রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৫৫ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

অনুসন্ধান কমিটির জন্য কিছু প্রস্তাব

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন:
বাংলাদেশের জনপরিসরে এখন রাজনীতি সম্পর্কিত কেন্দ্রীয় মনোযোগ হচ্ছে সার্চ কমিটি বা অনুসন্ধান কমিটি গঠন, এর কার্যক্রম, কমিটি কর্তৃক গৃহীত নানান সিদ্ধান্ত এবং সার্বিক গতিবিধি। নতুন করে নির্বাচন কমিশন গঠন করার জন্য বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২’ অনুযায়ী একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছেন। সাংবিধানিক বিধিবিধানের মধ্যে মহামান্য রাষ্ট্রপতি এ অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেন।

এ অনুসন্ধান কমিটি রাজনৈতিক দলগুলোসহ সমাজের নানান স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলেন, পরামর্শ, প্রস্তাব নেন, শলাপরামর্শ করে আগামী নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে কিছু নাম প্রস্তাব করেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি সে প্রস্তাবিত নামগুলো থেকে যোগ্য লোকদের নিয়ে একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন।

দেশের মানুষের একটা সচেতন মনোযোগ এই সমগ্র প্রক্রিয়ার দিকে থাকে। কারণ অন্যান্য নির্বাচন ছাড়াও বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব থাকে এ নির্বাচন কমিশনের ওপর। আর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়েই পরবর্তী সরকার নির্বাচিত হয়। ফলে, রাজনৈতিক দলগুলোর যেমন একটা সচেতন মনোযোগ থাকে এ নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়ার ওপর, তেমনি সাধারণ মানুষেরও কমবেশি আগ্রহের একটা জায়গা এ নির্বাচন কমিশন গঠন।

পাশাপাশি সমাজে যারা সুশীল সমাজ নামে পরিচিত বা বিশিষ্ট নাগরিক হিসেবে নিজেদের দাবি করেন, তাদেরও একটা চিন্তা বা দুশ্চিন্তার জায়গা হচ্ছে নির্বাচন কমিশন কীভাবে গঠিত হবে, তার প্রক্রিয়া নিয়ে এবং এখানে এ আগ্রহ, আকর্ষণ ও মনোযোগ প্রভৃতি কোথাও কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে ‘নির্দলীয়, নিরপেক্ষ, সৎ এবং যোগ্য’ লোক খুঁজে বের করা।

বাংলাদেশের মতো একটি অর্গানিক সমাজে যেখানে সবাই একে অন্যের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সম্পর্কিত বা পরিচিত এবং বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিকভাবে দ্বি-বিভাজিত সমাজে নির্দলীয় লোক খুঁজে বের করা খুবই কঠিন একটি কাজ। আর নিরপেক্ষতার প্রশ্নটাও বেশ আপেক্ষিক। কেননা নিরপেক্ষতা মাপার মাপকাঠি কী? কীসের ভিত্তিতে মাপা যাবে কে নিরপেক্ষ বা কে নিরপেক্ষ নয়? অবশ্যই পক্ষপাতদুষ্টতা একজন মানুষের নেতিবাচক দিক হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে কিন্তু কোন বিষয়ের প্রতি কার কী ধরনের পক্ষপাত আছে, সেটা কীসের ভিত্তিতে মাপা হবে? এবং তা কে কীভাবে নির্ধারণ করবেন?

যেমন মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে নিরপেক্ষতা বলে কিছু নেই। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি তীব্র পক্ষপাতকে আমি একটা বড় যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করব। আবার অসাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে যার শক্ত পক্ষপাত আছে, তাকে আমি সত্যিকার যোগ্য লোক হিসেবে বিবেচনা করব। সুতরাং নিরপেক্ষতা সত্যিকার অর্থেই একটা আপেক্ষিক বিষয়। আর সৎ কিংবা যোগ্যতার প্রশ্নটাও একইভাবে ভাবাবেগ-নিরপেক্ষ এবং পক্ষপাত-নির্বিশেষ নয়।

ফলে, অনুসন্ধান কমিটি একটি নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অনুসন্ধান পরিচালনা করবে হয়তো। কিন্তু ‘নির্দলীয়, নিরপেক্ষ, সৎ এবং যোগ্য’ লোক খোঁজার কাজটি সত্যিই কঠিন। বিগত অনুসন্ধান কমিটিও এ কঠিন কাজটি করেছিলেন এবং সে সময় অনুসন্ধান কমিটির কাজও বেশ প্রশংসিত হয়েছিল। বর্তমান অনুসন্ধান কমিটিও আশা করি এ কঠিন কাজটি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করবেন সেটা এ দেশের মানুষ প্রত্যাশা করে।

বিগত ০৬/০২/২০২২ তারিখ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্মসচিব স্বাক্ষরিত একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। সে বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ‘নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলসমূহ আজ ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখ বিকেল ৫টার মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনার পদে সুপারিশ করার জন্য অনধিক ১০ জনের নাম প্রস্তাব করতে পারবে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে আগ্রহী ব্যক্তিরা তাদের নিজ নিজ নাম প্রস্তাব করতে পারবেন।’ এখানে শেষ বাক্যটি বেশ আগ্রহ-উদ্দীপক, কেননা প্রধান নির্বাচন কমিশনার হওয়ার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন একজন ব্যক্তি নিজে কখনোই নিজের নাম প্রস্তাব করবেন বলে আমার মনে হয় না। যে ব্যক্তি নির্বাচন কমিশনার হওয়ার মতো যোগ্য, তিনি কখনোই নিজের নাম নিজে প্রস্তাব করবেন না। আর যিনি নিজের নাম নিজে প্রস্তাব করবেন, তার প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন কমিশনার হওয়ার যোগ্যতা আছে বলে আমার মনে হয় না।

আর কোনো আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন মানুষ নিজের নাম নিজে প্রস্তাব করবেন বলেও আমার মনে হয় না। তাই, সুশীল সমাজের মাধ্যমে, বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণির মাধ্যমেও কিছু যোগ্য, দক্ষ ও সৎ ব্যক্তির নাম সংগ্রহ করা যেতে পারে। এবং অনুসন্ধান কমিটি সে প্রক্রিয়াও অনুসরণ করবে বলে আমাদের জানানো হয়েছে। সংবাদপত্রে কলাম লেখার সুবাদে ‘নির্দলীয়, নিরপেক্ষ, সৎ এবং যোগ্য’ লোক খোঁজার এ প্রক্রিয়ায় আমিও শরিক হওয়ার সুযোগ নিতে চাই এবং কয়েকটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব রাখতে চাই।

নির্দলীয় ও নিরপেক্ষতার কথা আগেই বলেছি যে, এগুলো একেবারেই আপেক্ষিক বিষয় এবং এ ইস্যুতে কোনোভাবেই সমালোচনার ঊর্ধ্বে ওঠা যাবে বলে আমার মনে হয় না। তথাপি, সমালোচনার মাত্রা এবং পরিধিকে যতই কমানো যায়, ততই সাধারণ মানুষের কাছে গঠিতব্য এ কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে নিঃসন্দেহে।

আর ‘নির্দলীয়, নিরপেক্ষ, সৎ এবং যোগ্য’ ব্যক্তি খোঁজার প্রশ্নে আমার প্রস্তাব হচ্ছে, যতই সৎ কিংবা যোগ্য হোক না কেন, ভবিষ্যৎ প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করতে হবে। স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতি নিঃশর্ত শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি বিশেষ করে একাত্তরের রাজাকার, আলবদর, আল-শামসের সঙ্গে যেকোনো ধরনের সম্পৃক্ততাহীনতার বিষয়টি প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণিত হতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনারকে অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক-বাহক হতে হবে। কেননা বাংলাদেশ একটি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের দর্শনে গঠিত বহু জাতির, বহু ভাষার, বহু ধর্মের, বহু বর্ণের এবং বহু সংস্কৃতির সমমর্যাদার মানুষের সহাবস্থানের ঐতিহ্য নিয়ে গঠিত একটি দেশ।

সর্বশেষ, যেটা জরুরি সেটা হচ্ছে, প্রশ্নাতীত দেশপ্রেম। এ দেশের প্রতি, এ দেশের মানুষের প্রতি এবং এ সমাজের প্রতি তীব্র দেশপ্রেম আছে, এ রকম ব্যক্তিদেরই নির্বাচন কমিশনে মানুষ দেখতে চায়। কেননা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি অশ্রদ্ধাশীল, দেশপ্রেমহীন এবং সমাজের প্রতি দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষ যতই দক্ষ ও যোগ্য হোক না কেন, নির্বাচন কমিশনের মতো একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নেওয়ার কোনো অধিকার তার/তাদের নেই বলেই আমি মনে করি।

সুতরাং, অনুসন্ধান কমিটি এসব প্রস্তাব তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বিবেচনায় নিলে, সেটা ‘নির্দলীয়, নিরপেক্ষ, সৎ এবং যোগ্য’ নির্বাচন কমিশন গঠনের কাজে এ দেশের সাধারণ মানুষের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্যতা পাবে বলে আমি মনে করি।

লেখক নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION