রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৫৫ অপরাহ্ন
মো. মিকাইল আহমেদ:
বর্তমান যুগ আধুনিক যুগ। শিল্পায়ন ও নগরায়নের যুগ। কলকারখানা, অফিস-আদালত, আকাশচুম্বী অট্টালিকা, বাড়ি-গাড়ি সব কিছুতে ছেঁয়ে গেছে শহর-নগর-বন্দর। সেই সাথে বেড়েছে মানুষের নানামুখী কর্মব্যস্ততা। জীবিকার টানে মানুষ ছুটে চলছে দেশ হতে দেশান্তরে। এক মুহূর্ত বিরাম নেই। দম ফেলার ফুসরতও মেলে না। উন্নত জীবন যাপনের আশায় ও অর্থোপার্জনের নেশায় পেয়ে বসেছে মানুষকে। আর এর সাথে এখন বেড়েছে মানুষের ভার্চুয়াল জগতে ঘন্টার পর ঘন্টার অযথা সময় ব্যয়ের অদ্ভুত সব কাজকারবার। টাকা উপার্জন, দুশ্চিন্তা, পেরেশানী কিংবা হয়রানী সবকিছু মিলে মানুষের জীবনটা হয়ে গেছে যান্ত্রিক। সারাদিন কর্মব্যস্ততায়, অফিসে বসের চাপে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে, পারিবারিক নানা টানাপোড়নে, চাহিদার সাথে যোগানের সামঞ্জস্যহীনতায় মানুষের জীবন হয়ে উঠেছে একেঘেঁয়ে, বিষন্ন ও অগোছালো। শান্তি নেই মানুষের মনে। ভেজাল খাদ্য ভক্ষণে শান্তি নেই মানুষের দেহেও। শরীরে বাসা বেঁধেছে নানারকম রোগ জীবাণু। উন্নত চিকিৎসার আশায় মানুষ ছুটছে হাসপাতাল হতে হাসপাতালে। মানুষের শারীরিক, আত্মিক ও সামাজিক জীবনে কিভাবে শান্তি আসে সেটা খুব কম মানুষই চিন্তা করে।
মানুষের অন্তর প্রশান্ত হয় আল্লাহর স্মরণে, আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমে। মানব জীবনের যাবতীয়, দুশ্চিন্তা ও দুঃখ-বেদনা নিরাময়ের জিয়নকাঠি তারই জিকির। অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন প্রকৃত মুমিনরা আল্লাহতায়ালাকে স্মরণ করে আর জিকিরের মাধ্যমে প্রাপ্ত হয় ঈমানি স্বাদ। আল্লাহতায়ালা সবসময় হাজির-নাজির। আল্লাহতায়ালাই প্রকৃত সাহায্যকারী ও মুমিনের পরম ভরসাস্থল। আল্লাহতায়ালার ভালোবাসা ও সান্নিধ্য লাভ করা যায় জিকিরের মাধ্যমে । জিকির করলে ফেরেশতা সাথী ও বন্ধু হয়ে সাহায্য করে সব সময়, চিরশত্রু শয়তান পালায়।
আল্লাহতায়ালাকে স্মরণ করার নির্দেশ স্বয়ং আল্লাহতাঅালা দিয়েছেন। কারণ আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন ‘আল্লাহর স্মরণই সর্বশ্রেষ্ঠ।’ (সুরা আনকাবুত: ৪৫) আল্লাহতায়ালার জিকির সম্পর্কে নবী কারীম রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, যে আল্লাহর জিকির করে এবং যে তার জিকির করে না, তাদের তুলনা জীবিত ও মৃতের মতো।’ (সহিহ বোখারি ও মুসলিম)
হাদিসে শরীফে আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ঘরে আল্লাহর জিকির হয় এবং যে ঘরে আল্লাহর জিকির হয় না, ওই ঘরের দৃষ্টান্ত জীবিত ও মৃতের মতো।’ (ফাতহুল বারি)
জিকির ঈমানের ভিত্তি মজবুত করে। জিকির মুমিনের অন্তরে বইয়ে দেয় প্রশান্তির সুবাতাস। জিকির দূর করে অন্তরের যাবতীয় রোগ বালাই। দূর করে ক্লান্তি, অশান্তি ও মানসিক অস্থিরতা। জিকির হলো সার্বক্ষণিক ইবাদত। পাক-পবিত্র অবস্থায় যেকোন সময় জিকির করা যায়। বাড়িতে কিংবা সফরে, স্থলভাগ, জলভাগ, বসা, দাঁড়ানো বা শায়িতবস্থা, দিন-রাত, অজু-গোসলের সময়ও কোনো বাধা নেই। জিকিরে আল্লাহর রহমতের বৃষ্টি বর্ষিত হয় অজস্র ধারায়। কোরআনুল কারিমে জিকির সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই তোমাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করেন এবং তার ফেরেশতারাও রহমতের দোয়া করেন, অন্ধকার থেকে তোমাদের আলোতে বের করার জন্য। তিনি মুমিনদের প্রতি পরম দয়ালু।’ (সূরা আল আহজাব: ৪২)
আল্লাহতায়ালা মানুষের প্রতি অজস্র ধারায় রহমত ও অনুকম্পা বর্ষণ করেন জিকিরের বিনিময়ে। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর জিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে, জেনে রাখো, আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তরসমূহ প্রশান্তি লাভ করে।’ (সূরা রাদ: ২৮)
আল্লাহ তাআলার দুনিয়াতে জান্নাতের দুটি উদ্যান রয়েছে যার মধ্যে একটি স্থির আর অপরটি সময় ও স্থানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, এক হাদীসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমার ঘর ও মিম্বারের মধ্যবর্তী স্থান জান্নাতের উদ্যান (রিয়াজুল জান্নাহ) সমূহের একটি। আর আমার মিম্বারটি হলো আমার হাউজে কাওছারের ওপর।’ (বুখারি ও মুসলিম)
হজরত আনাস ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘যখন তোমরা জান্নাতের উদ্যানের পাশ দিয়ে অতিক্রম করবে, তখন তাতে চড়ে নিবে। তারা (সাহাবায়ে কেরাম) বললেন, জান্নাতের উদ্যান কি? তিনি বললেন: জিকিরের (কুরআন ও হাদিসের আলোচনার) মজলিসসমূহ।’ (মুসনাদে আহমাদ, তিরমিজি)
কুরআন-হাদিসের মজলিসে বসলে আল্লাহ পরিচয় লাভ করা যায়; যারা সর্বদা আল্লাহ জিকির-আজকারে নিজেদের নিয়োজিত রাখে আল্লাহ তাআলা ওই বান্দাদের জন্য ফেরেশতা নিযুক্ত করেন যারা তাদেরকে রহমতের ছায়া দ্বারা আবৃত করে রাখেন। এ প্রসঙ্গে প্রিয় নবি করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীসে বলেন-
হজরত আবু হুরায়রা ও আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তাঁরা উভয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকটে উপস্থিত ছিলেন; তিনি বলেন, ‘যখন কোনো জাতি বসে আল্লাহর জিকির করে তখন ফেরেশতাগণ তাদেরকে ঘিরে ধরেন এবং তাদেরকে রহমতের ডানা দ্বারা ঢেকে নেন। আর তখন তাদের উপর প্রশান্তি নাজিল হয় এবং আল্লাহ তাআলা তাদের কথা (জিকিরকারী বান্দাদের কথা) যাঁরা তাঁর নিকটে আছেন তাদের (ফেরেশতাদের)কাছে উল্লেখ করেন।‘ (মুসলিম)
জিকির অর্থ স্মরণ করা আর আল্লাহকে স্মরণের গুরুত্ব অপরিসীম। জিকিরের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে বান্দার সংযোগ স্থাপিত হয়। কালবের ময়লা ঝড়তে থাকে ও মুমিনের রূহ সতেজ হতে থাকে জিকিরের মাধ্যমে। জিকিরের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে কুরআন ও হাদিসে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিন! তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমান স্মরণ কর।’ (সূরা আহযাব: ৪১)। ‘তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদের স্মরণ করব।’ (সূরা বাকারা:১৫২)। হযরত আবু হোরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, হযরত রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তায়ালা বলেন, যখন আমার বান্দা আমাকে স্মরণ করে এবং তাহার ঠোঁঠ আমার স্মরণে নড়চড়া করিতে থাকে তখন আমি তাহার সঙ্গে থাকি।’(মু.খা. ইলম ও জিকির: ১৩১)।
মানুষকে টাকা-পয়সা ও ধন-দৌলত কোন শান্তি দিতে পারে না বরং মানুষের পেরেশানি বৃদ্ধি করে। আর আল্লাহর জিকির এমন একটি ইবাদত ইহা যত করতে থাকবে ততই আত্মর শান্তি বাড়তে থাকবে।
জিকিরের ফজিলত অত্যন্ত ব্যাপক যা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। হযরত আবু দারদা (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সাল্লাল্লাহু অালাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন, ‘আমি কি তোমাদিগকে এমন আমল বলিয়া দিব না, যাহা তোমাদের আমলের মধ্যে সবচাইতে উত্তম, তোমাদের মালিকের নিকট সবচাইতে পবিত্র, তোমাদের মর্যাদাকে সবচাইতে উন্নতকারী, সোনা-রূপা আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় খরচ করা অপেক্ষাও উত্তম এবং জিহাদে তোমরা শক্রুকে কতল করিবে আর তাহারা তোমাদিগকে কতল করে ইহা হইতেও উত্তম হয়? আমি আরজ করিলাম, অবশ্যই বলিয়া দিন। তিনি বলিলেন, তাহা হইল, আল্লাহতায়ালার জিকির।’(মু.খা. ইলম ও জিকির:১৩৪)।
হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা) বর্নিত হয়েছে, অাল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন,‘জান্নাতীদের জান্নাতে যাওয়ার পর দুনিয়ার কোন জিনিসের জন্য আফসোস হইবে না। শুধু ঐ সময়ের জন্য আফসোস হইবে, যাহা দুনিয়াতে আল্লাহতায়ালার জিকির ব্যাতীত অতিবাহিত হইয়াছে।’(মু.খা. ইলম ও জিকির:১৩৮)।
আল্লাহর জিকির থেকে যারা গাফেল থাকেন আল্লাহ তাঅালা তাদের প্রতি অসন্তোষ্ট থাকেন। আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,‘ আর যে আমার জিকির থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জন্য হবে নিশ্চয় এক সংকুচিত জীবন এবং আমি তাকে কিয়ামত দিবসে উঠাবো অন্ধ অবস্থায়।’ (সূরা ত্বা-হা:১২৪)।
হযরত আবু হোরায়রা (রা) বর্ণিত হয়েছে, হযরত নবী করীম মোস্তফা (সাল্লাল্লাহু অালাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন,‘ যে সমস্ত লোক এমন কোন মজলিস হইতে উঠে যেখানে তাহারা আল্লাহ তায়ালার জিকির করে নাই, তবে তাহারা যেন মৃত গাধার নিকট হইতে উঠিয়াছে। আর এই মজলিস কিয়ামতের দিন তাদের জন্য আফসোসের কারণ হইবে।’ (মু.খা. ইলম ও জিকির:১৬৮)।
আল্লাহ তাআলা সমস্ত মুসলিম উম্মাহকে এরকম বরকতপূর্ণ মজলিস আয়োজন করার ও আল্লাহ তাআলাকে স্মরণ করার তাওফিক দান করুন যাতে দুনিয়াতে মুমিনের হৃদয়ে প্রশান্তি লাভ এবং পরকালের কল্যাণ লাভ হয়। আমিন।
লেখক: মো. মিকাইল আহমেদ
শিক্ষার্থী, আইসিএমএবি, ঢাকা।
ইমেইল: mekailahmed117@gmail.com