শনিবার, ২৮ Jun ২০২৫, ০২:০৪ পূর্বাহ্ন
সাইফুদ্দীন আল মোবারক, টেকনাফ:
টেকনাফ উপজেলার উপকূলীয় অঞ্চলে লবণ চাষের ভরা মৌসুম চলছে। পুরোদমে চলছে মাঠে লবণ উৎপাদন। পচ- গরম উপেক্ষা করে মাঠে কাজ করছেন চাষীরা । লবণ কে অনেক চাষীরা সাদা সোনা বলে দাবি করে থাকেন ।
এই সাদা সোনা ঘিরেই চাষীরা সফলতার স্বপ্ন দেখেন। ন্যায্য মূল্য না পেয়ে সফলতার স্বপ্ন ভেঙ্গে তছনছ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন লবণ চাষীরা । চাষীদের অভিযোগ, লবণ মিলের মালিক ও অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে মাঠ পর্যায়ে লবণের দাম কমিয়ে দিয়েছে। যার কারণে এতো কষ্ট করে লবণ চাষ করেও ঠিকই দুঃখ ভরা জীবন রয়েই যাচ্ছে তাদের । অবশেষে লাভবান হয় অসাধু সিন্ডিকেটধারী ব্যবসায়ীরা ।
বিসিকের তথ্য অনুযায়ী, পলিথিন প্রযুক্তির প্রতি একর জমিতে লবণ উৎপাদিত হচ্ছে ৩০ মেট্রিক টন। আর সনাতন পদ্ধতিতে উৎপাদিত হয় ১০ মেট্রিক টন। লবণ উৎপাদনের জন্য প্রথমে মাঠ পরিষ্কার ও সমতল করতে হয়। তারপর লবণ পানি জমিয়ে রাখার জন্য সেই মাঠে ছোট বাঁধ দিয়ে চার কোণায় একাধিক ঘর করতে হয়। তারপর মাঠে বিছানো হয় কালো পলিথিন। পরে বঙ্গোপসাগর কিংবা নাফ নদীর লোনা পানি ঢুকিয়ে সেই কক্ষ ভর্তি করা হয়। সূর্যের তাপে কক্ষের পানি শুকিয়ে তৈরি হয় লবণ। পরে চাষীরা পলিথিনের ওপর থেকে সেই লবণ সংগ্রহ করে মজুত করেন। কালো পলিথিনে তাপমাত্রা বাড়ে বলে ৯৮ শতাংশ জমিতে কালো পলিথিন বিছানো হয়। এইভাবে তীব্র রোদে কষ্ট করে লবণ চাষ করেন চাষীরা ।
সরেজমিনে লবণ মাঠ ঘুরে দেখা যায়, সাবরাং ইউনিয়নের নয়া পাড়া, শাহপরীর দ্বীপের হাজার হাজার একর জমিতে বিশাল মাঠ জুড়ে লবণের স্তুপ। লবণ শ্রমিকরা উক্তপ্ত রোদে মাঠে কাজ করছে। কালো পলিথিনে সারি সারি লবণের প¬ট বা বেড। ওই বেডের পলিথিনের উপর সাদা লবণের দানা।চাষীদের ভাষায় সাদা সোনা । আবার অনেকেই দেশের সাদা সোনা নামে খ্যাত করেছে এই উৎপাদিত লবণকে। মাঠের শ্রমিকরা ওই বেডে খড়া লবণের পানি ছিটাচ্ছেন। শ্রমিকের শরীর বেয়ে ঝরঝর করে মাথার ঘাম পায়ে পড়ছে। তারপরেও এই তপ্ত রৌদ্রকে তোয়াক্কা না করে পুরোদমে কাজ করে যাচ্ছে শ্রমিকরা।
সরেজমিনে কথা হয় শাহ পরীর দ্বীপের লবণ মাঠে আব্দুল হামিদ নামে এক শ্রমিকের সাথে , তিনি জানান, হঠাৎ করে লবণের দাম পড়ে যাওয়ায় খুবই দুশ্চিন্তায় আছি। এক মণ লবণ বিক্রি করে ৩ কেজি চালও পাওয়া যাচ্ছে না। এভাবেই দিন দিন লবণের দাম কমে গেলে আমাদের কী উপায় হবে ! আগামীতে হুমকির মুখে পড়বে লবণ শিল্প।তিনি সরকারের কাছে ন্যায্য মূল্য দাবি জানান । শাহ পরীর দ্বীপের লবণ মাঠের মালিক জাহেদ উল্লাহর সাথেও কথা হলে তিনি বলেন, বর্তমানে লবণের দাম প্রতি মণে ১৮০-১৯০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এই দরের মধ্যে উঠানামা করে লবণের দাম। খরচের চেয়ে কম দামে বিক্রি করার ফলে লোকসান গুনতে হচ্ছে চাষীদের।
চাষীদের অভিযোগ, লবণ মিলের মালিক ও ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট তৈরী করে মাঠ পর্যায়ে লবণের দাম কমিয়ে দিয়েছে। এমনকি উৎপাদিত লবণ কম দামে বিক্রিতে এক প্রকার বাধ্য করা হচ্ছে। অথচ বাজারে এক কেজি প্যাকেট জাত লবনের ম্ল্যু ৩০-৪০ টাকা।
সাবরাংয়ের লবণ চাষী মোহাম্মদ শরীফ হোসেন বলেন, যেভাবে লবণের দাম দিন দিন কমে যাচ্ছে, এই অবস্থা চলতে থাকলে লবণ চাষ করে চাষীরা বিনিয়োগও ওঠাতে পারবে না । বলতে গেলে পানির দামেও বিক্রি করা যাচ্ছে না ‘লবণ’। তিনি আরো বলেন,প্রতি একর লবণ মাঠে খরচ পড়ছে ৫০ হাজার টাকা। ইতিমধ্যে লবণ বিক্রি করে প্রতি একরে ২০ হাজার টাকাও পাওয়া যায়নি। চলমান দরে লবণ বিক্রি করা যাচ্ছে না। লবণ বিক্রি করলে এখন বড় ধরণের লোকসানের সম্মুখীন হবেন চাষিরা। যার ফলে অবিক্রিত লবণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। উৎপাদন যত বেশি হচ্ছে, লবণের দামও তত কমে যাচ্ছে ।
জানতে চাইলে টেকনাফ উপজেলা লবণ চাষি কল্যাণ সমিতির সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শফিক মিয়া জানান, ‘বর্তমানে মাঠ জড়ে বড় বড় গর্তে স্তুপ করে হাজার হাজার মণ উৎপাদিত লবণ মাঠে মজুত করে রেখেছে । সিন্ডিকেট করে মধ্যত্বভোগীরা লবণের দাম কমিয়ে দেয়ায় এ অবস্থা হয়েছে। কিন্তু লবণের ন্যায্যমূল্য নিয়ে কেউ ভাবছেন না। লোকসান দিয়ে লবণ বিক্রি করে দাদনের টাকাও পরিশোধ করতে পারবে না অনেক চাষীরা।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) টেকনাফের ইনচার্জ মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, টেকনাফে লবণ চাষ হচ্ছে ৩ হাজার ৯৪৫ একর জমিতে। ইতিমধ্যে টেকনাফ উপজেলার উপকূলীয় অঞ্চলে ৫৯ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদিত হয়েছে। তবে গত বছরের তুলনায় লবণ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু লবণের দাম কম হওয়ায় চাসীদের মাঝে হতাশা দেখা গেছে। ইতোমধ্যে বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।
ভয়েস/আআ