রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০২:৫৮ অপরাহ্ন
শাহাদাত হোসাইন স্বাধীন:
রাশিয়ার পার্লামেন্টে পূর্ব ইউক্রেনের দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক ইউক্রেনভুক্ত দুটি ভূখন্ডকে স্বাধীন প্রজাতন্ত্রের স্বীকৃতি দেন পুতিন। এই রুশ স্বীকৃতির পরদিন মঙ্গলবার থেকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা জারি করতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যরাষ্ট্রগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি যুক্তরাজ্যও রাশিয়ার ৫টি ব্যাংকের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে মঙ্গলবার। তবে রাশিয়া এরই মধ্যে দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক নিয়ন্ত্রণে ইউক্রেন ভূখন্ডে সৈন্য ঢুকিয়ে দিয়েছে। ইউক্রেনও হামলা প্রতিরোধের ঘোষণা দিয়েছে। ফলে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। উভয় পক্ষই বিমান ভূপাতিত করার দাবি করছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র জোট ন্যাটো এখনো নিশ্চিত হতে পারছে না তারা কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক নাকি সামরিক উপায়ে রাশিয়াকে মোকাবিলা করবে।
ন্যাটো জোটেরই গুরুত্বপূর্ণ ও বৃহত্তম সদস্য তুরস্ক রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে এসব শাস্তিমূলক পদক্ষেপ সমস্যার সমাধানে কোনো কাজে আসবে না বলে মনে করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। রাশিয়া তুরস্ক সম্পর্ক এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে উষ্ণ। গত বছর তুরস্কে মোট ব্যবহৃত জ্বালানি গ্যাসের ৪৬ শতাংশই এসেছে রাশিয়া থেকে। রাশিয়া থেকে তুরস্ক পেয়েছে বহুল আলোচিত এস-৪০০ ডিফেন্স সিস্টেম। রাশিয়ার দীর্ঘদিনের মিত্র সিরিয়াও সমর্থন জানিয়েছে রাশিয়াকে। চীনও এ ধরনের ‘একতরফা’ নিষেধাজ্ঞার সমালোচনা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র রাষ্ট্রসমূহ যখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা জারি করে যাচ্ছে, সে সময় দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও জোরদার করার আগ্রহ জানিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। এই উত্তেজনাকর সময়ে মস্কো সফরে রয়েছেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইমরান খান। মি. খানের দপ্তর বলছে রাশিয়া থেকে গ্যাস আনার জন্য যে নর্থ সাউথ পাইপলাইন প্রকল্প চলমান, তাতে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। নির্মাণের দায়িত্ব পাওয়া কোম্পানি মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় পড়েছে। বিকল্প কোম্পানির বিষয়ে আলাপে তার এ সফর। মূলত পাকিস্তানের চির প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের যুক্তরাষ্ট্রমুখী হওয়ার বিপরীতে পাকিস্তানের রাশিয়ামুখী হতে এই সফর। শুধু বাণিজ্য সম্পর্ক নয় পাকিস্তান রাশিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে সামরিক সম্পর্কেও।
সার্বিক পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক চলছে। কী হবে সবার জানা। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স যাই বলুক রাশিয়া ও চীন ভেটো দিয়ে চলে আসবে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল ব্রেন্ট ক্রুড তেল বিক্রি হচ্ছে ১০০ ডলারে, যা গত ৭ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। উদ্বেগ রয়েছে গ্যাস বাজার নিয়েও। ইউরোপের বার্ষিক এলএনজির (লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস) চাহিদার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ সরবরাহ আসে রাশিয়া থেকে। কাতারের জ্বালানিসম্পদ মন্ত্রী জানিয়েছেন, কাতারের পক্ষে রাশিয়ার বিকল্প হয়ে ওঠা একেবারেই সম্ভব নয়। তারা বড়জোর ইউরোপের বার্ষিক চাহিদার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ জোগান দিতে পারবে। ফলে শব্দের চেয়ে ৯ গুণ দ্রুতগতির হাইপাসনিক মিসাইল, বা এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা নয়, গ্যাসও রাশিয়ারও বড় কূটনৈতিক অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পুতিন কোথায় থামবে : পুতিন আসলে কী চান! আপাতদৃষ্টিতে পুতিন চাইছেন তার সীমান্তে ন্যাটো না আসুক, সাবেক সোভিয়েতভুক্ত দেশসমূহ ন্যাটোতে যোগ না দিক। তবে পুতিন এখানেই থামবে না। পুতিন সাবেক সোভিয়েতভুক্ত দেশসমূহকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চান। জর্জিয়া থেকে কাজাখস্তান বা ক্রিমিয়া সবগুলো দেশে পুতিন নানাভাবে তার অবস্থান জানান দিচ্ছে। পুতিনের এই আত্মবিশ্বাসের কারণও রয়েছে। ২০১৪ সালে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া দখল করে নিতে রাশিয়াকে সামরিক ও কূটনীতিকভাবে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। পশ্চিমা কিছু মিত্র রাষ্ট্র ছাড়া কেউ খুব একটা কথা বলেনি। ফলে পুতিন ইউক্রেনের দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক দখল করেই শান্ত হবে তা ভাবার কারণ নেই। পুতিন দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের পর ক্রিয়েভ অভিমুখে যাত্রা করতে পারেন। এমনকি ক্রিমিয়া উপদ্বীপের কাস্পিয়ান সাগরে নিজেদের সামরিক উপস্থিতি দাঁড় করাতে পারেন।
চলতি বছরের শুরুতে রাশিয়া সৈন্য পাঠিয়েছে সাবেক সোভিয়েতের অপর দেশ কাজাখস্তানে। কাজাখস্তানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট তোকায়েভ রাশিয়াপন্থি। তার বিরুদ্ধে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ দানা বাঁধলে কোনো পশ্চিমা গ্রুপ যেন ক্ষমতা নিতে না পারে তা নিশ্চিত করতে পুতিনের সেনা অভিযান। এই সৈন্য পাঠানো হয়েছিল মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার ১৯৯২ সালের করা কালেক্টিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা সিএসটিওর আওতায়। সাবেক সোভিয়েতভুক্ত পাঁচ দেশ আর্মিনিয়া, বেলারুশ, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান ও তাজিকিস্তান এই চুক্তির সদস্য। বেলারুশ ও আর্মেনিয়াতেও প্রায়ই রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তাল। ফলে অদূর ভবিষ্যতে এসব দেশেও রাশিয়া সৈন্য পাঠাবে না তা বলা মুশকিল। তবে ২০০৮ সালের জর্জিয়া, ২০১৪ সালের ক্রিমিয়া বা ২০২২ সালের ইউক্রেনের আক্রমণে রাশিয়ার কোনো চুক্তির ধার ধারতে হয়নি। শুধু পশ্চিমাপন্থি শাসকরা ক্ষমতায় আসায় রাশিয়া তাদের সামরিক কায়দায় জবাব দিয়েছে।
রাশিয়া সংকটে চীন ফ্যাক্টর : যুক্তরাষ্ট্র সাম্প্রতিক সময়ে তার প্রধান ‘শত্রু’ হিসেবে চীনকে চিহ্নিত করলেও রাশিয়ার প্রতিবেশী মনোযোগ দিচ্ছে কি না প্রশ্ন করা যায়। চীনের অর্থনীতি রাশিয়ার ১০ গুণ বড়, সামরিক ব্যয় ৪ গুণ বেশি। শুধু তাই নয়, চীন ১ নম্বর পরাশক্তি হওয়ার বাসনা করেছে। এ ছাড়া যত দেশের ওপর মার্কিনরা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তাদের নানাভাবে আগলে রেখেছে চীন। ইরানকে শায়েস্তা করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তেল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে তা উপকৃত করেছে চীনকে। ইরানের ‘সস্তা’ তেল কিনে উপকৃত হয়েছে চীন। চীন এখন ইরানের বৃহত্তম বিনিয়োগকারী দেশও। অন্যদিকে মিয়ানমারেও মার্কিন নিষেধাজ্ঞার চাপে পড়ে একেবারে চীননির্ভর একটি দেশে পরিণত হয়েছে। একই অবস্থা কম্বোডিয়ারও। ফলে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব কমিয়ে দিয়েছে চীন। বর্তমানেও আন্তর্জাতিক সুইফট ব্যবস্থা থেকে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে বাদ দেওয়ার যে পলিসি যুক্তরাষ্ট্র নিতে যাচ্ছে তাতেও লাভবান হবে চীন। রাশিয়ার ব্যাংকগুলো চীনের কাছে ঘেঁষবে, সেই সঙ্গে রাশিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ গ্যাস পাওয়ার সুযোগ পেয়ে যাবে চীন। ফলে পশ্চিমারা যদি নর্ড স্ট্রিম ২ গ্যাস লাইন যা দিয়ে রাশিয়া থেকে জার্মানিতে গ্যাস যায় তা যদি বন্ধ করে দেয় তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পশ্চিমারাই। রাশিয়ার কাছে বিকল্প তো রয়েছে আর চীন এই সুযোগে তার ব্যবসাকে আরও সম্প্রসারিত করতে পারবে। পশ্চিমা বিশ্বের কাছে এখন বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতির একচেটিয়া দখল নেই।
লেখক : শিক্ষার্থী, সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, নয়াদিল্লি