মঙ্গলবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:২৮ অপরাহ্ন
মুহাম্মদ ছফিউল্লাহ হাশেমী:
আল্লাহতায়ালা সৃষ্টির সেরা জীবরূপে মানুষ সৃষ্টি করে তাদের মনের ভাব প্রকাশের জন্য ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন। বিচিত্র ধরনের ভাষা পৃথিবীতে রয়েছে। জগৎজুড়ে ভাষা বৈচিত্র্যের এই যে অপরূপ সমাহার সেটা আল্লাহর কুদরতের এক অনুপম নিদর্শন। কোরআন মজিদে আল্লাহর কুদরতের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। ভাষা ও বর্ণের নিদর্শন সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘তার আরও একটি নিদর্শন হচ্ছে- নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানীদের জন্যে নিদর্শনাবলি রয়েছে।’ সুরা আর রুম : ২২
মানুষ তার মাতৃভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করে। কারণ আল্লাহ মানুষের জন্মের পর তাকে মায়ের ভাষাতেই কথা বলতে শিখিয়েছেন। ভাষা মানুষের প্রতি মহান আল্লাহর অশেষ দয়া ও অনুগ্রহ এবং তার সৃষ্টি কুশলতার এক অনুপম নিদর্শন। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘করুণাময় আল্লাহ, শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন, সৃষ্টি করেছেন মানুষ এবং তাকে কথা বলা শিখিয়েছেন।’ সুরা আর রাহমান : ০১-০৪
মহান আল্লাহ পৃথিবীতে অসংখ্য নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন। তারা পৃথিবীতে এসেছেন আল্লাহর অমিয় বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। যুগে যুগে আল্লাহতায়ালা যে অঞ্চলে নবীরাসুল পাঠিয়েছেন সেই নবী-রাসুলকে সেই অঞ্চলের মানুষের ভাষাভাষী করেছেন। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আমি সব নবীকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেই পাঠিয়েছি, যাতে তাদের পরিষ্কারভাবে বোঝাতে পারে। অতঃপর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎপথ প্রদর্শন করেন। তিনি পরাক্রান্ত, প্রজ্ঞাময়।’ সুরা ইবরাহিম : ৪
এ আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে,
মাতৃভাষার মাধ্যমে যত সহজে মানুষকে কোনো বিষয় বোঝানো যায়, তা অন্য কোনো ভাষায় তত সহজে বোঝানো যায় না। এ কারণে আল্লাহতায়ালা নবীদের তাদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছেন। তাই লক্ষ্য করা যায় হিব্রু ভাষাভাষী অঞ্চলে আল্লাহ যখন কোনো নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন তার ভাষাও হয়েছে হিব্রু এবং তার কাছে আল্লাহর যে কিতাব নাজিল হয়েছে, তা সেই ভাষায়ই নাজিল হয়েছে। যেমন তাওরাত ও ইনজিল। আবার এমনটিও লক্ষ্য করা যায়, কোনো নবী-রাসুল জন্মগ্রহণ করেছেন এক ভাষাভাষী অঞ্চলে কিন্তু তাকে অন্য ভাষাভাষী অঞ্চলে গিয়ে বসবাস করতে হয়েছে।
সেই অঞ্চলের মানুষের ভাষা তিনি আয়ত্তে এনেছেন এবং সেই ভাষাতেই তার প্রচার কাজ করেছেন। যেমন, আল্লাহর নবী হজরত লুত (আ.) জন্মগ্রহণ করেছিলেন উর্বর হেলাল অঞ্চল বলে পরিচিত মেসোপটেমিয়া অর্থাৎ ইরাক অঞ্চলে। তিনি পরবর্তী সময়ে ফিলিস্তিন অঞ্চলে চলে যান এবং সেই অঞ্চলের মানুষের ভাষায় প্রচার কাজ চালান। এমনিভাবে দেখা যায়, প্রত্যেক নবী-রাসুল তার মাতৃভাষায় মানুষের কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছে দিয়েছেন, মানুষকে সত্য ও সুন্দরের পথে আহ্বান করেছেন।
নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাতৃভাষা ছিল আরবি। তার কাছে আসমানি কিতাব পবিত্র কোরআন নাজিল হয় মানুষের দিশারি এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। এই কোরআন মজিদের ভাষা আরবি। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের
মাতৃভাষা আরবিতে কোরআন মজিদ নাজিল হওয়া প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি আপনার ভাষায় কোরআনকে সহজ করে দিয়েছি, যাতে তারা স্মরণ রাখে।’ সুরা আদ্ দুখান : ৫৮
‘এমনিভাবে আমি আপনার প্রতি আরবি ভাষায় কোরআন নাজিল করেছি, যাতে আপনি মক্কা ও তার আশপাশের লোকদের সতর্ক করেন এবং সতর্ক করেন সমাবেশের (কিয়ামত) দিন সম্পর্কে।’ সুরা আশ্ শুরা : ৭
‘আমি একে আরবি ভাষায় কোরআনরূপে নাজিল করেছি, যাতে তোমরা বুঝতে পারো।’ সুরা ইউসুফ : ২
আল্লাহতায়ালা তার প্রিয় হাবিব রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উদ্দেশ্য করে ইরশাদ করেন, ‘আমি কোরআনকে আপনার ভাষায় সহজ করে দিয়েছি, যাতে আপনি মুত্তাকিদের সুসংবাদ দেন এবং কলহকারী সম্প্রদায়কে সতর্ক করেন।’ সুরা মারইয়াম : ৯৭
‘এমনিভাবে আমি আরবি ভাষায় কোরআন নাজিল করেছি এবং এতে নানাভাবে সতর্কবাণী ব্যক্ত করেছি, যাতে তারা আল্লাহভীরু হয় অথবা তাদের অন্তরে চিন্তার খোরাক জোগায়।’ সুরা তোয়াহা : ১১৩
পবিত্র কোরআন হতেই আমরা জানতে পারি, ইসলামি আদর্শ যেমন সর্বজনীন, ইসলামের ভাষাও তেমনি সর্বজনীন। ‘আপন পালনকর্তার পথের প্রতি আহবান করুন জ্ঞানের কথা বুঝিয়ে ও উপদেশ শুনিয়ে উত্তমরূপে এবং তাদের সঙ্গে বিতর্ক করুন পছন্দযুক্ত পন্থায়।’ -সুরা আন নাহল : ১২৫
এ কারণেই দেখা যায়, পরবর্তী সময়ে ইসলাম প্রচার করা পৃথিবীর যে অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করতে গিয়েছেন সেই অঞ্চলের মানুষের ভাষা আয়ত্ত করে সেই ভাষাতেই ইসলামের বাণী সেই অঞ্চলের মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন। তাদের মাতৃভাষায় পবিত্র কোরআন অনুবাদ করে তাদের কোরআন-হাদিসের জ্ঞানদান করেছেন এবং নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতের হুকুম-আহকাম, নিয়ম-কানুন শিক্ষা দিয়েছেন। যতদূর জানা যায়, বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার শুরু হয় ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর খেলাফতকালের মধ্যভাগ হতে অর্থাৎ ৬৪০ খ্রিস্টাব্দের দিকে।
আরব, ইয়েমেন, ইরাক, ইরান, খুরাসান, তুরস্ক, মিসর প্রভৃতি বিভিন্ন দেশ থেকে ইসলাম প্রচারকরা বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের জন্য আগমন করেছেন। তারা এদেশে এসে ভাষা আয়ত্ত করে মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন। ফলে মানুষ অতি সহজে তাদের কাছ থেকে ইসলাম সম্পর্কে জানার সুযোগ পায় এবং দলে দলে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। আরও লক্ষ্য করা যায়, বাংলা ভাষা এক দারুণ অবহেলিত অবস্থা থেকে উদ্ধারপ্রাপ্ত হয় মুসলমানদের আগমনের ফলে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বাংলার সুলতানদের দ্বারা বাংলা ভাষার উৎকর্ষ ও বিকাশ সাধিত হয়।
ভয়েস/আআ