সেখানকার পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে, সেখানকার অধিবাসীদের বিশ্বাস ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিক ইবাদতগুলোর মধ্যে শিথিলতা দেখা দিয়েছে। ইসলামের শিক্ষা হলো, আর্থিক হোক বা অনার্থিক হোক উভয় অবস্থায় অতিরিক্ত কোনো কিছুর দাবি (প্রতিদান, সওয়াব লাভের প্রত্যাশা) একমাত্র আল্লাহর কাছে চাইতে হবে। আল্লাহকে ছাড়া অন্য কারও কাছ থেকে কোনোরূপ প্রতিফল পাওয়ার কিংবা অন্য কারও সন্তোষ লাভের কোনো ইচ্ছা কোনো মুমিন করতে পারে না। এরূপ ঋণ প্রসঙ্গে আল্লাহর দু’টি ওয়াদা রয়েছে। এক. তিনি এটি কয়েকগুণ বেশি করে ফিরিয়ে দেবেন। দুই. তিনি সে জন্য নিজের পক্ষ থেকে অতীব উত্তম প্রতিফল দান করবেন। যেমন কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘এমন কে আছে যে আল্লাহতায়ালাকে ঋণ দেবে, উত্তম ঋণ? যেন আল্লাহ এটি কয়েকগুণ বৃদ্ধি করে ফিরিয়ে দিতে পারেন এবং তার জন্য অতীব উত্তম সওয়াব রয়েছে।’ -সুরা আল হাদিদ : ১১
কল্যাণকর উত্তম ঋণকে সমাজের সুবিধাভোগীরাই এর সঙ্গে অতিরিক্ত কিছু যোগ করে অকল্যাণ ও হারাম ঋণে পরিণত করেছে। প্রচলিত ব্যাংকগুলো এ অতিরিক্ত অংশকে সুদ বলে। এ ঋণ তখনই উত্তম ঋণে পরিণত হবে, যখন একনিষ্ঠ নিয়তে কোনোরূপ ব্যক্তিগত স্বার্থ ছাড়া হোক তা আর্থিক স্বার্থ বা অনার্থিক স্বার্থ একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তে দেওয়া হবে। যাতে কোনোরূপ অতিরিক্ত আর্থিক স্বার্থ কিংবা অনার্থিক স্বার্থ তথা কোনো প্রকার সুনাম-সুখ্যাতি অর্জনের উদ্দেশ্য থাকবে না। এটি দিয়ে কারও ওপর অনুগ্রহ দেখানো হবে না বা যাবে না। অন্য কারও কাছে প্রকাশ করে নিজের দানশীলতার কথাও প্রকাশ করা যাবে না।
আর্থিক অনার্থিক উভয় প্রকারের সুদই ক্ষতিকর, নিষিদ্ধ এবং বর্জনীয়। মুসলমানরা যেখানে একাধারে নৈতিক, কল্যাণকামী এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন পরস্পরের বন্ধু। সেখানে সুদ মানুষের বিবেককে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে যে, ক্রমান্বয়ে স্বার্থপরতা, লোভ ও কৃপণতা ব্যক্তির চরিত্রে বিকাশ লাভ করেছে। ফলে সমাজ থেকে কল্যাণ ও ভ্রাতৃত্ববোধ হারিয়ে যাচ্ছে। ইসলামি সমাজ ব্যবস্থায় সম্পদ বণ্টন এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য সৃষ্টিতে সুদ বিরাট প্রতিবন্ধক। সমাজের নিম্ন আয়ের লোকদের সামান্য সম্পদ সুদের মাধ্যমে গুটিকয়েক লোকের কাছে জমা হয়। অথচ ইসলামি সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তির সম্পদে সমাজের অধিকার স্বীকৃত। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তাদের ধনসম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।’ -সুরা জারিয়া : ১৯
কিন্তু সুদি সমাজে সম্পদের একচ্ছত্র মালিক ব্যক্তি নিজে। এতে অন্যের কোনো হক নেই। যেই সুদ প্রচলন রয়েছে সেখানে আয়-ব্যয়ে হালাল-হারামের কোনো পার্থক্য করা হয় না। ইসলামে একমাত্র হালাল পদ্ধতিতে অর্থ উপার্জন করতে হবে এবং হালাল ও বৈধপন্থায় ভোগ ও বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। জাতীয় সামষ্টিক কল্যাণের ওপর কোনো ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়ল কি না, কত লোক দুরবস্থার শিকার হলো- এসব বিষয়ে কোনো মাথাব্যথা থাকে না। এমন আচরণ বর্জনীয়, তেমনি কাউকে ঋণ দিয়ে, দান করে, সমাজসেবা করে, তা থেকে ভিন্ন কোনো সুবিধা নেওয়াও মন্দ স্বভাব ও বর্জনীয় অভ্যাস। এটা থেকে বিরত থাকা দরকার।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক